রূপরসদ I নির্যাসে সুন্দর
ফুলের কান্ড, বৃন্ত, পাপড়ি, পাতা থেকে পাওয়া। অ্যাকনে হোক বা এজিং- সব ধরনের ত্বকসমস্যা সারাইয়ের দারুণ দাওয়াই। জানাচ্ছেন জাহেরা শিরীন
প্রকৃতিকে বলা হয় বিশ্বের সেরা কেমিস্ট। যার মধ্যে ফুল উল্লেখযোগ্য। কারণ, এতে থাকা ন্যাচারাল হিলিং ফর্মুলেশন আর পোটেন্ট অ্যাকটিভস। রূপচর্চায় এর ব্যবহার শুরু হয় প্রাচীন ইজিপ্সিয়ানদের হাত ধরে। সে সময় গোলাপ আর জিরানিয়াম ফুলের নির্যাস দিয়ে এসেনশিয়াল অয়েল তৈরির তথ্য রয়েছে নৃবিজ্ঞানীদের কাছে। আনফ্লেরাজ প্রক্রিয়ায় সারা হতো নিষ্কাশনের কাজ। ফুলের বিভিন্ন অংশ তেলে ডুবিয়ে। এখন এর নির্যাস সংগ্রহের জনপ্রিয় পদ্ধতি স্টিম ডিস্টিলেশন। হট স্টিমের মাধ্যমে ফুলের তেল, পুষ্টি আর তরল নির্যাস বেরিয়ে যায় নিমেষেই। তা থেকেই তৈরি হয় দামি সব এসেনশিয়াল অয়েল। প্রাকৃতিক পরিপোষকে ভরপুর। পরিবেশদূষণ, আবহাওয়ার বিভিন্নতা আর ক্ষতিকর সূর্যালোক থেকে ফুল তার কাঠামো সুরক্ষিত করতে বায়োডাইভারসিটি সম্পন্ন মলিকিউল উৎপন্ন করে। এসব ফ্লাওয়ার মলিকিউল থেকে তৈরি হয় হরেক রকমের স্কিন কেয়ার ফর্মুলেশন, যেগুলো ব্যবহৃত হয় ত্বকচর্চার নানা পণ্য তৈরিতে। স্কিন কেয়ার প্রডাক্টগুলোর ইনগ্রেডিয়েন্ট লেবেলে সেসবের দেখা মেলে। ফ্লোরাল এক্সট্র্যাক্টগুলোর আইএনসিআই (ইন্টারন্যাশনাল নোমেনক্লেচার অব কসমেটিক ইনগ্রেডিয়েন্টস) নামকরণগুলোই চোখে পড়বে তালিকায়। ফুলগুলোর সায়েন্টিফিক নামের সঙ্গে অ্যালাইন করে রাখা হয় এসব নাম। ইতিমধ্যে প্রায় ২৮ হাজার আইএনসিআইয়ের নাম প্রকাশ করেছে পার্সোনাল কেয়ার প্রডাক্ট কাউন্সিল, যা এফডিএ অ্যাপ্রুভড। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছয়টি ফ্লাওয়ার এসেনশিয়াল অয়েল ত্বকচর্চায় সবচেয়ে বেশি সমাদৃত।
হিবিসকাস
আইএনসিআই নাম হিবিসকাস স্যাবডারিফা। বাংলায় জবা নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীদের মতে, এ ফুলগাছের প্রাণশক্তি এত বেশি যে ১০০ দিনে এটি ৫০০০ এর অধিক ফুল ফোটাতে সক্ষম। এই প্রাণশক্তি পরীক্ষা করতে গিয়েই জবা ফুলের কান্ডের বাইরের আবরণে মেলে দারুণ সক্রিয় ময়শ্চারাইজিং সাবস্টেন্স, যা ত্বকের যত্নে খুব উপকারী। জরুরি আর্দ্রতা জোগানোর পাশাপাশি ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতার আস্তরণকে শক্তিশালী সুরক্ষা দিতে দারুণ কার্যকর। এ ছাড়া সম্প্রতি জবা থেকে মিলেছে নতুন ধরনের ফ্লোরাল এসেন্স, যাতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের এক্সফোলিয়েটিং অ্যাসিড, যেমন পাইরুভিক অ্যাসিড। এটি হাইপারপিগমেন্টেশনকে হালকা করতে সাহায্য করে। কোলাজেন উৎপাদনের মাত্রা বাড়ায়। ত্বকের ইলাস্টিসিটি ধরে রাখে দীর্ঘ সময়। অকালে বুড়িয়ে যাওয়া সমস্যা সমাধান করে।
রোজ
রোজা দামাসিনা এর আইএনসিআই নাম। বাংলায় গোলাপ। এর পাপড়িতে পাওয়া যায় দুর্লভ ইমোলিয়েন্ট অয়েল, যা ত্বকে আর্দ্রতা জোগায়। মসৃণতা বাড়ায়। উজ্জ্বল করে তোলে কয়েক গুণ। ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা সুরক্ষিত করে। এ ছাড়া ত্বক কোষগুলোর মাইক্রোসার্কুলেশনে সাহায্য করে। ফলে ডিটক্সিফিকেশনের মাত্রা বাড়ে, দ্রুত সারে ত্বকের সমস্যা। লালচে ভাব সারাতে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণও রয়েছে গোলাপে, যা শুষ্ক এবং স্পর্শকাতর ত্বকের যত্নে খুব উপকারী।
ল্যাভেন্ডার
আইএনসিআই অনুসারে এর নাম ল্যাভান্ডুলা অ্যানগাস্টুফোলিয়া। ২৫০০ বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসা এই ফুল ত্বকচর্চায় সবচেয়ে বেশি কার্যকর। কসমেটিক কেমিস্টদের কাছে ‘ডু ইট অল ফ্লাওয়ার’ হিসেবে পরিচিত ল্যাভেন্ডার। ব্রণ উৎপাদনকারী জীবাণু ধ্বংস এবং ক্ষত সারাতে সাহায্য করে। ব্রণ হওয়ার সংক্রমণ থেকেও সুরক্ষিত করে। ত্বকের তেল উৎপাদনের হার নিয়ন্ত্রণে সক্ষম। কমায় লালচে ভাব। ত্বকে প্রশান্তি জোগায়। তবে ল্যাভেন্ডার এসেনশিয়াল অয়েলে অ্যালার্জেন থাকে। তাই প্রথম ব্যবহারের আগে প্যাচ টেস্ট জরুরি।
ক্যামোমিল
ম্যাট্রিকারিয়া ক্যামোমিলা এর আইসিআইএন নাম। ত্বকচর্চায় বহুল ব্যবহৃত, নির্ভরযোগ্যও। ডেইজি গোত্রীয় ফুলটি মূলত হার্ব প্রজাতির। এর অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণের জন্যই জনপ্রিয়। ত্বককে ঠান্ডা রাখে, বাঁচায় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে। ক্ষত সারাইয়ে জাদুকরী ক্যামোমিল এক্সট্র্যাক্ট। সারায় ত্বকের লালচে ভাব। নিয়মিত ব্যবহারে দাগছোপ দূর করে। এতে থাকা বিসাবোল নামের কম্পাউন্ড ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতেও সক্ষম। সাধারণত জার্মান ক্যামোমিলে মেলে এ যৌগ। তাই ত্বকচর্চার পণ্যগুলোতে এর উপস্থিতি নিশ্চিত করে নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধান। নিয়মিত ব্যবহারে সৌন্দর্যও বাড়ে।
ক্যালেন্ডুলা
ক্যামোমিলের মতোই ডেইজি গোত্রীয়। উজ্জ্বল কমলা এবং হলুদ গাঁদা ফুলের থেকে সৃষ্ট। আইএনসিআই নাম ক্যালেন্ডুলা অফিসিলানিস। এর নির্যাস থেকে তৈরি তেল ত্বকের ক্ষত সারাইয়ে সাহায্য করে। রোজাশিয়া আর একজিমার ফলে ত্বকে সৃষ্ট জ্বালাপোড়া ও ফোলা ভাব দূর করে। টোন আর ময়শ্চারাইজ করতেও সাহায্য করে। এই ফুলের নির্যাসের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বককে ফ্রি র্যাডিক্যালের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষিত করে। অক্সিডেটিভ ড্যামেজও সারায়।
লোটাস
ত্বকের যত্নে এর পাপড়ি, কান্ড, বীজ, শিকড়- সবই উপকারী। আইএনসিআই নাম নিমফিয়া কেরুলিয়া। বাংলায় পদ্ম হিসেবেই পরিচিত। ক্লিনিক্যাল কসমেটিক টেস্টিংয়ে এতে পাওয়া গেছে হাই লেভেল পলিফেনল, যা শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এর কাজ ফ্রি র্যাডিক্যালের ফলে ত্বকে সৃষ্ট বলিরেখা সারাই। তাই অ্যান্টি এজিং স্কিন কেয়ার প্রডাক্টে পদ্মের নির্যাস বহুল ব্যবহৃত। পদ্মপাতার নির্যাস ত্বকের ডিটক্সিফায়িং মেকানিজমকে সচল রাখতে সাহায্য করে। তাই ত্বক পরিষ্কারক পণ্যে যেমন ক্লিনজারে এর ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়।
মডেল: অর্পিতা
ছবি: জিয়া উদ্দিন
মেকওভার: পারসোনা