skip to Main Content

স্বাদশেকড় I বোরহানি

বিয়েবাড়ির প্রচলিত পানীয়। ভারী খাবারের সঙ্গে এর যোগ। কিন্তু কবে খাওয়া শুরু হয়, তা নিয়ে রয়েছে নানান মত

ভারী খাবারে সঙ্গত দেওয়া এই পানীয়র অতীত রহস্যে ঘেরা। কোথা থেকে এসেছে, কোথায় উৎকর্ষ- বলা মুশকিল। তারপরও ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে, একে-ওকে জিজ্ঞাসা করে লেখা বোরহানির ইতিবৃত্ত।
হজমের জন্য উপকারী- এই আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে বিয়েবাড়িতে গিয়ে ২-৩ গ্লাস বোরহানি পান করার লোকের অভাব নেই। তবে সুস্বাদু, উপকারী আর ভারী খাবারে সঙ্গত দেওয়ার মতো পানীয় আর কটা আছে? বিয়েবাড়ি বা রেস্টুরেন্টে অতিরিক্ত তেলযুক্ত মসলাদার খাবারের পর জিহ্বার আড়ষ্টতা দূর করতে এর জুড়ি নেই। বোরহানির প্রধান উপকরণ টক দই। এতে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া আছে, যা খাবার হজম করে পেট ঠান্ডা রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে উপকারী বোরহানির ইতিহাস খুঁজে পাওয়াটা কেবল দুঃসাধ্য নয়, অসম্ভবও বটে!
উপমহাদেশে দই আসে মূলত আর্যদের হাত ধরে। বৈদিক খাবার বলে তার জনপ্রিয়তা মিলতেও খুব একটা সময় লাগেনি। তবে আর্যরা এটি খেত বলে জানা যায়, পান করার প্রথম ঐতিহাসিক বর্ণনা মেলে কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে বই সংকলনের সময়কাল চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। আর যদি মনু স্মৃতিকেও ধরে নেওয়া হয় ইতিহাস হিসেবে, তাহলে এটাকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে হবে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ নাগাদ। বৈদিক সময়ে অতিথিকে মধুপর্ক দিয়ে স্বাগত জানানো হতো। এটি ছিল ঘি, দই, দুধ, মধু আর চিনি দিয়ে তৈরি পানীয়। রাজা তৃতীয় সোমেশ্বরের ১১২৭ সালে লেখা মানসোল্লাসেও পাওয়া যায় তরল দইকে হালকা ঝাল বা ঝাঁজালো স্বাদের করার জন্য রাই সরিষা ব্যবহার করতেন ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমের অভিজাতেরা। সময়কালটা মাথায় রাখা প্রয়োজন এখানে। কারণ, এ সময়ে ধীরে ধীরে পারস্য-তুর্কি মুসলিম ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেছে পশ্চিমঘাট আর দাক্ষিণাত্যে। আরব ব্যবসায়ীরা তো সপ্তম শতাব্দী থেকেই সেখানে ঘাঁটি গেড়েছিলেন।
ভারতে তরল দইয়ের ব্যবহারে পরিবর্তন আসে পারসিক-তুর্কি প্রভাবে, দশম শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে যার শুরু। আইরান আর দুঘ নামের পানীয় তারা সঙ্গে করেই এনেছিল। আইরান হলো দই, লবণ ও পানির মিশ্রণ আর এর সঙ্গে পুদিনাপাতা যোগ করলেই সেটা হয়ে যায় দুঘ। ভারতে, বিশেষত উত্তর প্রদেশে প্রাচীনকাল থেকেই পুদিনা হতো বলে প্রমাণ মেলে। তাই মুহম্মদ ঘুরির দিল্লিতে আসা পারসিক-তুর্কিদের দুঘ খেতে খুব বেশি একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। আর এই দুঘ থেকেই যে বোরহানির মূল সূত্র খুঁজে নেওয়া যাবে, সে ব্যাপারে খুব বেশি সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে দিল্লির খাবার ও স্থাপত্য নিয়ে কাজ করা বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রানা সাফভি আর দিল্লি কারাভানের আসিফ খান দেহলভির সঙ্গে যোগাযোগ করতেই দুজনে এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে আইরান আর দুঘ সুলতানি দিল্লির খাবারে অপরিচিত কিছু ছিল না। সাফভি বোরহানির ব্যাপারে একেবারেই স্পিকটি নট হলেও আসিফ বলছেন, পানীয়টি দিল্লির কিছু কিছু এলাকায় প্রচলিত, তবে কবে থেকে, সে ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। কলকাতায় কি বোরহানি মেলে? ক্যানভাসেরই আরেক লেখক, কলকাতার রসনা-লিখিয়ে পাঞ্চালী দত্ত জানালেন, ‘কলকাতায় তো হাতে গোনা কয়েকটি রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানির সঙ্গে এই পদ পরিবেশিত হয়, তবে এটা কলকাতার কি না, বা অন্য কোনো এলাকার প্রভাবে এসেছে কি না, সে ব্যাপারে কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।’
অগত্যা মুর্শিদাবাদি ঘরানার খাবারের বই খোঁজা হলো, বোরহানি নেই সেখানে। খুঁজে দেখা হলো আবদুল হালীম ‘শর্র’-এর বিখ্যাত বই গুযিশ্তা লক্ষ্ণৌ, যেখানে আওধি ঘরানার খাবার নিয়ে গোটা একটা অধ্যায়ই রয়েছে, সেখানেও নেই বোরহানির উল্লেখ। অনেক জায়গায় লোকশ্রুতি ও অসমর্থিত সূত্র হিসেবে উল্লেখ রয়েছে বোরহানির জন্ম ঢাকা ও চট্টগ্রামের মুসলিমদের হাতে। এটা যদি সত্যিও হয়, খুব একটা আশ্চর্যের বিষয় হবে না; কারণ, পারস্যের নাবিকদের মাংসের পদ চট্টগ্রামে এসেই বিখ্যাত কালা ভুনায় রূপান্তরিত হয়েছে; পর্তুগিজদের বালাচাও এই বন্দরনগরীতে তার শুকনো রূপ পেয়েছে। অথচ গোয়ায় এখনো বালাচাও একধরনের কারি। ঢাকাও বন্দরনগরী ছিল। তাই সুলতানি আমলে পারসিক-তুর্কি প্রভাব এখানকার খাবারেও পড়েছিল, বণিক, নাবিক আর স্থায়ীভাবে বসত গড়া পারসিক-তুর্কি সম্প্রদায়ের মাধ্যমে। এভাবে ব্যাপারটাকে ভাবলে বেশ সুবিধে হয়। আবার এমনটাও হতে পারে বোরহানি নামে যেটা এখন খাওয়া হচ্ছে, সেটা খুব বেশি আগেকার নয়, হয়তো আইরান বা দুঘকেই বোরহানি বলা হতো। সে যা-ই হোক, পূর্ব বাংলার লোকেদের ঝাল খানিকটা বেশি খাওয়ার রীতি রয়েছে, উপকূলীয় এলাকায় সেটা আরও বেশি। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ঝাল ব্যাপারটা গরমে স্বস্তি দেয়, ঘাম ঝরিয়ে। আর রয়েছে প্রচুর মসলা খাওয়ার রীতি। সম্ভবত দুঘ, আইরান থেকে এই বঙ্গে বেশ কয়েক পদের দইভিত্তিক পানীয়র প্রচলন ঘটে; যার একটা ঘোল, যেটা প্রায় আইরানের মতোই খেতে, অন্যটি বোরহানি। ঢাকাই বোরহানির একমাত্র সূত্র পাওয়া গেছে ঢাকা পাচাস বারাস পেহেলে বইয়ে, তা-ও মাত্র একটিবার এর উল্লেখ রয়েছে তোরাবন্দি খাবারের বর্ণনায়, স্রেফ একটি পদ হিসেবে। ইতিহাসের সাক্ষ্য-প্রমাণ এখন পর্যন্ত বলছে, পারসিক-তুর্কি ঘরানার পানীয় থেকেই বোরহানির চল হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে এসে, তবে সেটা বাংলার কৃতিত্ব না উত্তর ভারতের, তা নিয়ে বিতর্ক চলবেই যত দিন না জুতসই প্রমাণ হাতে এসে পড়ছে।
আগেই বলা হয়েছে, দুঘের উপাদান মূলত দই, পানি, লবণ আর পুদিনা। খুব সম্ভবত দিল্লিতে এসে এর খানিক পরিবর্তন হয়েছিল, আর এই বাংলায় তার চূড়ান্ত রূপ পেয়েছিল এখানকার বিভিন্ন ধরনের মসলার সঙ্গে মিশে, স্থানীয় খাদ্যরীতির মিথস্ক্রিয়ায়। বোরহানির ক্ল্যাসিক যে রেসিপি দিয়েছেন সিদ্দিকা কবীর ১৯৭৮ সালে, তাতে দেখা যাচ্ছে দই, পানি, লবণ আর পুদিনা ছাড়াও জিরা, ধনিয়া, আদা, মরিচ, গোলমরিচ, সরিষা আর চিনি ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এখন তো রীতিমতো ঢুকে পড়তে চায় টমেটো সসও।
ঢাকা শহরে সেরা বোরহানি মেলে কোথায়? বাণিজ্যিকভাবে বোতলে পুরে যা বিক্রি হয়, সেটা মুখে তোলার মতো হয় না। তাই বিয়েবাড়ি ছাড়া ভালো বোরহানি পাওয়া কঠিন। তবে যে একবার ঢাকার সেনাকুঞ্জের বোরহানি মুখে দিয়েছে, তার কাছে অন্য জায়গার এই পানীয় ভালো লাগার কথা নয়। বহুবার জিজ্ঞাসা করেও বাবুর্চির কাছ থেকে এর রহস্য বের করা যায়নি।

 আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top