skip to Main Content

ফিচার I সিন্ধু থেকে সৌন্দর্য

সমুদ্র হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের উপকরণের উৎস। বিখ্যাত সব ব্র্যান্ড তাই নোনাজলেই ঝুঁকেছে। কার্যকর পণ্যগুলোর উপাদান সেখান থেকেই নিয়েছে

সৌন্দর্যপণ্যে প্রাকৃতিক উপাদানের ব্যবহার বাড়ছে। ত্বক ও চুলের যত্নে সবাই বেছে নিচ্ছে এ ধরনের উপকরণ। শরীর ও প্রকৃতিতে রাসায়নিক উপাদানের বিরূপ প্রভাব কমাতে এসব বিউটি প্রোডাক্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। স্কিন ও হেয়ার কেয়ার ট্রেন্ডে নতুন সংযোজন সামুদ্রিক উপাদান। ত্বকের যত্নে এর ব্যবহার আগেও ছিল, তবে তা স্বল্প পরিসরে। ষাটের দশকে প্রথম সামুদ্রিক শেওলা ব্যবহার করে তৈরি হয় ময়শ্চারাইজার। এতে ধীরে ধীরে যোগ হয় আরও অনেক কিছু। গত দশক থেকে এ ধরনের প্রোডাক্টের ব্যবহার বেশি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে সামুদ্রিক উপাদান হচ্ছে ‘ফিউচার অব স্কিন কেয়ার’।
সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপাশি ত্বক ও চুলের নানা সমস্যার দাওয়াই হিসেবেও সামুদ্রিক উপাদান অনেক কার্যকর। এখন অ্যালজি বা সামুদ্রিক শেওলা, মুক্তা, মাছের ডিম, লবণ, মেরিন স্পঞ্জ, হাঙর, জেলি ফিশ, কোরাল, সামুদ্রিক কচ্ছপ, ঝিনুক ইত্যাদি সৌন্দর্যপণ্য হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি কাজে আসছে সমুদ্রের পানি।

সামুদ্রিক শেওলা
বহু বছর আগে থেকে জাপানিরা ত্বকচর্চায় সিউইড বা সামুদ্রিক শেওলা ব্যবহার শুরু করে। জরিপে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে আমেরিকার ৪০ শতাংশ মিলেনিয়াল এমন স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট কিনেছে। পৃথিবীতে প্রায় ৫০ হাজার প্রজাতির সিউইড আছে। এগুলোর মধ্যে অন্তত একশ প্রজাতি ব্যবহৃত হচ্ছে নানা রকমের স্কিন ও হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টের প্রধান উপকরণ হিসেবে। উল্লেখযোগ্য হলো ব্লু, রেড, ব্রাউন অ্যালজি, কেল্প, সি স্প্যাগেটি, ব্ল্যাডার র‌্যাক ইত্যাদি। সিউইডে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি এলিমেন্ট। এর ভিটামিন ই ত্বক হাইড্রেট করে, ভিটামিন বি, সি আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট স্কিন পিগমেন্টেশন কমায়। সিউইডের অ্যামাইনো অ্যাসিড খুব ভালো অ্যান্টিএজিং প্রোপার্টি। এর ভেতরের খনিজ উপাদান যেমন ওমেগা, জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়াম পরিবেশদূষণের ফলে ত্বকের যে বিরূপ প্রভাব পড়ে, তা কাটাতে সাহায্য করে। এ উপাদানগুলো ব্রণ ও রোজেশিয়ার নিরাময় করে। সব ধরনের ত্বকের জন্য এটি উপকারী। হাইড্রেটর, ময়শ্চারাইজার, ব্রাইটনার, অ্যান্টিএজিং ক্রিম সিরাম, মাস্ক, এক্সফোলিয়েটর- সবকিছুতে এর ব্যবহার হচ্ছে। চুলের যত্নেও সিউইড খুব ভালো একটি উপাদান। এতে থাকা ভিটামিন এ, সি, ওমেগা, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম চুল পড়া কমিয়ে নতুন চুল দ্রুত লম্বা ঘন ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করে।

মুক্তা
শুধু গয়না নয়, এটি এখন সৌন্দর্যপণ্যও। ত্বকের যত্নে বা রূপচর্চায় মুক্তার ব্যবহার নতুন নয়। হাজার বছর আগে চীনা আয়ুর্বেদিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। চীনা আর জাপানি সম্ভ্রান্ত বংশের নারীরা ত্বক ফর্সা করতে মুখে মুক্তার পাউডার লাগাত। চীনাদের মতে এই পাউডার ডিটক্সিফায়ার, আর আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে এটি মারাত্মক বিষের প্রতিষেধক। এখন অনেক স্কিন ব্রাইটনার ক্রিমের প্রধান উপাদান হচ্ছে মুক্তা। এর রয়েছে অ্যান্টিএজিং বেনিফিট। এক্সফোলিয়েন্ট, হাইড্রেটর, ময়শ্চারাইজার, ক্লিনজার, ফেস মাস্ক, অ্যান্টিএজিং ও ব্রাইটেনিং সিরাম- সবকিছুতেই এটি কাজে লাগানো হচ্ছে। মুক্তায় রয়েছে হিস্টিডাইন, আরজিনিন, টাইরোসিন, গ্লুটামিক অ্যাসিডের মতো অ্যামাইনো অ্যাসিড। এগুলো ত্বকে কোলাজেন উৎপাদন ও সেলুলার মেরামত করে। দূষণ আর ক্ষতিকর উপাদান থেকে বাঁচায়। এর ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম ময়শ্চারাইজার বৃদ্ধির পাশাপাশি সিবাম এবং সেল টার্নওভার নিয়ন্ত্রণ করে। মুক্তায় আছে ক্যালসিয়াম কার্বনেট ও ম্যাগনেশিয়াম কার্বনেট- দুটোই প্রাকৃতিক এক্সফোলিয়েটর। এর সিগন্যাল প্রোটিন হলো অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি উপাদান। এগুলো ব্রণ কমায় এবং নতুন করে তা হতে দেয় না। মুক্তার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের বার্ধক্য ঠেকাতে সহায়ক। অনেক সানস্ক্রিন লোশন বা ক্রিমে এটি ব্যবহার করা হয়। এর অ্যামাইনো অ্যাসিড ও খনিজ উপাদান সূর্যের ক্ষতিকর ইউভি রশ্মির বিরুদ্ধে শিল্ড হিসেবে কাজ করে।

ফিশ রো বা ক্যাভিয়ার
স্কিন ও হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্টে এখন মাছের ডিমও ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে স্যামন মাছের ডিম আর ক্যাভিয়ার। স্যামন মাছের ডিমে যে এনজাইম আছে, তা একধরনের প্রাকৃতিক ও মৃদু এক্সফোলিয়েটর। এই এনজাইম ত্বকের উপরের অংশ থেকে মরা চামড়া দূর করে লালচে ভাব ও ইনফ্ল্যামেশন কমায়।
ক্যাভিয়ার ত্বক আর চুলের জন্য বিশেষ উপকারী। এর নির্যাস অতি বেগুনি রশ্মি প্রতিরোধী ও আর্দ্রতা সহায়ক উপাদানে ভরপুর। এটির ব্যবহারে স্কাল্পের সুরক্ষিত থাকে। এতে রয়েছে জিঙ্ক, যা চুলকে গোড়া থেকে মজবুত করে। এ জন্য অনেক শ্যাম্পু ও কন্ডিশনারে ক্যাভিয়ারের ব্যবহার দেখা যায়। এতে আছে ওমেগা থ্রি ও ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড। এগুলো ত্বক উজ্জ্বল ও ময়শ্চারাইজ করে। সূর্যের অতি বেগুনি এ ও বি রশ্মির ফলে কোলাজেন ও ইলাস্টিনের ভাঙন ঘটে। এতে ত্বকে রিঙ্কেল ও ফাইন লাইন দেখা দেয়। ক্যাভিয়ারের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এ ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে ত্বককে রক্ষা করে। অ্যান্টিএজিং ক্রিম ও স্কিন গ্লোয়িং ময়শ্চারাইজার ক্রিমে ক্যাভিয়ার ব্যবহার করা হয়।

লবণ
শত বছর ধরে সামুদ্রিক লবণ ডিটক্সিফায়ার বা স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়ামের মতো অনেক খনিজ উপাদান ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান ব্রণের সমস্যা দূর করে। ভালো প্রাকৃতিক এক্সফোলিয়েটর হিসেবে কার্যকর। ত্বকের ময়লা, টক্সিন শোষণ ও স্কিন পোর গভীরভাবে পরিষ্কার করে। বাথ সল্ট হিসেবেও এটি ব্যবহার করা যায়। এর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণাগুণ স্ক্যাল্পের খুশকি, র‌্যাশ, তৈলাক্ত ভাব দূর করে। তাই এখন খুশকি নাশক শ্যাম্পুতে লবণের ব্যবহার দেখা যায়।

কোরাল
সৌন্দর্যপণ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে কোরাল পাউডার। এতে রয়েছে ৭৪টির মতো খনিজ উপাদান। বেশি আছে ক্যালসিয়াম কার্বনেট। এটি প্রাকৃতিক এক্সফোলিয়েটর। এর খনিজ উপাদানে তৈরি হয় অ্যান্টিএজিং ও ময়শ্চারাইজার, অ্যান্টিঅ্যাকনে ক্রিম। এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল প্রোপার্টি। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে বুড়িয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। ক্ষতিকর ফ্রি র‌্যাডিকেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কোরাল পাউডার দিয়ে স্কিন সফটনার ক্রিম, লিপস্টিক ও ডিওডোরেন্ট তৈরি হচ্ছে।

সি শেল
হাজার বছর ধরে রূপচর্চায় সি শেলের ব্যবহার হয়ে আসছে। এখন সহজলভ্যতার জন্য এটির সাহায্যে অনেক স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট, বিশেষ করে অ্যান্টিএজিং, ব্রাইটেনিং, অ্যান্টিঅ্যাকনে ক্রিম তৈরি হচ্ছে। সি শেলের পাউডার মাস্ক হিসেবে পাওয়া যায়। এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়াম। ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে এই ভিটামিন বিশেষ সহায়ক। বলিরেখাও কমাতে পারে এটি। এর মলিকুল অনেক সূক্ষ্ম, তাই ত্বকের গভীরে ঢুকে স্কিন পোর পরিষ্কার করে। এতে ব্রণ হওয়ার আশঙ্কা কমে।

সি হাইড্রা
সৌন্দর্যপণ্যে বহুল ব্যবহৃত সামুদ্রিক উপাদান। এতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রোটিন। লিপ কেয়ার প্রোডাক্ট, লিপ গ্লস, লিপস্টিক তৈরিতে হাইড্রা ব্যবহৃত হয়। ডিপ ক্লিনজিং, মেকআপ রিমুভারে কাজে লাগে। এতে আছে ভিটামিন সি এবং ই। তাই সানস্ক্রিন লোশন ও ময়শ্চারাইজার ক্রিমে হাইড্রার ব্যবহার দেখা যায়।

ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন
এর নির্যাস লিপিড এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডে সমৃদ্ধ। এগুলো কোষ মেরামত, ইলাস্টিসিটি ও কোলাজেন বাড়ায়। বলিরেখা কমায়। ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। তাই ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন স্কিন টোনিং, হোয়াইটেনিং, অ্যান্টিএজিং প্রোডাক্টে বেশি ব্যবহৃত হয়।

সি ফেনেল
এতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন এ, সি ও ই। এটি বলিরেখা রোধ করে। পরিবেশদূষণ, অ্যালকোহল, ধূমপানের ফলে ত্বকে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তা কমাতে সহায়ক। সি ফেনেল ত্বক রিজুভিনেট করে। এতে তৈরি স্কিন রিপেয়ারিং ক্রিম।

জেলি ফিশ
অনেক কসমেটিক প্রোডাক্ট তৈরিতে জেলি ফিশের মিউকাস ফর্ম ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে অ্যান্টিএজিং পণ্যে। এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উৎস। এর প্রোটিন, কোলাজেন ও গ্লাইকোপ্রোটিনের হাইড্রেটর হিসেবে কাজ করে। জেলি ফিশের নির্যাসে তৈরি হাইড্রেটিং কোলাজেন বুস্ট মাস্ক, অ্যান্টিএজিং ক্রিম, সিরাম এখন বেশ জনপ্রিয়।

হাঙর
হাঙরের কলিজার তেল স্কুয়ালিন নামে পরিচিত। এতে তৈরি হয় ময়শ্চারাইজার, সানস্ক্রিন, লিপস্টিক ও আই মেকআপ প্রোডাক্ট। হাঙর আর স্কুয়ালিনে আছে অনেক ময়শ্চারাইজিং প্রোপার্টি। এ ছাড়া ডিওডোরেন্ট, পারফিউম, লিপ বাম, শ্যাম্পুতেও স্কুয়ালিন পাওয়া যায়।

সামুদ্রিক কচ্ছপ
ত্বকের সৌন্দর্য বাড়াতে সামুদ্রিক কচ্ছপও কাজে লাগানো হচ্ছে। অনেক আগে থেকে আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা ত্বকের যত্নে কচ্ছপের নির্যাস ব্যবহার করে আসছে। ত্রিশের দশকে ফ্রান্স ও জার্মানিতে এই নির্যাস বা সিরাম ব্যবহার করে স্কিন কেয়ার ক্রিম তৈরি করা হয়েছিল। তবে তা বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা সফল হয়নি। এটি ভিটামিন ই সমৃদ্ধ। এই তেল দিয়ে এখন নানা রকমের কসমেটিক প্রোডাক্ট, সাবান, বডি লোশন, ফেস ক্রিম, নেইল ক্রিম তৈরি হচ্ছে।

সমুদ্রে পানি
বাদ যাচ্ছে না সমুদ্রের পানিও। এতে আছে ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, সেলেনিয়ামের মতো খনিজ উপাদান। এগুলো খুব ভালো ডিটক্সিফায়ার, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি। ব্রণ, একজিমার মতো চর্মরোগ প্রতিরোধে সমুদ্রের পানি বেশ কার্যকর। লবণ থাকার জন্য এটি এক্সফোলিয়েটর হিসেবে কাজ করে। অনেক স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টে এর ব্যবহার দেখা যায়। চুলের ড্যামেজ দূর করার ক্ষমতা রাখে এটি। তাই হেয়ার থেরাপি প্রোডাক্টেও এর ব্যবহার হচ্ছে।
পশ্চিমের অনেক নামী সৌন্দর্যপণ্যের ব্র্যান্ড সামুদ্রিক উপাদান ব্যবহারে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পথিকৃৎ জার্মানির লাক্সারি কসমেটিক ব্র্যান্ড লা মের। ষাটের দশকে এরাই প্রথম সামুদ্রিক শেওলা বা ব্লু অ্যালজি ব্যবহার করে ময়শ্চারাইজার ক্রিম তৈরি করে। এই ব্র্যান্ডের সব স্কিন কেয়ার প্রোডাক্টে ব্যবহৃত হচ্ছে শেওলা আর মুক্তা। এ ছাড়া বিখ্যাত এথিক্যাল কসমেটিক ব্র্যান্ড দ্য বডি শপ, গুপ, আহাভা তাদের প্রোডাক্টে সামুদ্রিক উপাদান ব্যবহার করছে।

 ফাহমিদা শিকদার
মডেল: লিসা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top