ফিচার I বর্ণিল জাফরান
বনেদি খাবারে ব্যবহৃত হয়। স্বাদ, গন্ধ আর রঙে ভোজনের আবহ বদলে দেয়। কিন্তু কেমন করে এটি উৎপাদিত ও সংগৃহীত হয়?
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মসলা হিসেবে জাফরানকে গণ্য করা হয়। নাম শুনলেই বনেদি এক আভাস পাওয়া যায়। এই উপাদানের ব্যবহার অনেকের সাধ্যের বাইরে থাকলেও এর গুণাগুণ সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন।
মসলাজাতীয় এই দ্রব্য জাফরান ফুলের শুষ্ক গর্ভমুন্ড থেকে পাওয়া যায়। আনুমানিক ৩ হাজার ৫০০ বছর ধরে মানুষ এই উদ্ভিদ চাষ ও ব্যবহার করে আসছে। মসলার পাশাপাশি এটি ওষুধ, রং এবং সুগন্ধি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ধারণা করা হয়, বিশ্বে প্রথম ফুল থেকে কোনো মসলার উৎপত্তি হয়েছে এই উদ্ভিদ থেকেই। খাবার সুস্বাদু করার জন্য জাফরান অধিক প্রচলিত। বিশেষ করে বিরিয়ানি, কাচ্চি, জর্দা, কালিয়াসহ নানা পদের দামি খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খাবারে এই দ্রব্য ব্যবহৃত হলে এর স্বাদ ও পুষ্টিগুণ অনেকটাই বেড়ে যায়।
জাফরানের উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে নানা মতবাদ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ইরান থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এ ছাড়া গ্রিস ও মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে এর উৎপত্তির সম্ভাব্য অঞ্চল হিসেবে ধারণা করা হয়। প্রাচীন যুগে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে জাফরানের সুগন্ধ ও উজ্জ্বল রঙের গুরুত্ব অনুধাবন করে এর ব্যাপক প্রচলন হয়।
জাফরানকে ইরানে ‘লাল স্বর্ণ’ বা ‘রেড গোল্ড’ নামেও ডাকে। এই দ্রব্য সংগ্রহের পদ্ধতি অন্য যেকোনো মসলা সংগ্রহের প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অল্প সময়ের মধ্যে দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয় বলে এটি বেশ ব্যয়বহুল। আকর্ষণীয় সুগন্ধ ও উজ্জ্বল রঙের কারণে প্রাচীন যুগে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে জাফরান ব্যবহার করত সে সময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলো।
উদ্ভিদতত্ত্বের দিক থেকে জাফরান ইরিডাসিয়া ফ্যামিলির অন্তর্গত। আরবি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ফারান’ এবং ইংরেজিতে ‘সাফরন’। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় কান্দাহার, খোরাসান এবং কাশ্মীরের বনেদি মহলের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে এ মসলার আগমন ঘটে। ইরানিরা প্রায় প্রতিটি রান্নায় জাফরান ব্যবহার করে। ‘পায়েলা’ নামে একটি খাবার জাফরানের বিখ্যাত স্বাদ আর সোনালি রঙের জন্য বিখ্যাত। ঝোল, রুটি, মেরিনেটে এটি ব্যবহৃত হয়।
জাফরান যখন ভাঙা হয়, তখন এর ভেতর থেকে হলদে আরও একটি রং পাওয়া যায়। এতে এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান আছে, যেগুলো পাইক্রোক্রকিন, ক্রসিন ও সাফরানালের মতো দামি। এই তিনটি উপাদান মূলত জাফরানের স্বাদ, রং ও ঘ্রাণ সৃষ্টি করে। এই দ্রব্যের গুণাগুণের উল্লেখ মানে মূলত এই তিনটি উপাদানের উপকারী বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাফরান খাঁটি কি না, সেটা জানা যায় এর গন্ধ থেকে। যদি ঘ্রাণ মিষ্টি আর স্বাদ তেতো হয়, তবে সেটি আসল। এ ছাড়া কয়েকটি জাফরান পানিতে ভিজিয়ে রেখে দেখতে হয় রং ছেড়ে দিচ্ছে কি না, আসলগুলো রং ছড়ালেও লালচে থাকবে, কিন্তু নকলগুলো সাদা হয়ে যাবে।
অতীতে হলুদ-লাল গাঁদাগাছের পাতা, লিলি ফুলের কেশরকে জাফরান হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হতো, কিন্তু সেগুলোর স্বাদ আর বর্ণ ছিল একদম ভিন্ন। অনেক জাফরান একত্র করে সুরাও বানানো হতো। গবেষকেরা দাবি করেন, এই জাফরান আলঝেইমার, ডিপ্রেশন, প্রিমিনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম সমস্যা রোধেও সহায়ক। ছোট্ট একটি মসলা যে এত রোগের প্রতিরোধক, এ তথ্য অনেকেরই অজানা।
জাফরানের কিছু প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন পদ্মাগদি। কাশ্মীরে জন্মানো এটিই সর্বোত্তম প্রকারের জাফরান হিসেবে বিবেচিত। একে মংরা বা লাছা জাফরানও বলা হয়। এ ছাড়া আছে, পারসিকা কুমকুমা। এর আঁশ বা সুতাগুলো অপেক্ষাকৃত বড় হয়ে থাকে। মধুগন্ধীও এক প্রকার জাফরান। এর আঁশ বা সুতাগুলো ঘন ও পুরু। এ ছাড়া এগুলো রুক্ষ এবং কিছুটা সাদা। রয়েছে বাহিলকা। এর আঁশ বা সুতাগুলো ছোট ও সাদা। আরও আছে সারগোল, যা ইরানে জন্মায়। আকিলা রয়ে ইতালিতে এবং ক্রিম স্পেনে জন্মায়।
ওষুধের জনক হিপোক্রেটিসের মতে, জাফরান কফ, কাশি, ঠান্ডা, পাকস্থলীর সমস্যা, অনিদ্রা, গর্ভাশয়ে রক্তপাত, পেটফাঁপা ও হৃদ্রোগের সমস্যা সমাধানে বেশ ভালো কাজ করে। এই দ্রব্যে থাকা ম্যাঙ্গানিজ ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে এবং হাড় ও টিস্যু গঠনে সহায়ক। এর ভিটামিন-সি যেকোনো ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
দুধের সঙ্গে জাফরান মিশিয়ে খেলে হজমশক্তি ও রুচি বাড়ে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ত্বককে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখে। রাতে ঘুমানোর আগে জাফরান দুধ খেলে খুব ভালো ঘুম হয়। এর তেলে ত্বক উজ্জ্বল হয়। এমনকি জাফরানের পানিতেও রয়েছে অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য। এতে যে প্রাকৃতিক যৌগ আছে, তা দৃষ্টিশক্তির অবক্ষয় এবং রেটিনার যেকোনো সমস্যা প্রতিরোধ করে।
খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও দামি প্রসাধনসামগ্রী হিসেবে জাফরান ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকালে শরীরের সৌষ্ঠব বাড়ানোর জন্য এই দ্রব্য গায়ে মাখা হতো বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা। এ ছাড়া বিউটি পার্লারে রূপচর্চায় জাফরান উল্লেখযোগ্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক, গ্রিস, মিসর, চীন- এসব দেশে কমবেশি জাফরানের চাষ হয়ে থাকে। স্পেন ও ভারতের কোনো কোনো অংশে, বিশেষ করে কাশ্মীরে এ ফসলের চাষ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তবে স্পেনে জাফরান উৎপাদনের পরিমাণ অন্য দেশের তুলনায় অত্যধিক। জাফরানের রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রথম সারিতে রয়েছে স্পেন। বিশ্বের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ জাফরান এই দেশ থেকেই রপ্তানি করা হয়।
কেন জাফরান এত ব্যয়বহুল, এমন প্রশ্ন মনে জাগতেই পারে! এর জন্য জানতে হবে এই উপাদানের চাষ পদ্ধতি। জাফরান চাষ মোটেও সহজ কাজ নয়। আবহাওয়াগত বৈচিত্র্য, উর্বর মাটি এবং কষ্টসহিষ্ণু পরিশ্রমী মানুষের দ্বারা জাফরান চাষ করা হয়। এটি চাষে ইরান সবচেয়ে এগিয়ে। সে অঞ্চলের মাটি যেকোনো উদ্ভিদ চাষে অনুকূল। ফলে খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকেই এই ভূখন্ডে বিচিত্র সব উদ্ভিদের চাষ হয়ে আসছে। আগেই বলা হয়েছে, ইরানিরাই প্রথম জাতি, যারা জাফরানের মতো মূল্যবান উদ্ভিদের চাষবাস শুরু করেছে দীর্ঘকাল থেকে।
ফুলের গর্ভদন্ড (স্টিগমা) বা নারী অঙ্গ থেকে জাফরান সংগ্রহ প্রচন্ড ব্যয়বহুল ও শ্রমের কাজ। তাই এই দামি মসলা চাষে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। প্রথম বছর রোপণকৃত সব গাছে ফুল আসে না, তা পাওয়া যেতে পারে শতকরা ৪০-৬০ ভাগ উদ্ভিদে। ১ গ্রাম জাফরান পেতে প্রায় ১৫০টা ফুটন্ত ফুলের প্রয়োজন হয়। পরের বছর একেক গাছ দু-তিনটা করে ফুল দেয়। তবে তৃতীয় বছর থেকে জাফরান গাছ ৫-৭টা করে ফুল দিতে সক্ষম হয়। এ গাছ লম্বায় প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার।
প্রায় সব ধরনের জমিতে জাফরান চাষ করা যায়। তবে বেলে-দোআঁশ মাটি এ ফসল চাষে বেশি উপযোগী। এঁটেল মাটিতে ফলন ভালো হয় না, কিন্তু তাতে কিছু বালু ও বেশি মাত্রায় জৈব সার মিশিয়ে চাষ উপযোগী করা যায়, তবে ফলন হতে পারে। এই গাছ জলাবদ্ধতা একেবারে সহ্য করতে পারে না, এ জন্য পানিনিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি এ ফসল চাষের জন্য উপযোগী।
জাফরান শুধু খাবারের স্বাদ এবং রংই বাড়ায় না, এর আরও অনেক গুণ রয়েছে।
এর রয়েছে বিস্ময়কর রোগ নিরাময় ক্ষমতা। আছে পটাশিয়াম, যা উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদপিন্ডের রোগ দূর করে। হজমসংক্রান্ত যেকোনো ধরনের সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে জাফরান। এর পটাশিয়াম আমাদের দেহে নতুন কোষ গঠন এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোষ সারিয়ে তুলতে সহায়তা করে। জাফরানের নানা উপাদান আমাদের মস্তিষ্ককে রিল্যাক্স করতে সহায়তা করে, এতে করে মানসিক চাপ ও বিষণ্নতাজনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
নিয়মিত জাফরান সেবনে শ্বাসপ্রশ্বাসের বিভিন্ন সমস্যা যেমন অ্যাজমা, পারটুসিস, কাশি এবং বসে যাওয়া কফ দূর করতে সহায়তা করে। নারীদের মাসিকের অস্বস্তিকর ব্যথা এবং তা শুরুর আগের জটিলতা দূর করতে জাফরানের জুড়ি নেই।
জাফরানের রয়েছে অনিদ্রা সমস্যা দূর করার জাদুকরী ক্ষমতা। ঘুমাতে যাওয়ার আগে গরম দুধে দ্রব্যটি সামান্য মিশিয়ে পান করলে অনিদ্রা দূর হবে।
সামান্য একটু জাফরান নিয়ে মাড়িতে ম্যাসাজ করলে মাড়ি, দাঁত এবং জিহ্বার নানা সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। এটি দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে এবং চোখের ছানি পড়া প্রতিরোধেও কাজ করে।
তবে এত গুণসম্পন্ন এই উপাদান সম্পর্কে কিছু সতর্কতাও জেনে রাখা জরুরি। জাফরান অতিমাত্রায় খাওয়া ঠিক নয়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় নারীর কোনো খাবারে এটি ব্যবহার করা যাবে না। এ ছাড়া এক বা দুই চামচের বেশি জাফরান খেলে যেকোনো মানুষ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
ছবি: ইন্টারনেট