ফিচার I ভেষজ পাতাহার
বালাইনাশের পাশাপাশি খাবারে স্বাদ আনে। ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসহ পুষ্টিগুণে ভরপুর
বাঙালি খাদ্যসংস্কৃতির চিরায়ত উপাদান ভর্তা। অতীতে এটি নিম্ন আয়ের মানুষের খাবার হলেও বর্তমানে অভিজাতদের টেবিলে পদটি ঠাঁই পাচ্ছে। এর কদর এতটাই বেড়েছে যে ঢাকার কিছু রেস্তোরাঁ শুধু ভর্তায় ভর করে সুখ্যাতি পেয়েছে। ফলে দামও তুঙ্গে। তাই এটিকে এখন আর সস্তা খাবার বলা যায় না। দিন দিন বেড়েই চলেছে এর উপকরণ। প্রকরণেও এসেছে বৈচিত্র্য। সবজি, শাক, বীজ, খোসা- কিছুই বাদ যাচ্ছে না। মসলা যোগে শিলনোড়ায় বেটে তৈরি হচ্ছে মুখরোচক পদগুলো। সেই তালিকায় যোগ হয়েছে কিছু ভেষজ পাতাও। যেমন থানকুনি, ধনে, পুদিনা, শজনে, রসুনপাতা ইত্যাদি। ভর্তাগুলো স্বাদে একঘেয়েমি হটিয়ে দেয়। পুষ্টিগুণেও উঁচু। রূপচর্চায় কাজে লাগে। থানকুনির কথাই ধরা যাক। রীতিমতো গবেষণা হয়েছে এই পাতা নিয়ে। তাতে জানা গেছে, সপ্তাহে কয়েকবার এটি খেলে স্কাল্পে পুষ্টির ঘাটতি থাকে না। এতে চুল পড়া কমে। এই পাতায় থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিড, বিটা ক্যারোটিন, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ফাইটোকেমিক্যাল ত্বকের গভীরে পৌঁছায়। ফলে বলিরেখা দূর হয়, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। থানকুনির ভর্তা নিয়মিত খেলে শরীর থেকে বিষাক্ত টক্সিক বেরিয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে মধু মিশিয়ে নিতে হয়। এই পাতা ক্ষত সারাতে পারঙ্গম। পেটের সমস্যা সারাইয়েও থানকুনির সমাদর আছে। পাতাটি বদহজম ও গ্যাস-অম্বল প্রতিরোধ করে। আমাশয় হলে টানা সাত দিন থানকুনিপাতা খেলেই উপশম ঘটে। কাশির সমস্যা দূর করতে এর সঙ্গে কিছুটা চিনি মেশাতে হয়। এই পাতা কৃমিনাশী। জ্বর হলেও খাওয়া যেতে পারে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে শিউলি পাতার রসের সঙ্গে এটি মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে শারীরিক দুর্বলতাও কাটবে।
সুগন্ধি ভেষজ তৃণ ধনে। স্বাদ ও ঘ্রাণ বাড়াতে রান্নায় কিংবা স্যালাডে এর খুব কদর। স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী এটি। এতে ১১ ধরনের এসেনশিয়াল অয়েল থাকে। এগুলোর মধ্যে লিনোলেয়িক, লিনোলেনিক, স্টিয়ারিক এবং পামিটিক অ্যাসিড উল্লেখযোগ্য। এই পাতা ভিটামিন এ, সি ও কে সমৃদ্ধ। আছে থায়ামিন ও রিবোফ্লাভিনও। কিছু খনিজ, যেমন ম্যাংগানিজ, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন এবং জিংক ও ক্যালসিয়াম মেলে। প্রচুর পলিফেনল ও ফাইটোকেমিক্যাল থাকে, যা মূলত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এসব উপাদান মানুষের শরীরে মন্দ কোলেস্টেরল কমিয়ে ভালোটি বাড়ায়। ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য এটি প্রায় পথ্য। ইনসুলিনের ভারসাম্য বজায় রাখে। রক্তে সুগার কমায়। ভেষজটি ভালো মানের অ্যান্টিসেপটিক। মুখের আলসার নিরাময় করে। ঋতু¯্রাবজনিত বালাই নাশ করে। আয়রন সমৃদ্ধ, তাই রক্তস্বল্পতায়ও খাওয়া যেতে পারে তৃণটি। এই পাতায় থাকা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, বিটা ক্যারোটিন ও ম্যাঙ্গানিজ পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। এর অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি উপাদান বাতের ব্যথা সারায়। হাড় ও অস্থিসন্ধির ব্যথা উপশম করে। মগজের উন্নতিতেও কাজ করে ধনেপাতা। নার্ভ সচল রাখে, স্মৃতিশক্তি প্রখর করে তোলে। এতে থাকা ভিটামিন কে আলঝেইমার্স প্রতিরোধে সহায়ক। এর এসেনশিয়াল অয়েল ত্বকের জ্বালাপোড়া ও ফুলে যাওয়া রোধ করে। ধনেপাতায় বিষক্রিয়ারোধী উপাদান আছে। তা একজিমা, ত্বকের শুষ্কতা এবং ফাঙ্গাল ইনফেকশন সারায়। এর অ্যান্টিহিস্টামিন অ্যালার্জি থেকে সুরক্ষা দেয়। এমনকি ‘সালমোনেলা’ নামের একটি রোগের দাওয়াই আছে ধনেপাতায়। এই অসুখ সারাতে পারে ডডেনসিল উপাদান। সে ক্ষেত্রে এটি অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে। গুটি বসন্ত সারাতেও ধনেপাতা পারঙ্গম।
ঔষধি গুণে ভরা আরেকটি পাতা পুদিনা। রান্নায় এর ব্যবহার আছে। ভর্তাও করা যায়। থানকুনির মতোই এটি দেহের ভেতরে-বাইরে কাজ করে। রোদে পোড়া দাগ দূর করতে পুদিনার রস কাজে লাগে। ব্রণ দূর করার পাশাপাশি চামড়ার তেলতেলে ভাবও চলে যায়। ত্বকের দাগ অপসারণ করে। উকুন তাড়াতে পুদিনার শিকড় বেটে মাথায় মাখা যেতে পারে। সপ্তাহে দুবার এ কাজ করলে খুব দ্রুতই উপকার মিলবে। এই পাতার নির্যাস ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। বিজ্ঞানীদের দাবি, পুদিনা ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সক্ষম। কাজটি করে এই পাতায় থাকা পেরিলেল অ্যালকোহল, যা ফাইটো নিউট্রিয়েন্টসের একটি উপাদান। এটি শরীরে ক্যানসার কোষ বাড়তে দেয় না। সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে থাকলে অথবা শ্বাসকষ্টে খাওয়া যেতে পারে পাতাটি। অ্যাজমা ও কাশির সমস্যায় তাৎক্ষণিক উপশম করতে পারে এটি। এ উদ্দেশ্যে পুদিনাপাতা গরম পানিতে সেদ্ধ করে ভাপ নিতে হয়। পেটের সমস্যার নিরাময় আছে এই পাতায়। পুদিনার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্স পেটের যেকোনো সমস্যা খুব দ্রুত সারাই করতে পারে। সহনীয় গরম পানিতে এই পাতা ফেলে গোসল করলে শরীর চাঙা হয়। পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে দেহে যে দুর্গন্ধ হয়, তা-ও চলে যায়। ঘামাচি ও অ্যালার্জির সমস্যা থেকে পরিত্রাণ মেলে। এ পাতার রস নার্ভে পৌঁছাতে পারে। ফলে শরীর ব্যথার তাৎক্ষণিক উপশম হয়। পুদিনার ভর্তা খাওয়া ছাড়াও অস্থিসন্ধিতে লাগালে ব্যথা কমে।
ভেষজ গুণ আছে শজনে পাতাতেও। হাঁচি-কাশির পথ্য এটি। কচি পাতার রস নিয়মিত পান করলে ধীরে ধীরে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসে। চিকিৎসকদের মতে, শজনের পাকা পাতার রস দুবেলা খাওয়ার আগে পান করলে ব্লাড প্রেশার এক সপ্তাহের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণে আসবে। ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য দীর্ঘকাল এটি পান করায় নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে সৈন্ধব লবণের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে বহুমূত্র রোগে আরামবোধ হয়। শজনের পাতাভর্তা খেলে জ্বর কমে। আঘাতের কারণে ফোলা স্থানে এটি লাগালে আরামবোধ হবে। এই পাতা রান্না বা ভর্তা করে খেলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সর্দি সারে। মাড়ি ফুলে গেলে পাতার ক্বাথ আক্রান্ত স্থানে মেখে রাখা যেতে পারে। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ হওয়ায় অপুষ্টি ও অন্ধত্ব রোধে শজনে পাতা রাখা যেতে পারে খাবার মেনুতে। এর বড়ি অম্লরোগ সারাতেও কাজে আসে।
রেঁধে, উষ্ণ পানীয়র সঙ্গে মিশিয়ে কিংবা ভর্তা করে খাওয়া যায় ঔষধি গুণে ভরপুর এ পাতাগুলো। এ ছাড়া আছে তুলসী ও আমপাতা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আরও কিছু পাতা আছে, যা ভর্তা করে খাওয়া হয়। লাউ, চিচিঙ্গা ও ডাঁটাপাতা ভর্তা করে খাওয়ারও চল আছে।
ফুড ডেস্ক