ফিচার I কার্ভিং ডিশ
খাবারের উৎসবসম্মত উপস্থাপনা। এমনভাবে সাজানো- দেখে মনের তৃষ্ণাও মেটে
‘বিয়েবাড়ি’ শব্দটা শুনলেই চোখে ভাসতে থাকে জিভে পানি আসা বিভিন্ন রকমের খাবার। ভোজনরসিক থেকে শুরু করে প্রায় সবাই বিয়েবাড়ির পদ খেতে পছন্দ করে। তবে এখন বরযাত্রী কিংবা অন্য অতিথিদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য খাবার সাজিয়ে পরিবেশনও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, পরিবেশন দৃষ্টিনন্দন হলে খাওয়ার আগ্রহ অনেক গুণ বেড়ে যায়। এ জন্য সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি তার নকশাও হতে হয় আকর্ষণীয়।
একসময় পরিবার অথবা আত্মীয়দের মধ্যে যারা রন্ধনে দক্ষ ছিল, বিয়ের রান্না এবং খাবার পরিবেশন তারাই করত। ধীরে ধীরে প্রচলন হয় বাবুর্চির। তারা রান্নার পর পেঁয়াজ বেরেস্তা, টমেটো সস কিংবা ডিজাইন করে শসা-গাজর আর লেবু কেটে তা খাবারের উপর বিছিয়ে পরিবেশন করত। সেই সময়টাও পেছনে ফেলে এখন বিয়েবাড়ির খাবারের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টার, রেস্টুরেন্ট, ক্যাটারিং সার্ভিস বা ওয়েডিং প্ল্যানারদের। কেউ কেউ আবার এসবের বাইরেও শুধু খাবার ডেকোরেশনের দায়িত্ব দেন ফুড কার্ভিং আর্টিস্টদের। তারা নানা রকম থিম অথবা ফাইভ স্টার হোটেলের মতো খাবার সাজিয়ে পরিবেশন করে।
বিয়ের প্রায় অনুষ্ঠানই এখন নির্দিষ্ট থিম অনুযায়ী সাজানো হয়। স্টেজ, পোশাক থেকে খাবার পরিবেশনও। গায়েহলুদে বর-কনের সাজপোশাক, মঞ্চসজ্জা চলে নির্দিষ্ট রং ও থিমের ওপর ভিত্তি করে। খাবারের বৈচিত্র্য দেখা যায় হলুদের আয়োজনেও।
গায়েহলুদের স্টেজে বর অথবা কনের সামনে সাজিয়ে রাখা হয় নানান ধরনের ফল, মিষ্টান্ন, পিঠা-পুলি, কেক, খই, মুড়ি, কাবাব, চকলেট, পান-সুপারি, রংবেরঙের পানীয়। পাত্রে রাখা খাবার ও ফলমূল, যেমন- শসা, গাজর, পেঁপে, ডিম, তরমুজ, স্ট্রবেরি, আপেল, কমলা, আঙুর কখনো কেটে বিভিন্ন কার্ভিং করা হয়। এতে পরিবেশন হয়ে ওঠে কালারফুল এবং আকর্ষণীয়। এসব খাদ্য ওঠানোর জন্য থাকে টুথপিক।
আবার কনের বাড়িতে বরপক্ষের অতিথিদের আপ্যায়নে থাকে নানা আয়োজন। বরের জন্য বিভিন্ন স্বাদ ও রঙের শরবত। বরযাত্রীদের আপ্যায়নেও থাকে রঙিন পানীয়। অতিথিদের খাওয়ার টেবিলে রাখা হয় ছোট ছোট বাটিতে সুস্বাদু অ্যাপেটাইজার। ডিজাইন করে কাটা শসা, গাজর, টমেটো আর পেঁয়াজ। মাছ, পাতা, পাখি বা ফুলের আকৃতিতে সাজানো হয়। এর পাশাপাশি মিষ্টির পদ- জর্দা, ফিরনি, দই, সন্দেশ আলাদা করে সাজিয়ে রাখা হয়। মূলত মিষ্টান্নগুলো ডালিম, বাদাম, মোরব্বা অথবা চেরি দিয়ে নকশা করা হয়।
বরের ট্রে সাজানো হয় একেবারেই ভিন্নভাবে। এতে বরাদ্দ থাকে আস্ত খাসির রোস্ট। প্রধান খাবারসহ নানান ধরনের পিঠাও। এ ছাড়া ডিম কেটে শিউলি ফুল, গাজরের গোলাপফুল, মাছের কাবাবের প্রজাপতি, হালুয়া কেটে সূর্যমুখী, আপেল দিয়ে হাঁস, কাবাব বলের মধ্যে সবুজ পাতা, রোস্ট কিংবা রেজালার উপর বাদাম, বেরেস্তা, নারকেলকুচি আর কিশমিশ দিয়ে হয় দৃষ্টিনন্দন সজ্জা।
ময়ূরের আদলে পেঁপে কেটে তার ওপর বসানো হয় ছোট ছোট কালো আঙুর। আলাদা ট্রেতে কিছু কমলা দিয়ে, এরপর তাতে একে একে সবুজ আপেল, লাল আপেল, ড্রাগন ফল, সবুজ ও কালো আঙুর, স্ট্রবেরি, আম, চেরি বা মাঝখানে ডালিম রেখে তৈরি করা হয় ভিন্ন একটি ফলের কার্ভিং ডিশ। এটি গায়েহলুদের অনুষ্ঠান থেকে বউভাত পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
বউভাতে অতিথি আপ্যায়নে প্রতিটি টেবিলের খাবার পরিবেশনের রীতিতে রয়েছে ভিন্নতা। বাঙালির বউভাত মানেই কবজি ডুবিয়ে খাওয়া। পোলাও, কাচ্চি, মুরগির রোস্ট, কোরমা, কাবাব, চিংড়ির মালাইকারি, ফিশ ফ্রাই, রেজালা, সবজি, চাটনি, বিভিন্ন পদের স্যালাড আর বোরহানির সঙ্গে থাকে কোমল পানীয়। এসব খাবার পরিবেশনের কেতাও রয়েছে। পোলাওয়ের উপর বাদাম, বেরেস্তা আর কিশমিশ ছিটিয়ে; কাচ্চিতে সেদ্ধ ডিম কেটে ছোট ছোট ফুল অথবা ডিমের দুই পাশে লবঙ্গ দিয়ে চোখ, কোরমায় ধনেপাতা কিংবা পুদিনাপাতা, কাবাবের ট্রেতে লেটুস পাতা, মুরগির রোস্টে ডালিম, চেরি আর বেরেস্তার সজ্জা দেখা যায়।
মূল খাবারের শেষে মিষ্টান্ন হিসেবে থাকে দই, পায়েস, জর্দা, শাহি টুকরা, মিষ্টি। মিষ্টান্নের আইটেমগুলো সাজানো হয় কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, কিশমিশ, কুমড়ার মোরব্বা, গুঁড়া মিষ্টি, চেরি, ডালিম আর কালো আঙুর দিয়ে। আবার স্যালাডের প্লেটে রাখা যায় রঙের বাহার। এমনকি সবজির ওপরও টমেটো দিয়ে তৈরি করা হয় ফুল। পুদিনাপাতা আর ধনেপাতা দিয়ে সবুজ রঙের কন্ট্রাস্টও দেখা যায়। কোথাও কোথাও পানের আয়োজন থাকে। এটি দিয়ে বানানো হয় পান বিবি। এতে চেরি দিয়েও ডিজাইন করে অনেকে।
সময়ের সঙ্গে মানুষের খাবার-সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। বাঙালি জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। বিয়ে-বউভাতের ভোজেও তার প্রভাব পড়েছে। এখন বাঙালির বিয়েতে ভাড়া বাড়ি কিংবা কমিনিউটি সেন্টারই ভরসা। রান্না কিংবা খাবার সাজানোর দায়িত্ব পড়ে ক্যাটারিং, ওয়েডিং প্ল্যানার অথবা ফুড কার্ভিং আর্টিস্টদের ওপর।
ইতি আফরোজ
ছবি: ইন্টারনেট