skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I মায়াময় জলের হাতছানি

পান্না-সবুজ জলরাশি আর সাদা বালির সৈকত। ফিলিপাইনে। সেখানে রোমাঞ্চকর বিনোদন। লিখেছেন ফাতিমা জাহান

প্লেনের জানালা দিয়ে যত দূর দেখা যায়, নিচে পুরোটাই পান্না-সবুজ জলরাশি। ফিলিপাইনে যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুধু সবুজ আর নীল জলাধার। যেন রত্নভান্ডারের সব নীলা এবং পান্না এখানে জমা করে রেখেছে কোনো রাজাধিরাজ। আর এই ঐশ্বর্য উদারভাবে মেলে ধরতে একটুও কার্পণ্য করেনি প্রকৃতি। এখানকার সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপ বোরাকায় আইল্যান্ড। সে রকমই জেনে এসেছে জগৎবাসী আদিকাল থেকে।
প্লেন যখন ল্যান্ড করছিল, মনে হলো ঝপাৎ করে সেটা যেন সাগরের বুকে ডুব দেবে। কল্পনার রেশ কাটার আগেই ল্যান্ড করল পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট এয়ারপোর্টে। ভেবেছিলাম, প্লেন নড়াচড়া করার মতো জায়গাও নেই এখানে। তাই সেই ভাবনা। লাগেজ ক্লেইমিং বেল্ট বলতে কিছুই নেই। কর্মীরা প্লেনের পেট থেকে লাগেজ বের করে হাতে হাতে যাত্রীদের দিয়ে দিচ্ছে। বেশ মজার ব্যাপার! অবশ্য ম্যানিলা এয়ারপোর্টে পুরো নিয়মকানুন মেনে তবেই লাগেজ সঁপে দিতে হয়েছিল গ্রাউন্ড স্টাফদের হাতে। এয়ারপোর্ট বলতে একচিলতে ছোট ভবন। বের হয়ে এলে চোখ জুড়িয়ে দেবে অপার নীল জলরাশি। এত নীল দেখলে দুপুরের কড়া রোদেও একধরনের ঠান্ডা অনুভূতি হয়।
মূল বোরাকায় শহরে যাব কীভাবে? একমাত্র জলপথ ছাড়া আর কোনো মাধ্যম তো দেখছি না। এখন যদি কেউ বলে নৌকা বা জাহাজের বদলে সাঁতরে পার হতে হবে তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর, তাহলেও অবিশ্বাস করার কিছুই নেই।

এক কোনায় একটি অফিস আছে। বিদেশি ভ্রমণার্থীদের সেখান থেকে হাতে সিল নিয়ে বোরাকায় আইল্যান্ডে প্রবেশ করতে হয়।
দুই মিনিটের মধ্যে সিল মারার কাজ সম্পন্ন হলে চড়ে বসলাম একটি অনুচ্চ বোটে। এটা ঠিক স্পিডবোটের মতো নয়, আবার খুব বড়ও নয়। শক্ত প্লাস্টিকের তৈরি ছাউনি দেওয়া বড় আকারের স্পিডবোট বলা যেতে পারে। প্লেনের সহযাত্রী জেমস বেশ সাহায্য করেছে এ ব্যাপারে। অবশ্য ফিলিপিনো মানুষজন সবাই কমবেশি ইংরেজি জানে। তাই চলাফেরায় বিশেষ অসুবিধা হয়নি।
বোট দুলে দুলে ইঞ্জিন চালিয়ে চলা শুরু করল। উত্তাল সাগর। যাত্রীসংখ্যা আট। উল্টে যাই যাই করে বোট। সারেং ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার জীবনে বোট উল্টে যাওয়ার মতো কোনো অ্যাডভেঞ্চার ঘটেনি?’ জবাব না দিয়ে সে হাসতে লাগল। বুঝলাম, এমন ঘটনা অমূলক নয়। তাহলে আর কী করা, সাঁতারই ভরসা। কিন্তু সে সুযোগ না দিয়ে বোট নোঙর বাঁধল তীরে।
এখন কাজ হোটেল খুঁজে বের করা। অনলাইনে বুক করে রেখেছিলাম। পিক সিজন, আগে থেকে ব্যবস্থা না করলে সাগরপাড়ে তারাভরা রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘুমাতে হবে, সঙ্গে মুফতে সূর্যোদয় দেখার সুযোগ, তা-ও আবার চোখ খুলতেই। অবশ্য সেটিও কম অ্যাডভেঞ্চারের নয়। তবু ভাবলাম, হোটেলই বুক করি। সাগরপাড়ে থাকার ভিন্ন নিয়মকানুন আছে বিভিন্ন দেশে, সেসব না জেনে সমুদ্রের কাছ থেকে বিতাড়িত হতে চাই না।
বোরাকায় শহরে ষোড়শ শতাব্দীতে জনসংখ্যা ছিল মাত্র এক শ জন। কৃষিকাজ আর ছাগল পালন ছিল তখন একমাত্র জীবিকা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বিদেশি পর্যটকেরা এই দ্বীপ আবিষ্কার করে। তখন থেকেই এটি হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দ্বীপগুলোর একটি। এলাকাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য সরকার বছরে ছয় মাস বন্ধ রাখে। বাকি সময় ভ্রমণার্থীরা পায়ের ছাপ এঁকে দেয় সমুদ্রের সাদা তটে। দ্বীপটি আকর্ষণীয় গন্ধরাজ ফুলের মতো সাদা সৈকতের জন্য।
হোটেলে পৌঁছে মন ভরে গেল। বারান্দা দিয়ে রোদে চিকচিক সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। জল টলোমলো সজল আঁখি নিয়ে সমুদ্র তখন দুপুরের গান গাইছে। ঢেউ হয়ে গেছে রুপোর পাত।
এই রুপালি জগৎ আগামী তিন দিন দেখতে পারব। কিন্তু এখন খুঁজে বের করতে হবে রেস্টুরেন্ট। প্লেন থেকে সরাসরি সাগরে লাফ দেওয়ার উত্তেজনায় খাবারের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ফিলিপাইনে এখন অবধি খাওয়া-দাওয়ায় কোনো অসুবিধে হয়নি। যেখানেই গিয়েছি অজ¯্র খাবার থেকে দেশি স্বাদের চিকেনকারি বা ফিশ ফ্রাই ঠিকই আলাদা করতে পেরেছি। আমার হোটেলটা একটা রেস্টুরেন্টের পাশেই। ঢুকেই দেখি এখানকার বিখ্যাত গ্রিলড ফিশ এরাই তৈরি করে। একমুহূর্ত না ভেবে অর্ডার দিয়ে দিলাম। ফিলিপাইনের প্রধান খাদ্য ভাত। অন্যান্য পদও পাওয়া যায়, আর থাকে এক বাটি স্বচ্ছ স্যুপ। কিছু খাবার রান্নার পদ্ধতি আমাদের দেশের মতো, মুরগির মাংসের ঝোল আলু দিয়ে রান্না, আর সবজির আইটেমে কাঁচা কাঁঠালের তরকারিও ছিল। স্বাদও দেশের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মাছ, ভাত খেয়ে বেশ খুশিমনে হোয়াইট বিচের দিকে এগোতে থাকলাম। এটি এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত সমুদ্রসৈকত। দ্বীপটি সাত কিলোমিটার বিস্তৃত। হেঁটেই পাড়ি দেওয়া যায় সমুদ্রতট ধরে, মাঝে অবশ্য সাগর সবুজ জলের মালা পরিয়ে রাখে, তাই একেকটা দ্বীপে যেতে হয় বোটে চড়ে।
তখনো সূর্য পশ্চিমে হেলে যায়নি। সমুদ্রসৈকতে সাদা বালির বিছানা পান্না সবুজ রঙের জাল বিছিয়ে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। তীরে অগুনতি নারকেল বাগান। একটা নারকেল গাছের ছায়ায় বসে পড়লাম।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে। মন ভালো করা ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা দিচ্ছে গায়ে, সারা দিনের গনগনে চেহারা এবার ফিকে হয়ে আসছে। সূর্য্যমিামা কমলা লাল রংবাহার ছড়িয়ে মিষ্টি আবেশ দিয়ে গেল।
এরই মধ্যে সমুদ্রতটে জড়ো হয়েছে স্থানীয় ও বিদেশি দর্শনার্থী। সৈকত একেবারে মুখরিত এখন।
সাঁতারে নেমে গেছে একদল। একটি ছেলে অনেকক্ষণ ধরে আমাকে বলছিল, সেইল বোট ভাড়া নিয়ে সামনে এগোতে চাই কি না। আমি হ্যাঁ বলতেই বোট তীরে এসে হাজির। লিকলিকে সাঁকোর মতো একজনের চালানোর জন্য একটা বোট, সঙ্গে ত্রিভুজাকৃতির পাল। নিজেরই চালাতে হয়। দাঁড়িয়ে। ব্যালান্স একটু এদিক-ওদিক হলে ধপাস করে সাগরে ডুব মারতে হবে। সেইল বোট আগে চালাইনি। এ রকম অ্যাডভেঞ্চার নেবার জন্যই বসে ছিলাম। কৌশল খুবই সোজা, বাতাসের মন বুঝে পাল ঘোরাতে হবে। অবশ্য আধা কিলোমিটারের বেশি দূর যাবার অনুমতি নেই।
বোট বুঝে নিয়ে আমি তখন ময়ূরপঙ্খীর অধিকারী। তবে অনভ্যস্ত হাতে দামাল পাল সামলানো যে সহজ নয়, তা আগে বুঝিনি। বাতাসের উল্লাসও বেড়েছে। এক একটা ঝাপটায় একবার ডানে, একবার বায়ে নিয়ে যাচ্ছে। যদিও প্রশান্ত মহাসাগর বেজায় শান্ত।
পালের হাল সামলাতে সামলাতে দেখি সূর্য ডুবে যাচ্ছে প্রায়। সব ভুলে সূর্যের চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম, মোহিত হয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য এখন সামনে থমকে আছে। যেন হাত বাড়ালেই কিছুটা সোনার আবির মেখে নেওয়া যায়। সোনালি আকাশ, সাগর আর চরাচর, একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে সবার মন পাওয়ার জন্য।
সেইল বোটে ভ্রমণ শেষে সাগরপাড়ে বসে রইলাম। বড় বোটে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকে। চালক আছে সেসবে।
সাগরে নৌকা বিহার আর মিছেমিছি বাতাসের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে খিদে পেয়েছিল বেশ, এবার খাবারের দিকে মনোযোগ দিতে হয়।
সাগরতটে হরেক রেস্তোরাঁ, মৃদু সংগীত এবং হালকা আলোয় বাইরে চেয়ার টেবিল পেতে খাওয়ার মতো আনন্দ আর নেই। কোনো কোনো রেস্তোরাঁয় লাইভ মিউজিকের ব্যবস্থা রয়েছে। সে রকমই একটিতে বসলাম। একদিকে গায়ক ব্লুজ গাইছেন, অন্যদিকে রেস্তোরাঁয় থেকে থেকে জ্বলে ওঠা নীল হলুদ লাল বাতি মোহ জাগিয়ে যাচ্ছে। এমন জায়গা থেকে কারই-বা মন চাইবে চলে যেতে! এত প্রাণবন্ত অথচ শান্ত, শব্দহীন সাগরপাড় মায়াবি মনে হয়।
খাবারের জন্য সামুদ্রিক তাজা মাছ তো আছেই। রেস্তোরাঁর সামনে মেনু আর ডিসপ্লেতে বরফাচ্ছাদিত মৎস্য রয়েছে। পছন্দেরটিই রান্না করে দেবেন শেফ।
পরদিন সকালে চলে গেলাম আইল্যান্ড হপিং করতে।
একটা মাঝারি আকারের সাদা পালতোলা ইঞ্জিনচালিত বোটে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে নৌকা চলতে থাকল। সমুদ্রের অপার বিস্ময় দেখতে হলে চলে যেতে হবে মাঝ সাগরে। সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে তার গোপন ঐশ্বর্য ভান্ডার। কাছে গিয়ে দেখা মেলে সবুজ জলের জাদু।
সহযাত্রীদের প্রায় সবাই ইউরোপীয়, শুধু একটি যুগল ফিলিপিনো। জোড়ায় জোড়ায় যেমন এসেছে, তেমনি আমার মতো সোলো ট্রাভেলারও আছে আরও দুজন।
আইল্যান্ড হপিংয়ে প্রথমে যে দ্বীপে নিয়ে গেল, তার নাম ক্রিস্টাল কোভ। বোট প্রায় মাঝ সাগরে নোঙর ফেলে যাত্রীদের বলা হলো জলে ঝাঁপিয়ে, সাঁতরে তীরে যেতে। ঝাঁপ দিতে আমার এক বিন্দু আপত্তি নেই। এই দ্বীপের তটও রাজহাঁসের পালকের মতো ধবধবে সাদা। এখানে সারা দিন ঘুড়ি ওড়ানো যায়, এক মাথা থেকে অন্য মাথা দৌড়ে বেড়ানো যায় অথবা স্নর্কলিংয়ের সরঞ্জাম নিয়ে ডুব দেওয়া যায় অগভীর জলে। শেষ অপশন আমার কাছে লোভনীয়। তাই স্নর্কলিংয়ের গিয়ার পরে নেমে পড়লাম। সাগরের এক পরত নিচে অভাবিত সৌন্দর্য সব মাধুরী মিশিয়ে দিয়েছে। নীল, হলুদ, সবুজ ছোট ছোট মাছ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে গোল্লাছুট খেলছে আমার সঙ্গে। স্নর্ক লিং যেহেতু গভীর জলে করা যায় না, তাই খানিক বাদে উঠে গেলাম জল থেকে। বোটের গাইড স্যামকে জিজ্ঞেস করলাম স্কুবা ডাইভিং করার ব্যবস্থা আছে কি না। সে জানাল, পরের আইল্যান্ডেই আছে। এ কথায় মন খুশি হয়ে গেল। এ দ্বীপে তটের বাহু ধরে দাঁড়িয়ে আছে পাথুরে পাহাড়, সেসবের ফাঁকফোকর দিয়ে জন্মেছে গাছের সারি। পাথরেরও যে প্রাণ আছে সেটাই যেন বলে যাচ্ছে বারবার।
পরের দ্বীপের নাম ক্রোকোডাইল আইল্যান্ড। এখানে বেশ কিছুক্ষণ থামবে বোট। যারা স্কুবা ডাইভিং করতে চাই, তীরে গিয়ে গাইড নিয়ে তাদের ডুবতে হবে আরও গভীরে।
আমার তর সইছিল না। ফিলিপাইনে এর আগে আরও কয়েকটা আইল্যান্ডে গিয়েছি, কিন্তু কোথাও স্কুবা ডাইভিং হয়নি।
এদিকে মধ্যদুপুরে একটুও ক্লান্তি আসেনি কারও। সাগর যেন ঝাঁপি খুলে বসে রয়েছে নিজ হাতে প্রতিটি হীরা পান্না দেখাবে বলে। এই সবুজ জলরাশি জমলে নিঃসন্দেহে সমুদ্র সমান পান্নাভূমি তৈরি হয়ে যাবে, এত ঐশ্বর্য সে কারণেই লুকিয়ে রাখে সে নিজের ভেতরে।
ক্রোকোডাইল আইল্যান্ডে আমার স্কুবা ডাইভিংয়ের গাইডের নাম এড। পেশাদার সাগর ডুবুরি। আমি বলি জলের নিচের শিল্পী। ডাইভিংয়ের পোশাক পরে অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে ঝুলিয়ে পৌঁছে গেলাম সাগরতলে এই পাতালপুরীর শিল্পীর সঙ্গে। জানতে চেয়েছিলাম, হাঙর দেখতে পাওয়া যাবে কি না। উত্তর এলো, অত গভীরে কারও যাবার অনুমতি নেই।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ জলে কুমির তো আছেই। না হলে দ্বীপটির এমন নাম হয় কী করে!’
উত্তর এলো, ‘কুমির থাকলেও কাছাকাছি যেতে দেওয়া হয় না বিদেশিদের।’
জলের নিচে প্রথমে কোরাল বা প্রবালের দেখা মেলে। উদ্ভিদের রূপে হাজার রং ছড়িয়ে চারদিক আলো করে রেখেছে এগুলো। জলের তোড়ে ডানে-বামে লম্বা সরু শরীর হেলেদুলে নাড়িয়ে যাচ্ছে সাগরকে। এসব প্রবাল কয়েক শ বছর পথ পাড়ি দিয়ে হয়ে যাবে পাথরের মতো শক্ত। সেগুলোই সাজিয়ে রাখা হয় ড্রয়িংরুমে। জলের নিচে এগুলোর কত যে রং! এই প্রবালরাশির ফোকর গলে উঁকি দিচ্ছে নানা রঙের মাছ। কিছু চেনা। অন্য দেশে স্কুবা ডাইভিংয়ের সময় চিনেছি। সবচেয়ে পরিচিত মাছ নিমো। কমলা গায়ে সাদা আর কালো ডোরাকাটা নিমোর নামে একটা কার্টুনও আছে।
জীবন্ত এই জগতে আমার আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ম্যান্ডারিন ফিশ (দেখতে অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিংয়ের মতো, যেন শরীরের ক্যানভাস দখল করে আছে নীল, হলুদ, সবুজ, কালো রং), স্পাইকফিন গোবি (একে মোটেই মাছ বলে মনে হবে না; কারণ, এর পাখির মতো রঙিন পাখা আছে, যার রং নীল, কমলা, হলুদ, সবুজ। এত সুন্দর যে মনে হবে এখনই দল বেঁধে পাখা মেলবে আকাশে), ডার্ট ফিশ (মাছটার রুপালি অবয়ব থেকে আপনা হতেই আলোর ছটা বের হয়, তাই পাতালপুরী চিনতে মোটেই অসুবিধা হয় না। এখানে রঙধনু হয়ে জলের জগৎ সাজিয়েছে, পান্না-সবুজ শরীরে কমলা হলুদের আঁকিবুঁকি), অরেঞ্জ স্পটেড ফাইল ফিশ (স্থলচর প্রাণীদের মতো জলের মাছও যে রং বদলাতে পারে জানা ছিল না, এটি খুব পারদর্শী এ কাজে। যে কেউ যাতে আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্য নিজের সমুদ্রাভ সবুজ রংকে যেকোনো সময় পরিবেশের সঙ্গে বদলে নিতে পারে), অ্যাঞ্জেল ফিশ, ড্রাগন নেট, রিংড পাইপ ফিশ, আরও কত নাম না জানা ছোট-বড় মাছ। জলের এই ভুবন স্থলের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।
এক ঘণ্টার স্কুবা ডাইভিং শেষ করে বোটে ফিরে আসি, দেখি স্যাম লাঞ্চ সাজিয়ে বসে আছে। সামুদ্রিক গ্রিলড ফিশ, শামুক সেদ্ধ, চিকেন ফ্রাই, ভাত, স্যালাড, সস, কয়েক রকমের ফল আর জুস।
এর মাঝেই বিকেল আভা ছড়াতে শুরু করেছে, মানে সাগরের আঁচলের গেরো খুলে আমাকে ফিরে যেতে হবে তীরে।
হোয়াইট বিচে এসে দেখি, সারি সারি দোকানে হরেক রকম রঙিন জিনিসের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। শামুক-ঝিনুকের তৈরি পণ্যই বেশি। রং দেখলে মনে হবে, সব কিনে বাড়ি নিয়ে যাই। বাজার ঘুরে দেখতে গিয়ে সূর্যাস্ত মিস হয়ে যায়। এমন কমলা, সাগর আর সাদা রঙের মিশেল দেওয়া অনুভূতি কিছুতেই বাদ দেওয়া যায় না।
গতকালের মতো আজও বহু মানুষ এসেছে ক্ষণে ক্ষণে সূর্যের এই বদলে যাওয়া রূপ দেখতে। গাঢ় থেকে হালকা হয়ে ওঠা জাফরানি রং ছড়িয়ে সমুদ্রকে কুসুম কমলায় দুলিয়ে সূর্য্যমিামা বিদায় নেওয়ার তোড়জোড় করছে। সেই সঙ্গে এই বিদায় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে নানান দেশের মানুষ।
প্রতিদিন এই পান্না-সবুজ সাগর, ধবধবে সাদা তট নতুন রূপে ধরা দেয় ভ্রমণকারীদের সামনে। বোরাকায় এভাবে হয়ে ওঠে ইন্দ্রপুরী, যেখানে যেতে কারোরই নেই মানা।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top