ফিচার I ডাইনিং এটিকেট
ভোজনে ব্যক্তির রুচিবোধ বোঝা যায়। কীভাবে খেতে হয়, তা জানা ও চর্চার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিত্বের সামাজিক প্রকাশ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
খাবার টেবিলের ম্যানার বা আদব-কায়দা একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব প্রকাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
দেশ, জাতি, সংস্কৃতিভেদে খাবার টেবিলের আদব-কায়দার প্রকারভেদগুলো আলাদা হয়ে থাকে। তবে কিছু নিয়ম আছে, যা সব জায়গার জন্যই প্রযোজ্য। এই এটিকেটগুলো ব্যক্তিত্বেরই বহিঃপ্রকাশ। ফলে আপনি আমন্ত্রণকারী হোন অথবা অতিথি, খাবার টেবিলে অবস্থানের সময় এই আচারগুলো মেনে ভদ্রতা বজায় রাখা খুবই জরুরি।
বিয়েবাড়ি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায়, ভোজনের সময় কেউ কেউ এমনভাবে খাওয়া শুরু করে, যেন প্রতিযোগিতা চলছে। দাওয়াতে গেলে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে আনুষ্ঠানিক খাবারের টেবিলে সবার জন্য কতটুকু খাদ্য রাখা হয়েছে।
আগেই ইচ্ছেমতো নিজের প্লেটে সব খাবার তুলে না নিয়ে অন্যদের প্রয়োজনও মাথায় রাখতে হবে। প্রথমে নিজের জন্য অল্প কিছু অংশ তুলে নিয়ে তারপরে সবার নেওয়া হয়ে গেলে আবার নেওয়া যেতে পারে। কোথাও দাওয়াতে গেলে একজন অতিথির উচিত আপ্যায়ককে অনুসরণ করা, তাই নিজের ইচ্ছেমতো চেয়ার টেনে বসে না পড়ে অপেক্ষা করা উচিত। আপ্যায়ক কোথায় বসতে বলছেন, সেই অনুযায়ী বসা শোভনীয়।
টেবিলে যে খাবারের পদটি খেতে চাইছেন, খেয়াল রাখতে হবে তা হাতের নাগালের মধ্যে আছে কি না। যদি না থাকে, সে ক্ষেত্রে পাত্রটির কাছে থাকা মানুষটিকে অনুরোধ করতে হবে তা এগিয়ে দেওয়ার জন্য। অন্যকে টপকে বা খাবার টেবিলে ভর দিয়ে পাত্র টেনে নেওয়া অশোভন। তবে নাগালের মধ্যে থাকলে নিজেকেই নিতে হবে। খাওয়া বাকি, এমন পদগুলো বামে রেখে শেষ হয়ে যাওয়া পদগুলো ডানে রেখে দিতে হবে।
একেক পদের জন্য টেবিলে আলাদা চামচ-প্লেট রাখা থাকে। কোনটির কী ব্যবহার, তা আগে জেনে নেওয়া জরুরি। সবচেয়ে বাইরের দিকে থাকা চামচ বা প্লেট আগে ব্যবহার করে আস্তে আস্তে ভেতরের গুলোর দিকে আসতে হয়। এ ব্যবহারগুলো সম্পর্কে যদি কারও জানা না থাকে, তবে ঘাবড়ে না গিয়ে হোস্টকে অনুসরণ করা বুদ্ধিমানের কাজ।
খাবার টেবিলে ন্যাপকিন ব্যবহার করা ভালো। রেস্টুরেন্টগুলোতে ন্যাপকিন অথবা টিস্যু পরিবেশন করা হয়ে থাকে। সেটি কোলের ওপর বিছিয়ে খাওয়া শুরু করতে হবে। মুখে খাবার লেগে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ন্যাপকিন বা টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলা উচিত। নইলে তা টেবিলে বসা অন্যদের কাছে অরুচিকর লাগতে পারে। খাওয়ার মাঝে টেবিল ছেড়ে কোথাও গেলে ন্যাপকিনটি চেয়ারের ওপর রেখে যেতে হয়। শেষ হলে সেটি টেবিলে নিজের স্থানের বাম পাশে রেখে দিতে হবে।
ঢাকা শহরে জায়গার অভাবের কারণে অধিকাংশ মানুষ রেস্টুরেন্টেই খেতে খেতে আড্ডা দিয়ে থাকেন। খেতে বসে আড্ডা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, মুখে খাবার থাকা অবস্থায় যেন কথা বলা না হয়। তা না হলে মুখ থেকে খাবার ছিটকে পড়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। এতে খাবার টেবিলের মনোরম পরিবেশ নষ্ট হবে।
হাঁচি বা কাশির নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যখন-তখন যে কারোরই এই উপদ্রব ঘটতে পারে। টেবিলে বসার পর হাঁচি বা কাশি পেলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে হয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মুখে রুমাল বা হাত দিয়ে ঢেকে নেওয়া জরুরি। এ ছাড়া ঢেকুর তোলাও অতি পরিচিত একটি অভ্যাস। কিন্তু খাবার টেবিলে অন্য সবার সামনে তা এলে মুখ ঢেকে নিতে হবে। সে সময় আশপাশে থাকা সবার উদ্দেশে ‘এক্সকিউজ মি’ বলা ভদ্রতা। আবার কেউ কেউ আছেন যারা দাঁতে খাবার আটকে গেলে তা টেবিলে বসে বের করার জন্য খোঁচাখুঁচি শুরু করে দেন। এটি খুবই বিব্রতকর আচরণ। আটকে থাকা খাবার বের করার সময় অবশ্যই মুখের সামনে হাত দিয়ে আড়াল করে অপর হাতের সাহায্য নেওয়া উচিত।
শব্দ করে খাবার চিবানোর প্রবণতা দেখা যায় কারও কারও মধ্যে। খেতে বসে পাশে বসা মানুষটি শব্দ করে খেলে অনেকেরই খাওয়ার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, চিবোনোর শব্দেও অনেকে রুচি হারিয়ে ফেলতে পারে। মুখ বন্ধ রেখে খেলেই এ শব্দ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। খাবার চিবানোর সময় তাই এ বিষয়ে সতর্কতা জরুরি।
শুধু খাবার চিবানোর শব্দই যে বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়, তা নয়। প্লেট, বাটি নেওয়ার সময় সেসবের অতিরিক্ত আওয়াজও বিরক্তির কারণ ঘটিয়ে থাকে। ফলে এসব ব্যবহারের সময় শব্দ যেন না হয়, তা মাথায় রাখতে হবে। এ ছাড়া আওয়াজ করে চুমুক দেওয়া, হাত না ধুয়েই খেতে বসা, দাঁত খিলানো- এগুলোও অশোভনীয়। অনেকেই আছেন, যারা খাওয়া শেষে প্লেটে হাত ধুয়ে ফেলেন এবং ভেজা হাত পরনের কাপড়ে মুছে ফেলেন। এগুলো কোনো অবস্থাতেই করা উচিত নয়।
রেস্টুরেন্টে অথবা দাওয়াতে খেতে গেলে অবশ্যই ছুরি-চামচের ব্যবহার জেনে রাখা দরকার। এ দুটি এবং প্লেটের অবস্থান নির্দেশ করে, কে কতটা কেতাদুরস্ত। খাবার টেবিলে নিজেকে মার্জিতভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে এসব জিনিস জানা গুরুত্বপূর্ণ। রেস্টুরেন্টে ছুরি-চামচ, প্লেটের মাঝে কোনাকুনি করে রাখার অর্থ হচ্ছে, আপনি খাওয়ার মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছেন। যোগচিহ্নের মতো রাখলে বোঝায়, আপনার প্লেট খাওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং সেই হিসেবে ওয়েটার খাবার সরবরাহ করবে। আবার আড়াআড়িভাবে সমান্তরাল বা পাশাপাশি রাখলে তা বোঝাবে, খাবার খুবই পছন্দ হয়েছে। উল্লম্বভাবে সমান্তরাল করে বা পাশাপাশি লম্বালম্বি রাখলে বোঝায় খাওয়া শেষ। ওয়েটার আপনার প্লেটটি নিয়ে যেতে পারেন। ছুরি-চামচ একটির ভেতর অপরটি, মূলত কাঁটাচামচের ভেতর ছুরি গেঁথে কোণ তৈরি করে রাখার অর্থ খাওয়া শেষ, কিন্তু খাবার একেবারেই পছন্দ হয়নি।
এ ছাড়া ছুরি-চামচ কীভাবে ধরতে হয়, সেগুলোরও ভিন্ন নিয়ম আছে। কন্টিনেন্টাল পদ্ধতিতে ডান হাতে থাকবে ছুরি আর বাম হাতে কাঁটাচামচ। ডান হাতের ছুরি প্লেটের কাছে ধরে রাখতে হবে। আর বাম হাতের কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার মুখে পুরে দিতে হয়। এ সময় লক্ষ রাখা দরকার, কাঁটাচামচটি যেন প্লেটের দিকে ঘোরানোই থাকে। আমেরিকান পদ্ধতিতে কাঁটাচামচ ডান হাতে নিয়ে খেতে হয়। কন্টিনেন্টাল নিয়মে খাবার মাঝে বিরতি নিলে ছুরির ধারালো অংশটি প্লেটের দিকে মুখ করে রাখতে হবে। আর কাঁটাচামচ উল্টিয়ে আড়াআড়িভাবে ছুরির ওপরে রাখতে হয়, যেন ছুরি ও কাঁটাচামচ ক্রস আকৃতির হয়ে থাকে। আমেরিকান পদ্ধতিতে চামচ আর ছুরির অবস্থান একটু আলাদা। এখানে চামচের কাঁটা অংশ না উল্টিয়ে ওপরের দিকে মুখ করে আর ছুরির ধারালো প্রান্তটি নিজের দিকে ফিরিয়ে রাখতে হবে। ছুরি আর চামচের অবস্থান হবে কোণাকৃতির।
আনুষ্ঠানিক কোনো দাওয়াতে খাবার টেবিলে এসব আদব-কায়দা মেনে চললে যে কারও ব্যক্তিত্ব অন্যের কাছে মার্জিত ও আকর্ষণীয় হতে বাধ্য।
ছবি: সংগ্রহ