ছুটিরঘণ্টা I ধনেশের দেশে
প্রাণবৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও আদিবাসীদের জীবনধারার জন্য নাগাল্যান্ড বিখ্যাত। সেখানে প্রতিবছর একটি উৎসব হয়। পর্যটনশিল্পের প্রসারই এর লক্ষ্য। লিখেছেন—গাজী মুনছুর আজিজ
ঠিক দুপুরে পৌঁছি নাগাল্যান্ডের কিসামার হর্নবিল উৎসবে। মেঘালয়, আসাম হয়ে একটানা প্রায় ৩৮ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে আসি এখানে। উৎসবে তখন নাগাল্যান্ডের আদিবাসীদের নাচ-গানের পরিবেশনা চলছে। দুপুরে বিরতি হলো। এরপর মঞ্চে শুরু হয় নাগা মরিচ খাওয়ার প্রতিযোগিতা। এটিও উৎসবের অংশ। ঝালের জন্য নাগা মরিচ পৃথিবী বিখ্যাত। কিছুক্ষণ মরিচ খাওয়া দেখে ট্যাক্সিতে আসি আমাদের থাকার জায়গায়। উৎসবের জায়গা থেকে এটি প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। জায়গাটির নাম ডাউন। আর জায়গার নামেই ডাউন হোম স্টে। পথের পাশে পাহাড়ের কোলঘেঁষা একটি বাড়ি। বাড়ির উঠান আর বারান্দাজুড়ে ফুলের টব, সাজানো-গোছানো ছিমছাম। এক দেখাতেই ভালো লাগল। দলের তিন সদস্য কামাল, আমির আর মতিন ভাইয়ের জায়গা হয়েছে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা শহরের একটি হোটেলে। দলনেতা মনা ভাই, মানিক, ফাহমি ও আমি থাকব এ বাড়িতে। কোহিমা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে এ বাড়ি। সেখানে গিয়ে ব্যাগ রেখে ঠান্ডা পানিতে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে চা-বিস্কুট খাই। এরপর আবার ট্যাক্সিতে আসি উৎসবে। গ্যালারিতে বসে দেখি স্থানীয় আদিবাসীদের নাচ-গানের পরিবেশনা। গ্যালারি জুড়ে দেখা গেল পৃথিবীর নানা দেশের ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা অসংখ্য পর্যটক-দর্শক।
হর্নবিল বা ধনেশ পাখির নামে এই উৎসবের আয়োজক নাগাল্যান্ড সরকারের নাগাল্যান্ড ট্যুরিজম। এটি ১৯তম আয়োজন। প্রতিবছর ১ থেকে ১০ ডিসেম্বর এই উৎসব হয়ে আসছে। ২০০০ সালের ১ ডিসেম্বর নাগাল্যান্ড রাজ্য দিবস উদ্্যাপন উপলক্ষে উৎসবটির সূচনা হয়। উৎসবটির লক্ষ্য পর্যটনশিল্পের প্রসারকল্পে সেখানকার জীববৈচিত্র্য এবং আদিবাসীদের সংস্কৃতি তুলে ধরা।
আমরা উৎসবে যোগ দিই ৭ ডিসেম্বর। এক পাশে পাহাড়ের কোলঘেঁষে গ্যালারি, অন্য পাশে মঞ্চ। মাঝে খোলা মাঠ। এ মাঠেই চলছে পরিবেশনা। সবই দলীয়। প্রতি দলেই আছেন পুরুষ-মহিলাসহ ২০ থেকে ৩০ জন। তারা তাদের কৃষিকাজ, মাছ ধরাসহ জীবন-যাপনের নানা সংস্কৃতি ও তাদের উৎসব-পার্বণের ঐতিহ্যকে এই উৎসবে তুলে ধরছেন নাচ-গানসহ বিভিন্ন পরিবেশনার মাধ্যমে। সবার পোশাকই উজ্জ্বল রঙের। সঙ্গে বিচিত্র গয়না। তাতে ধনেশ পাখির কৃত্রিম ঠোঁট ও পালকের ব্যবহারও দেখা যায়। এ ছাড়া ছিল রঙিন পুঁথি, ধাতব, সুতাসহ নানা ধরনের গয়না। এসবের পাশাপাশি প্রায় সবার মাথায় রয়েছে সুতা-কাপড়, ধনেশ পাখির কৃত্রিম ঠোঁট, পালকসহ বিচিত্র ধরনের মুকুট। কিছু কিছু দল তাদের পরিবেশনায় ব্যবহার করে ঢাল-বল্লম, বড় আকৃতির ঢোল, কৃষি সরঞ্জাম ইত্যাদি। সবকিছু মিলিয়ে বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা।
একে একে ১৬টি আদিবাসী দলের পরিবেশনা দেখে গ্যালারি ছাড়ি। ততক্ষণে বিকেল গড়িয়েছে। পরের অনুষ্ঠান সন্ধ্যার পর। এ ফাঁকে আমরা আসি ‘নাগা ঐতিহ্য গ্রাম’ ঘুরতে। মূলত জায়গাটির নাম কিসামা হলেও এর পোশাকি নাম—নাগা ঐতিহ্য গ্রাম। উৎসবের গ্যালারির পাশেই পাহাড়ের কোলঘেঁষে। নাগার ঐতিহ্যবাহী যে ১৬টি আদিবাসী আছে, তাদের নমুনা গ্রাম এটি। সেখানে প্রতিটি আদিবাসীর বাসস্থানের মডেল আলাদাভাবে স্থাপন করা হয়েছে। উৎসবের সময় তারা এসব বাড়িতে থাকেন, রান্নাবান্না ও খাওয়াদাওয়া করেন। খাবারগুলোও থাকে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের। যেসব তৈজসপত্র, যেমন গ্লাস, মগ, থালাবাটি এসবও কাঠ বা বাঁশের তৈরি। প্রতিটি বাড়ির ভেতর-বাহিরে উপস্থাপন করা হয়েছে তাদের পোশাক, গয়না, কৃষি সরঞ্জাম, দা, ছুরি, কাঁচি, বাঁশ, বেত বা কাঠের তৈরি ঝুড়ি, ডালাসহ বিভিন্ন পাত্র, ঢাল, বল্লমসহ জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গ। বাড়িগুলো কাঠ, বাঁশ, বেত, পাতার তৈরি। সব ঘরের ভেতর তাদের নমুনা চুলাসহ রান্নাঘরও আছে। চালা ছন বা পাতার।
গ্রাম দেখে সন্ধ্যার পর আবার বসি গ্যালারিতে। এ পর্বের পরিবেশনা লোকগানের প্রতিযোগিতা। এটাও উৎসবের অংশ। এ পর্ব শেষে হাঁটতে শুরু করি থাকার জায়গার উদ্দেশে। বেশ ঠান্ডা পড়ছে। এর মধ্যেই হাঁটছি আমরা। অনেকটা নির্জন পাহাড়ি পথ। বেশ লাগছে। ঘণ্টাখানেক লাগল। সকালে নাশতা সেরে আবার আসি নাগা ঐহিত্য গ্রামে। প্রায় সব বাড়ির উঠানে দেখি আদিবাসীদের নাচের প্রস্তুতি। ঘুরে ঘুরে তা দেখি। সেই সঙ্গে দেখি তাদের বাড়িঘরের অন্দর-বাহির। অনেক বাড়ির সামনে ঐতিহ্যবাহী পণ্য ও খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তাদের ঐতিহ্যবাহী বন্দুকও আছে। বারুদ দিয়ে চলে এ বন্দুক। আমাদের মানিক ভাই সম্ভবত এক শ রুপি দিয়ে ফাঁকা আওয়াজ করে দেখেছেনও।
উৎসব উপলক্ষে নাগা কৃষিপণ্য, ফুল, ফল, আলোকচিত্র, শিল্পকর্ম ও নানা ঐতিহ্যবাহী পণ্যের প্রদর্শনী চলছে। নাগা তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগ, শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগ, শিল্প ও সংস্কৃতি বিভাগ আয়োজন করেছে। পাশাপাশি রয়েছে রাইফেলস বিভাগের অস্ত্র ও অন্য সামরিক বিষয়ের প্রদর্শনী। এসব দেখে আসি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাদুঘরে। এটি উৎসবস্থলেই।
সব দেখে বসি গ্যালারিতে। ততক্ষণে দিনের প্রথম পরিবেশনা শুরু হয়েছে। আয়োজকদের কাছ থেকে জানা গেল, উৎসবের প্রতিদিনই নাগাল্যান্ডের ১৬টি আদিবাসীর পরিবেশনা থাকে। আমরা দুপুর পর্যন্ত দেখে বের হই কোহিমার উদ্দেশে।
ছবি : লেখক