কভারস্টোরি I সুস্থতার বিজ্ঞান
রোগবালাই থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টায় মানুষের বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। কিন্তু কেমন করে নিরাময়ের পদ্ধতিগুলো আয়ত্ত হলো? কীভাবেই-বা এই কাজে কুসংস্কার থেকে মুক্তির সংগ্রাম আমাদের চিকিৎসাপ্রযুক্তির সর্বশেষ ধাপে নিয়ে এলো? লিখেছেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম
প্রাচীনকালে চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং জাদুবিশ্বাসের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। মানুষ অসুস্থ হলে ওই গোষ্ঠীর বিশেষ গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে ডাকা হতো। যেমন অদ্ভুত তার ক্ষমতা, তেমনি ছিল তার পোশাক। জন্তুর রোমশ চামড়া দিয়ে তার শরীর ঢাকা থাকত। মাথায় বড় বড় দুটি হরিণের মতো শিং, পেছনে শিয়ালের অনুকরণে লেজ এবং মুখ অনেকটা বানর আকৃতির। তখন অসুস্থতা বলতে মানুষ মনে করত ভূত বা অশুভ কোনো শক্তি দেহে ঢুকে তাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। তাই ওঝা ভয় দেখিয়ে, মারধর করে, মন্ত্র পড়ে কিংবা কোনো গাছগাছড়ার তেতো রস খাইয়ে ওই অশুভ আত্মাকে বশ করত, দেহ থেকে তাড়িয়ে দিত।
আদিম মানুষ বুঝেছিল, বাঁচতে হলে লড়তে হবে। শক্তি আর কৌশলের সাহায্যে তারা হিংস্র জন্তু শিকার করত, বিষধর সাপ মেরে প্রাণও রক্ষা করত। এমনকি অন্য গোষ্ঠীর অচেনা মানুষও তাদের কাছে শত্রু ছিল। তাই দলেবলে যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিত তারা। কিন্তু যে শত্রু হাওয়ায় লুকিয়ে থাকে, চোখে দেখা যায় না, হাতে ধরা যায় না, তার সঙ্গে লড়াই করবে কে? এই কাজ যিনি করতেন, তার নাম ওঝা, পুরোহিত। এরাই ছিলেন তখনকার সমাজে চিকিৎসক।
প্রাচীন চিকিৎসার একটি ঘটনা এমন—একবার হঠাৎ অসুস্থ একটি ছেলেকে দেখে ওঝা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, ভূত ওর মাথায়। খুলি ফুটো না করলে তাকে তাড়ানো যাবে না। মুহূর্তে রটে গেল এ কথা। কিন্তু এ কাজ করা যার-তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষ একজন লোক এটি করে থাকে। তার হাতে পশুর চামড়া দিয়ে জড়ানো পাথরের অস্ত্র। ইনিই প্রাচীনকালের সার্জন। অসুস্থ ছেলেটিকে ঘাসের ওপর শোয়ানো হলো। তিন-চারজন জোয়ান লোক তার হাত-পা-মাথা শক্ত করে ধরে রাখল। পাশেই আগুনের কুন্ড। কয়েকজনের হাতে সরু গাছের ডাল, গলায় ঢাকের মতো বাদ্য। খুব ধারালো একটা অস্ত্র দিয়ে সার্জন রোগীর মাথার চামড়া একটানে কেটে ফেলল। আরেকটি পাতলা পাথর দিয়ে সরিয়ে ফেলা হলো চামড়াটি। ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা রক্ত বন্ধ করতেও জানে সে। অগ্নিকুন্ড থেকে জ্বলন্ত একটি সরু ডাল তুলে ক্ষতের মুখে ঘষে রক্ত বন্ধ করা হলো। এদিকে রোগী মর্মান্তিক চিৎকার করে চলেছে। কিন্তু সমবেত জনতা ও পুরোহিতদের জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ আর ঢাকের শব্দে সেই চিৎকার কারও কানে পৌঁছায় না। সার্জন ঝটপট আরেকটি পাথর দিয়ে খুলি কেটে গোল একটি ফুটো তৈরি করল। একমুঠো কচি ঘাস চিবিয়ে ক্ষতের ওপর বসিয়ে দিল।
অপারেশন শেষ হলো। জ্ঞানহীন রোগীকে রাখা হলো গুহার ভেতরে। কয়েক দিন সে পড়ে রইল অজ্ঞান অবস্থায়। তার গা তাতানো পাথরের মতো গরম। মাথার ফুটো দিয়ে ভূত যেন তরল হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বুড়ি ঠাকুমা জঙ্গল থেকে গাছগাছড়া তুলে এনে খাওয়াল। পাতা চিবিয়ে ক্ষতের ওপর লাগিয়ে দিল। ধীরে ধীরে ছেলেটি একদিন উঠে বসল। মাথার ক্ষতও শুকিয়ে গেল।
যদিও এই ঘটনা নিতান্তই কাল্পনিক, তবে এটা একেবারে আজগুবি নয়। বাস্তবের ভিত্তিতেই এই কাহিনির গড়ে ওঠা। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মাটি খুঁড়ে প্রস্তরযুগের যেসব খুলি পেয়েছেন, সেসবের মধ্যে এমন অনেক নিদর্শন রয়েছে। খুলি ফুটো করার পরেই যে তাদের মৃত্যু হয়নি, বরং অনেক দিন বেঁচে ছিল, তারও প্রমাণ মিলেছে। এমন খুলি আছে যেগুলোতে একাধিক ছিদ্র রয়েছে। এক একটি ফুটোর পাশ দিয়ে আবার নতুন হাড়ও গজিয়েছে। এ থেকে ছিদ্র করার সময় নির্ধারণ করা গেছে। অথচ তখনকার মানুষ সভ্য হয়নি। বিজ্ঞানের ধারণাও ছিল না তাদের। দেহের ভেতরের কলকবজা সম্পর্কে কিছুই জানত না। তাদের হাতে ছিল মাত্র একটি অস্ত্র। এক টুকরো পাথর।
দুই
কীভাবে মানুষ রোগ নিরাময়ে মন্ত্র-তন্ত্র ও জাদুবিশ্বাস থেকে সরে এসে পদ্ধতিগত কৌশল আবিষ্কার করল? যেটাকে বলা হচ্ছে বিজ্ঞান? সেটি হলো চিন্তা করার সক্ষমতা। এ কারণেই মানুষ পশুপাখি থেকে আলাদা। তা ছাড়া মানুষের রয়েছে চারপাশ থেকে শেখা এবং সেসব কাজে লাগানোর ক্ষমতা, কোনো একটি ঘটনা বা আচরণের ব্যাখ্যা করার সামর্থ্য। কিন্তু মূল শক্তিটি এসেছে মানুষের সীমাহীন কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা থেকে। এই দুটি বিষয় প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, বিশাল প্রকৃতির রহস্য উদ্্ঘাটন, খাদ্য সংগ্রহের জন্য নতুন নতুন ক্ষেত্র খোঁজা—এসব মানুষকে কৌতূহলী করেছে, অন্যদিকে তা সমাধানে নানান জিজ্ঞাসার মুখোমুখিও হয়েছে। বিজ্ঞানের যে প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা, তার সূত্র ধরে গবেষকেরা বলছেন, প্রাচীন মানুষের সেসব কৌশলের মধ্যেই ঘটেছিল এর সূচনা। তা সময়ের ধারাবাহিকতায় ভুল প্রমাণিত হলেও। কেননা, বিজ্ঞান আসলে সেটিই, যা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা পাওয়া প্রামাণিক ফল। এবং সেটি আপেক্ষিক। অর্থাৎ আজ যা সত্য, আগামীকাল সেই চিন্তা বাতিল হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নতুন জ্ঞান। এভাবেই বিজ্ঞান এগিয়ে চলে সময়ের সঙ্গে।
কমপক্ষে এক হাজার বছর ধরে নানাভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুশীলন করা হয়েছে। তবে ইউরোপের পশ্চিম অংশের কয়েকটি অঞ্চল—ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, ডেনমার্ক প্রভৃতি দেশের অগ্রসর চিন্তার মানুষেরা সতেরো শতকে জ্ঞান অর্জনের সুশৃঙ্খল [নিয়মভিত্তিক] একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক সংজ্ঞা দেন উইলিয়ম হিওয়েল ‘হিস্ট্রি অব ইনডাকটিভ সায়েন্স’ [১৮৩৭] এবং ‘ফিলোসফি অব ইনডাকটিভ সায়েন্স’ [১৮৪০] বই দুটিতে। তিনি দেখিয়েছেন, শুধু অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কোনো বিষয় সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে তথ্য সংগ্রহ এবং পরে তা যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা দরকার। এটি কোনো কিছু জানা বা বোঝার ক্ষেত্রে ছিল অনেক কার্যকর। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও মূলত এই পদ্ধতিই অনুসরণ করে এগিয়েছে।
শুরুতে প্রাচীন চিকিৎসা সম্পর্কে যে কাহিনি বলা হয়েছে, তাতে লক্ষ করার বিষয় হলো, তখন মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা থাকলেও রোগ নিরাময়ে তাদের যে নিজস্ব পদ্ধতি তারা প্রয়োগ করত, সেসবের একটা আন্তঃশৃঙ্খলা ছিল। আজকের সভ্যতা বিজ্ঞান ও দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তির সূত্রে তা ভুল মনে হতে পারে। কিন্তু সেই সূচনাটি তখন না ঘটলে এখনকার বিকশিত ব্যবস্থাটিও দুর্লভ হয়ে উঠত। প্রাচীন ধারণাগুলোকেই মানুষ অভিজ্ঞতা ও চিন্তা দিয়ে ব্যাখ্যার একটি শৃঙ্খলা আবিষ্কার করে। মূলত সেটিই হয়ে ওঠে বিজ্ঞানের প্রাথমিক পদ্ধতি। খ্রিস্টের জন্মের কয়েক শ বছর আগে থেকেই মানুষ তা চর্চা করেছে। মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন, ভারতসহ সব প্রাচীন সভ্যতায় জ্ঞান ও প্রযুক্তির অনুশীলন শুরু হয়েছিল। যেমন কৃষি, বাড়ি তৈরি, নগর নির্মাণ, পানিনিষ্কাশন, কুটিরশিল্প ইত্যাদি। তেমনি মানুষের বিচরণ পৃথিবীর যেখানেই ছিল, সেখানেই প্রকৃতির সঙ্গে টিকে থাকার সংগ্রামের পাশাপাশি রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে জাদুবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ধর্মীয় বিশ্বাস, অলৌকিক ভাবনা। যেগুলোর সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও গবেষণালব্ধ ফল লাভের কোনো সম্পর্ক নেই। যুক্তি নয়, বিশ্বাসই সেখানে প্রধান দাওয়াই। কিন্তু মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শিখল, অলৌকিকতা দিয়ে রোগমুক্তি সম্ভব নয়। তাই গাছগাছড়াও তারা ব্যবহার করল অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
এই অভিজ্ঞতা ও সঞ্চিত জ্ঞানের সাহায্যে চিকিৎসাবিদ্যার উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে। খ্রিস্টের জন্মের তিন শ বছর আগে, যদিও সেগুলোর সঙ্গে মিশে ছিল নানান অলৌকিক ধারণা ও বিশ্বাস। জাদুর প্রভাব। সে দেশও আবার এ বিদ্যা নিয়েছিল ব্যাবিলন, মিসর এবং ভারতীয় সভ্যতা থেকে। এই তিন অঞ্চলের বিপুল জ্ঞানভান্ডারের সারবস্তু নিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় গ্রিসে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিপোক্রেটিস। চিকিৎসক পরিবারে তার জন্ম। বাবা এসকুলাপিয়াসের কাছে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত করেন। পরে দেশ-বিদেশে ঘুরে তার যে বিপুল জ্ঞান সঞ্চয় হয়, তা দিয়ে তিনি থ্রেস, থেসালি ও মেসিডোনিয়ায় চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা করতেন। গ্রিসের একদল চিকিৎসক একটা সঙ্ঘ তৈরি করে। এসকুলাপিয়াড। এরা চিকিৎসা করতেন এবং ছাত্রদের শেখাতেন।
তখনকার দিনে চিকিৎসকেরা পুরোহিতের মতো মন্ত্র, তন্ত্র এবং নামমাত্র ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতেন। যুদ্ধের আহত রোগীদের নিয়ে চালাতেন সার্জারি। বিশেষ কোনো রোগের সব লক্ষণ খুঁটিয়ে দেখতেন না। পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। সেসবও মন্ত্র, তন্ত্র ও ডাকিনীবিদ্যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। গ্রিক ভাস্করের মতো দেহের বাইরের দিকটাই কেবল বুঝতেন, ভেতরের খবর রাখতেন না। হিপোক্রেটিসই প্রথম এদিকে দৃষ্টি দিলেন। রোগীর বিছানার পাশে বসে দিনের পর দিন রোগ পর্যবেক্ষণ করতেন। চোখ, মুখ, জিহ্বা ও শ্বাস-প্রশ্বাসের কী পরিবর্তন হয় তা খুঁটিয়ে দেখতেন। কিসে রোগীর যন্ত্রণা কমে, তার ব্যবস্থা দিতেন। এভাবে তার হাতে একালের চিকিৎসাবিদ্যার সূচনা ঘটে। ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের সৃষ্টি হয় সে সময়। যদিও তখন হিপোক্রেটিস অ্যানাটমি বা শারীরবিদ্যার কিছুই জানতেন না, তবু নিজের বুদ্ধিমত্তা ও পর্যবেক্ষণ শক্তি দিয়ে তিনি চিকিৎসার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির সূচনা ঘটান। একবার রাজধানী এথেন্সে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। হিপোক্রেটিস শহরের চারপাশে আগুন জ্বালিয়ে দেন। এতে প্লেগ রোগ ছড়াতে পারেনি। এসবই করেছিলেন তিনি বুদ্ধিমত্তার জোরে।
হাসপাতালে প্রত্যেক রোগীর বিছানার পাশে এখন একটি করে চার্ট ঝোলানো থাকে। তাতে লেখা হয় রোগের বিবরণ ও রোগীর দৈনন্দিন অবস্থা। তা থেকে রোগনির্ণয়, চিকিৎসা এবং তার পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। হিপোক্রেটিস এপিডেমিক নামের একটি পুস্তিকায় ঠিক একই পদ্ধতিতে ৪২ জন রোগীর ইতিহাস লিখেছিলেন। তিনি যা কিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন তাই লিখেছেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, একজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিফলতা থেকে অপরে শিক্ষা নিতে পারবে। ব্যর্থতার কারণ বুঝতে সক্ষম হবে। এটিই বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসাবিদ্যার ভিত্তি। আজও তাই শিক্ষার্থীরা তার নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
তবে, ধারণা করা হয়, পরবর্তীকালে চিকিৎসার সঙ্গে অলৌকিকতার যোগ রয়ে যাওয়ার কারণ হলো ধর্মযাজকদের তৎপরতা। মুসলমানদের মধ্যেও অনেক পীর-আউলিয়ার আশ্চর্যজনক ‘নিরাময় ক্ষমতা’ ছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। মানুষ রোগে আক্রান্ত হলে মাজারে গিয়ে মানত করে, পীরের পানি-পড়া পান করে, তাবিজ ঝোলায়। এসব বিশ্বাস অবশ্য ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান—সব ধর্মের লোকদের মধ্যে প্রচলিত। ‘মুসলিম সেইন্টস অব সাউথ এশিয়া : দ্য ইলেভেনথ টু ফিফটিনথ সেঞ্চুরি’ বইতে আনা সুভরভা লিখেছেন, মধ্য যুগে প্লেগে আক্রান্ত দিল্লির লোকেরা নিরাময়ের আশায় দল বেঁধে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার খিলজির মাজারে গিয়েছিল। ক্যাথলিক ইউরোপেও খ্রিস্টের অনুসারীদের মধ্যে রোগ সারাতে ওই ধর্মের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মহাত্মাদের কাছে যাওয়ার রীতি দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর ‘ক্যাথলিক হেরাল্ড’ পত্রিকায় ১৯ মার্চ ২০২০ সংখ্যায় ‘দ্য বেস্ট সেইন্টস টু প্রেডিউরিং আ পেনডেমিক’ শিরোনামে একটি চিত্তাকর্ষক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, মহামারি থেকে মুক্তির জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সন্ত হলেন সেইন্ট সি বা সটিয়ান। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হলো বিজ্ঞানবিমুখতা এবং সব রকম সুযোগ ও মানবিকতার চর্চা স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকা।
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, মৃত্যু অবধারিত জেনেও মানুষ বাঁচতে চায়। তাই নিরাময়হীন রোগে আক্রান্ত হলে তারা অসহায় হয়ে ওঠে। বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত উদ্্ঘাটন করে চলেছে প্রকৃতি-পৃথিবীর অজানা রহস্য। অনেক কিছুই রয়ে গেছে আবিষ্কারের বাইরে। জন্ম-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মানুষ অসহায়তা থেকেই আশ্রয় নেয় অলৌকিকতার। সমাধান নেই জেনেও অবচেতন মন তাতে স্বস্তি খুঁজে পেতে চায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে হয়তো মানুষ একটিা মানসিক শক্তি অর্জন করে, সেটি তার স্বাস্থ্যগত সামর্থ্যও বাড়িয়ে দেয় খানিকটা। তাতে কখনো কখনো ওষুধ-পথ্য ছাড়াই সাধারণ অসুস্থতার উপশম ঘটে, জটিল রোগ প্রতিরোধে হয়তো শারীরিক সক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু তা কিছুতেই বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার বিকল্প নয়।
তিন
পৃথিবীতে রোগের ভয়াবহ প্রকোপ বা মহামারি নতুন নয়। কখনো কখনো তার বিস্তার এত সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে যে তা মোকাবিলার ক্ষমতা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অন্যদিকে পুঁজির অসম বিকাশ এবং ভয়াবহ প্রতিযোগিতা যেকোনো অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সম্পর্কহীন সাধারণ জনগোষ্ঠীর পক্ষে এই শোষণ বোঝা বা ব্যাখ্যা করাও সম্ভব হয় না। ফলে তারা রোগ বা যেকোনো জটিল সমস্যা সমাধানে সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানের কাছে সহযোগিতা না পেয়ে আশ্রয় খোঁজে ধর্মে, অলৌকিক বিশ্বাসে কিংবা তুক-তাক, তাবিজ-কবচ ও ঝাড়ফুঁকের মতো সহজলভ্য গ্রামীণ ব্যবস্থার কাছে। এমনকি, অনেক সময় নাগরিক সমাজের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে এসবের আশ্রয় নিতে দেখা যায়।
কিন্তু এর কারণ কী? বিজ্ঞানের ইতিহাসে দেখা গেছে, অনেক আবিষ্কারই প্রথম দিকে রাষ্ট্র বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মেনে নেয়নি। কারণ, তারা সব সময় প্রথাগত ধারণা ও বিশ্বাসকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। যেমন গ্যালিলিও গ্যালিলি যখন তার ‘সূর্যকেন্দ্রিক’ গবেষণা শেষে তা প্রকাশ করেন, তখন ক্যাথলিক চার্চ তাকে সতর্ক করে—‘গণিত নির্ভর যেকোনো তত্ত্ব নিয়ে তুমি কাজ করতে পারো, তবে সাবধান—কোনো মতেই তা যেন ‘স্বর্গীয়’ ধারণার বিপরীতে না যায়।’ গ্যালিলিও তার মতবাদকে ¯্রফে তত্ত্ব হিসেবে হাজির করেননি, বরং অসাধারণ যুক্তির অবতারণা করে বলতে চেয়েছেন, এটিই ‘সত্য’। ক্যাথলিক চার্চের কর্তাব্যক্তিরা তাকে রোমে ডেকে পাঠান, ধর্মদ্রোহী হিসেবে তার বিচার শুরু হয়। দোষ প্রমাণিত হলে মৃত্যু অবধারিত। তিনি জীবন বাঁচাতে নিজের তত্ত্বকে ভুল বললেন। তার এই স্বীকারোক্তিতে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে চার্চ। শাস্তি হিসেবে তাকে ফ্লোরেন্সে নিজের বাড়িতে আজীবন অন্তরীণ রাখার আদেশ দেওয়া হয়। পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে তিনি নতুন বিজ্ঞান নিয়ে অসাধারণ বই লেখেন। সেটি কৌশলে পাচার করা হয় ইতালির বাইরে। বইটিতে তিনি লিখে গেছেন তার সারা জীবনের পর্যবেক্ষণ।
যে প্রশ্ন বা আবিষ্কার সভ্যতা বদলে দেয়, সেসবে চিরকাল ভয় পেয়েছে সমাজপতিরা। নিজেদের শাসন ও শোষণ জারি রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ধর্ম, অলৌকিক বিশ্বাস এবং মানুষের বিজ্ঞানবিমুখতা। তারাই বিষপাত্র তুলে দিয়েছিল সক্রেটিসের হাতে, পুড়িয়ে মেরেছিল জিওর্দানো ব্রুনো ও গণিতবিদ হাইপেশিয়াকে। উত্ত্যক্ত করা হয়েছিল শেকসপিয়ারকে, বারবার নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল ভলতেয়রকে [প্রকৃত নাম জাঁ মারি আরুয়ে], দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ভিক্টর হুগো, রম্যাঁ রলাঁ। নাম করা যায় এমন অনেকের। এরা কেউ চিকিৎসাবিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নন—বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, দার্শনিক, সাহিত্যিক। প্রত্যেকের চিন্তা সমাজকে বদলে দিয়েছিল। এসব আবিষ্কার ও যুক্তিবাদী চিন্তাগুলো সাধারণ মানুষের জীবনকে মানবিক, সুস্থ ও সুন্দর করে তোলার কাজে অগ্রসর ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু প্রচলিত ও প্রথাবদ্ধ সমাজ তা মেনে নেয়নি; বরং সেগুলোর বাইরে রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ধর্ম ও অলৌকিক বিশ্বাসকে শোষণের হাতিয়ার করে তোলা হয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ সিনেমায় মনোমোহন মিত্রের সংলাপে জানা যায়, পৃথিবীর আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর কাছে রয়েছে অন্তত পাঁচ শ ওষুধ তৈরির কৌশল। কিন্তু সেসবই তারা প্রস্তুত করে তাদের প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে, বংশপরম্পরার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। চিকিৎসার জন্য তাদের নাগরিক হাসপাতালে যেতে হয় না। সিনেমায় দেখানো হয়েছে, মানুষের এই যে ভৌত জ্ঞান, প্রকৃতিনির্ভরতা, হাজার বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা—তার মূল্য কম নয়। মানুষ যখনই প্রকৃতির শৃঙ্খলা বুঝতে অস্বীকার করেছে, ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়েছে, তখনই ঘটেছে বিপর্যয়।
চার
রচনার শুরুতে আদিম মানুষের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যে কাহিনি বলা হয়েছে, সেগুলোই ছিল মূলত তাদের জিজ্ঞাসু মনের পরিচয়। এসব প্রাকৃতিক জ্ঞানই দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে পরিশীলিত হয়েছে। ধীরে ধীরে ঝরে পড়েছে অলৌকিক বিশ্বাস। মানুষ আবিষ্কার করেছে শরীরের যাবতীয় শৃঙ্খলা—বাইরের এবং ভেতরের। সেসব পরীক্ষা ও রোগনির্ণয়ের জন্য বানিয়েছে নানান যন্ত্র। সংযোজন করছে কৃত্রিম অঙ্গ। জীবন সুস্থ রাখতে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে প্রতিদিনই।
মানুষ প্রকৃতিরই অংশ। অঙ্কুরোদ্গমের পর গাছ যেভাবে বেড়ে ওঠে এবং মারা যায়, তাতে কোনো দৈব বিশ্বাস নেই। আছে নিয়ম, যুক্তি। প্রবল ঝড়ের তান্ডব থেকে গাছ নিজেকে রক্ষা করে মাটির গভীরে শিকড় ছড়িয়ে। মানুষও সেভাবে রোগ-শোক থেকে রক্ষার জন্য আশ্রয় নেয় বিজ্ঞানের, চিকিৎসার নতুন নতুন পদ্ধতির। সেখানেই তার সুস্থতা ও মানবিক জীবনের মুক্তি।
কভার: অন্তরা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: কুহু’স ওয়্যারেবল আর্ট
ছবি: জিয়া উদ্দিন ও সংগ্রহ