হেরিটেজ I সোনামসজিদের ইতিবৃত্ত
ষোড়শ শতাব্দীর স্থাপত্যকীর্তি। তাতে দেখা যায় বাংলার প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিদর্শন
গৌড়, প্রাচীন বাংলার রাজধানী, এখন দু-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে উভয় বাংলায়। গত সংখ্যায় ওপার বাংলার মালদার কথা বলেছিলাম। এবারে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসা যাক।
ভারত-বাংলাদেশের সীমানায় ছোট সোনামসজিদ-মাহদিপুর সীমান্তে যে কোতোয়ালি গেট, তার এপারে সুলতানি যুগের রাজধানী গৌড়ের শহরতলি এলাকা—ফিরোজাবাদ মহল্লা। বাংলাদেশের অংশ। ওপারে গৌড়ের মূল দুর্গ নগর। তবে শহরতলি হলেও এককালে এর গুরুত্ব এবং জৌলুশ যে কম ছিল না, তা সহজেই চোখে পড়ে এখানকার টিকে থাকা স্থাপনাগুলোর দিকে নজর দিলেই।
ঢাকা থেকে কানসাট হয়ে সীমান্ত এলাকায় যেতে প্রথমেই চোখে পড়ে সুলতানি আমলের সেরা কীর্তি ছোট সোনামসজিদ। ইটের তৈরি এই স্থাপনার দেয়ালে প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল পাথরের। সেগুলো ছিল বিচিত্র নকশা কাটা। মসজিদে ঢুকতে হয় পূর্ব দিকের গেট দিয়ে। এই প্রবেশ দ্বারও দেখতে বড় সোনামসজিদের মতো। তবে সেখানে ঢোকার আগে বেশ কয়েকটি পুরোনো পাকা কবরের দেখে মেলে। দুটো বেশ বড় ও উঁচু। কবর দুটো নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে গল্প প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই বলেন, এটি মসজিদের নির্মাতা ও তার বাবার সমাধি। কিছু মানুষের ধারণা, এখানে মসজিদের নির্মাতা লুকিয়ে রেখেছেন তার সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ। কালো পাথরের মঞ্চের ওপর শবাধারে কবরের যে আচ্ছাদন, তাতে নাসখলিপিতে আল্লাহর কয়েকটি নাম, কলেমা এবং গোলাপ ফুল উৎকীর্ণ। নামাজঘরের চত্বরে ঢোকার পর চোখে পড়ে দুটো কবর, পূর্ব-দক্ষিণের কোনায়। নতুন টাইলস লাগানো। বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক সেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত।
মসজিদের চার কোনায় চারটি করে আট কোনা বুরুজ, বাঁকা আলিসা সুলতানি আমলের অন্য নামাজঘরগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে আধা গোলাকার ১২টি আর মাঝের সারিতে ৩টি চৌচালা আকৃতির গম্বুজ। এককালে এগুলো ছিল সোনার গিল্ড করা। তাই এর নাম সোনামসজিদ। দুর্গের ভেতরে আরেকটি সোনামসজিদ ছিল, তাই এর আগে ‘ছোট’ উপসর্গটি যোগ হয়ে যায়। মসজিদটির পশ্চিম দেয়ালের বাইরের দিকে তেমন নকশা নেই, কেবল মূল মিহরাবের অংশটা খানিকটা উত্তল। উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দেয়ালে তিনটি করে খিলান জানালা আর পূর্ব দেয়ালে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর পাঁচটি প্রবেশ তোরণ। পূর্ব দেয়ালের নকশা অপূর্ব, মিহরাবের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মূল দরজার ঠিক মাঝখানে ওপরে একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, মসজিদটি তৈরি হয়েছিল সুলতান হোসেন শাহের আমলে, আর নির্মাতা ছিলেন মজলিশুল-মজলিশ মনসুর ওয়ালি মুহাম্মাদ। স্থাপনার ভেতরে উত্তর কোণে দোতলায় এক মঞ্চে ছিল মহিলাদের নামাজ পড়ার জায়গা, যেখানে ঢোকার জন্য উপাসনালয়ের বাইরের দিকে একটি সিঁড়িও ছিল। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এই মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়, তখনই এর মূল মিহরাব নিয়ে যাওয়া হয় যুক্তরাজ্যে, যেটি এখন স্কটিশ মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে।
সেখান থেকে গ্রামের মেঠো পথ ও ধানি জমি ধরে খানিকটা এগিয়ে গেলেই দুটো কালভার্ট দেখা যায়। সেচকাজের জন্য তৈরি হয়েছিল এগুলো। সুলতানি আমলে বাংলার কৃষি কতটা যুগোপযোগী ছিল, তার প্রমাণ এ দুটো। প্রধান সড়কে উঠতে উঠতেই দেখা যায় তঙ্কতলা দিঘির পাশে বাঁশঝাড়ে একটি পাথরের চেরাগদানি। জানা যায়, একটি কবর এবং মসজিদও ছিল সেখানে, তবে সেগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় না। খানিকটা এগিয়ে প্রধান সড়কের লাগোয়া একটি গেরস্থ বাড়ির রসুইঘরে মিলল আরেকটি কবরাচ্ছাদন। গায়ে নাস্তালিক লিপিতে আল্লাহর বিভিন্ন নাম উৎকীর্ণ। এই লিপির সূত্র ধরে সমাধিটির সময়কাল ষোড়শ শতাব্দীতে নিয়ে যাওয়া যায় সহজেই। মূল সড়ক পেরিয়ে শাহ নিয়ামতউল্লাহ মাজার কমপ্লেক্স; বাংলাদেশ অংশের গৌড়ে টিকে থাকা একমাত্র মোগল নিদর্শন।
প্রথমেই চোখে পড়ে শাহ সুজার তাহখানা। এই শাহজাদার সঙ্গে শাহ নিয়ামতউল্লাহ ওয়ালীর সম্পর্ক নিয়ে নানা লোকশ্রুতি রয়েছে এলাকায়। বলা হয়, শাহ সুজা যখন তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তখন এই তাহখানায় অবস্থান করতেন। এখন এই তাহখানাকে জাদুঘরে রূপান্তরের কাজ চলছে। এখানে নামাজ আদায়, ক্ষৌরকর্ম, বিশ্রাম, গোসল, খাওয়া, বৈঠক—সবকিছুর জন্যই আলাদা ঘর ছিল। লাগোয়া দিঘি থেকে পানি সরবরাহের ব্যবস্থাও ছিল। এটা ছাড়িয়ে তিন গম্বুজের মসজিদ। আশপাশের নামাজ ঘরগুলো থেকে পুরো আলাদা, মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে সহজেই পার্থক্য চোখে পড়ে। ইট, সুরকি-চুন দিয়ে তৈরি মসজিদের গায়ে প্রলেপটাও চুনের। আর তাতে গভীর খাঁজকাটা কুলুঙ্গি আকৃতির নকশা, ড্রামের ওপর বসানো গম্বুজ, চার কোনার মিনার মোগল ঘরানার। সামনে যে চত্বর, সেটাও জালি দিয়ে ঘেরা, সচরাচর বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে এমনটি বেশি দেখা যায় না। একদম শেষ প্রান্তে রয়েছে এক গম্বুজের শাহ নিয়ামতউল্লাহ ওয়ালীর মাজার। তিনটি করে খিলান দরজা রয়েছে চারদিকে। চার কোণের বুরুজগুলো অনুগম্বুজে শেষ হয়েছে। মধ্যখানের ড্রামের ওপর স্থাপিত মূল গম্বুজের চূড়ায় রয়েছে কলসের মতো দেখতে দন্ড। ইমারতের মাঝখানের কোঠায় শায়িত আছেন নিয়ামতউল্লাহ ওয়ালী। মাজারের সামনের চত্বরেও বেশ কিছু প্রাচীন কবর রয়েছে, সব কটিই নিয়ামতউল্লাহর শিষ্য ও পরিবারের বলেই জানা যায়। সেগুলোর একটায় রয়েছেন সিয়ার-উল-মুতাখখারিন বইয়ের রচয়িতা মীর গোলাম হোসেন খান।
এরপর বেশ খানিকটা দূরে দারাসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা। নামাজঘরটি অনেক আগে থেকে দেখা গেলেও মাদ্রাসাটি পাওয়া গেছে ১৯৭৫ সালের খননে। এর দুই বছর আগে দারাসবাড়ি মসজিদের সামনে থেকে উদ্ধার করা একটি শিলালিপির সূত্রে এটি পাওয়া যায়। তুঘরালিপিতে আরবি ভাষায় সেখানে লেখা হয়েছিল যে ১৫০৪ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এখানে একটি দারাসবাড়ি বা মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। মাদ্রাসার ভূমি-নকশা দেখলে অনেকটাই এখানকার বিহার স্থাপত্যের কথা মাথায় আসতে পারে। বাংলাদেশের ভূখন্ডে এটিই সবচেয়ে প্রাচীন মাদ্রাসার নিদর্শন। খানিক দূরে পুকুর পেরিয়ে মসজিদ। ১৪৭৯ সালে সুলতান শামসুদ্দিন আবুল মুজাফফার ইউসুফ শাহ এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায় এখানে পাওয়া তুঘরালিপিতে উৎকীর্ণ আরবি শিলালিপি থেকে। ২৪টি অর্ধবৃত্তাকার ও চারটি চৌচালা আকৃতির গম্বুজ নিয়ে এই উপাসনালয়। বারান্দাও ছিল পূর্ব দিকে। এমন ভূমি পরিকল্পনায় তৈরি মসজিদের এটিই একমাত্র উদাহরণ। নামাজের ঘরটি সারিবদ্ধ পাথরের থাম দিয়ে তিনটি আইল ও সাতটি বে-তে বিভক্ত। অধিকাংশ পাথরের থাম এখনো দাঁড়িয়ে। একদম উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে নারীদের নামাজ পড়ার জায়গা। সাতটি মিহরাব রয়েছে এখানে। মাঝেরটি সবচেয়ে বড়, আর বাকি দুদিকের মোট ছয়টি একই আকৃতির। ফুল, লতাপাতা, শিকল-ঘণ্টা, দড়ি, দাঁত, দাবার ছক, বরফির নকশাই বেশি।
দারাসবাড়ি থেকে বেশ দূরে রয়েছে রাজবিবি মসজিদ। এর আরও দুটো নাম প্রচলিত—চিকা মসজিদ ও খনিয়াদিঘী মসজিদ। পূর্ব দিকে বারান্দায় তিনটি আর মূল নামাজ কক্ষের ওপর একটি বড় গম্বুজ ছিল। তিনটি মিহরাবের ভেতর মাঝেরটি বড়, কারুকাজময় পাথরের, যদিও উপাসনালয়টি ইটের তৈরি। এর বিভিন্ন অংশে চমৎকার সব টেরাকোটার কাজ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে শিলালিপি থাকলেও সেখানে নির্মাতা বা নির্মাণকাল—কিছু নেই। তবে ধারণা করা হয়, পনেরো শতকে তৈরি হয়েছিল এই স্থাপনা। এক কিলোমিটার দূরে ধুনিচক মসজিদ। একটা সময়ে এই উপাসনালয়ের উত্তর ও পশ্চিমের দেয়ালের অংশ ছাড়া কিছুই ছিল না। পুরো স্থাপনাটিই প্রায় নতুন করে তৈরি। সে সময়ের মতো করেই নতুন সব টেরাকোটা নকশা বানিয়ে এখানে লাগানো হয়েছে।
এ ছাড়া এই এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আরও নানা প্রত্নস্থল, প্রত্নসামগ্রী। কিছু হয়তো বেরিয়ে আসছে আর কিছু কালের গর্ভে বিলীন হচ্ছে। এলাকার মানুষের সঙ্গে সকালবেলায় বেগুন ভর্তা দিয়ে কালাই রুটি বা চা খেতে খেতে এখানকার মিথগুলো শোনাটাও কম আনন্দের নয়।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক