ফিচার I মাংসপ্রণালি
গো-মাংসপ্রীতি অনেকেরই আছে। তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকিও কম নয়। তবে তা এড়ানোর উপায় আছে। লিখেছেন মোহাম্মদ বোরহান উদ্দীন
রেড মিট বা লাল মাংস জনপ্রিয় একটি খাবার। গরু, ছাগল কিংবা মহিষের মাংস রেড মিট হিসেবে পরিচিত। এসবে প্রচুর আমিষ, খনিজ পদার্থ ও কোলেস্টেরল থাকে। বাড়ন্ত বয়সের শিশু, কিশোর, তরুণ এবং গর্ভবতী মায়েদের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি মেটাতে পরিমিত রেড মিট খাওয়া জরুরি। তবে এগুলোতে প্রচুর কোলেস্টেরল থাকায় তা খাওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে।
প্রবীণ এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের রেড মিট খাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। বয়স ত্রিশের নিচে, রক্তে কোলেস্টেরল মাত্রা ঠিক আছে, বাড়তি মেদ নেই এবং ওজনও স্বাভাবিক, তাদের জন্য লাল মাংসে ততটা অসুবিধা নেই।
ঈদে পশু কোরবানি দেওয়ার কারণে প্রচুর মাংস খাওয়া হয়ে থাকে। ঘরে থাকলেই যে প্রতি বেলায় তা প্রচুর খেতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। হুট করে বেশি মাংস পাকস্থলীর পরিপাক ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে যেকোনো বয়সের মানুষের হজমের সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, হৃদ্্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির জটিলতা এবং রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির জটিলতা থাকলে এসব মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই সাবধান হতে হবে।
অনেকে মনে করেন, রেড মিট মানেই ক্ষতিকর। কিন্তু এর অনেক উপকারী দিকও আছে। মূলত এসব মাংসের চর্বিই হচ্ছে ক্ষতিকর অংশ। খাওয়ার পর এই ফ্যাট রক্তে বাসা বাঁধে, বেড়ে যায় কোলেস্টেরল। তাই পূর্ণ সুফল পেতে চাইলে মাংস থেকে চর্বি বাদ দিতে হবে। একই সঙ্গে জানতে হবে রান্নার সঠিক পদ্ধতি। তা জানা থাকলে রান্নার পরও মাংসের পুষ্টিমান বজায় থাকে। রেড মিটে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, আয়রন, জিংক আছে, যেগুলো শরীরের জন্য উপকারী।
এতে আরও রয়েছে প্রচুর আমিষ; ভিটামিন ও মিনারেল। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি হাড়, দাঁত ও মাংসপেশিকে সুগঠিত করতে সহায়ক। অন্যদিকে রক্তস্বল্পতা দূর এবং শরীরে শক্তি সরবরাহ করে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে রেড মিট বা লাল মাংসে এমন অনেক পুষ্টি থাকার পরেও অতিরিক্ত খেলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে হজমে সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক, পেট ব্যথা এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে পারে পাইলসে আক্রান্ত রোগীরা। অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে রক্তনালিগুলোয় চর্বির পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে রক্তসঞ্চালনের মাত্রা কমে যাওয়ায় যে কারও রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
পুষ্টিবিদদের পরামর্শমতে এক দিনে ৮৫ গ্রাম রেড মিট খাওয়া যেতে পারে, যা মাঝারি সাইজ পাউরুটির টুকরার মতো হবে। সেই সঙ্গে মাংস অবশ্যই নিয়ম মেনে খাওয়া দরকার। খাবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত স্যালাড ও সবজি রাখতে হবে। এটি হজমপ্রক্রিয়াকে সহজ করবে। সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত পানি খেতে হয়। তা পরিপাকে সাহায্য করে।
নিয়ম মেনে রেড মিট রান্না করলে এর ঝুঁকির দিকগুলো কমে আসে। স্বাস্থ্যকর উপায়ে মাংস খাওয়ার নিয়ম রয়েছে:
শারীরিক পরিস্থিতি, বয়স এবং স্বাস্থ্য বুঝে মাংস পরিমিত হারে খেতে হবে। পরিমাণের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ রাখাটা সবার জন্যই জরুরি। তিন বেলা মাংস না খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে রাতের খাবারে রেড মিট এড়িয়ে চলাই ভালো।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় মাংস বেশিক্ষণ বাইরে রাখলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। ফলে কোরবানির মাংস বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা ভালো করে ধুয়ে রক্ত পরিষ্কার করে রান্না অথবা ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। বাজার থেকে মাংস আনার পরও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা জরুরি। ফ্রিজে সংরক্ষণ করা সম্ভব না হলে সঠিকভাবে মাংস জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে এবং তা ছয় ঘণ্টা পরপর পুনরায় জ্বালিয়ে নিতে হয়।
রান্নার আগে মাংসের চর্বি কেটে আলাদা করে ফেলতে হবে। এ ছাড়া মাংসের ভেতরে যে চর্বি আছে, সেটা গলাতে গরম পানিতে মাংস সেদ্ধ করে নেওয়া যেতে পারে। রান্নার আগে মাংসের টুকরাগুলো ছোট করে কেটে টক দই, লেবুর রস, সিরকা, পেঁপে বাটা দিয়ে মেখে রাখলে কম সময়ে তা সেদ্ধ হয়, অন্যদিকে চর্বির ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই কাটানো যায়।
মাংস অল্প তেলে রান্না করতে হবে। অলিভ অয়েল হলে সবচেয়ে ভালো। এ ছাড়া উচ্চ তাপে রান্না করলে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে না। সবচেয়ে ভালো হয় আগুনে ঝলসে খেতে পারলে। আধা সেদ্ধ মাংস বা স্টেক এড়িয়ে চলাই ভালো। একদিনে কয়েক পদের রেড মিট রান্না না করে প্রতি বেলায় যথেষ্ট সবজি অথবা স্যালাড রাখা দরকার। কারণ, সবজিতে থাকা ফাইবার মাংসের চর্বি হজমে সাহায্য করবে। এ ছাড়া সবজি থাকার কারণে মাংস খাওয়ার পরিমাণও কিছুটা কমানো যায়। গরুর মগজ, কলিজা, ঝোল বা স্টকে সবচেয়ে বেশি চর্বি থাকে, তাই সেগুলো পরিমিত খাওয়াই ভালো। মাংসের তৈরি ভাজা আইটেমে তেল বেশি মনে হলে, খাওয়ার আগে টিস্যুতে বাড়তি অয়েল শুষে নেওয়া যেতে পারে।
মাংসের পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, ফলের রস, ইসবগুলের ভুসি ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি করে খাওয়া দরকার। অনেকেই হজমপ্রক্রিয়া বাড়ানোর জন্য কোমল পানীয় পান করেন, যা একেবারেই উচিত নয়। খেয়াল রাখতে হবে, পরিমিত খাদ্য, পর্যাপ্ত আঁশজাতীয় খাবার এবং পানিই কেবল শরীরকে সুস্থ রাখতে পারে। এ সময় পেটের সমস্যা হতে পারে, এ জন্য স্যালাইন রাখা জরুরি। পেটে গ্যাসের সমস্যা হলে মুক্তি পাওয়ার সহজ ঘরোয়া সমাধান হলো আদা খাওয়া। প্রতি বেলা মাংস খাওয়ার পর এক টুকরা আদা মুখে নিয়ে চিবিয়ে খেলে পেটে গ্যাস জমবে না।
কাঁচা আদা চিবিয়ে খেতে না পারলে আদার চা পান করা যেতে পারে। বড় এক টুকরা আদা ছেঁচে পানিতে ফুটিয়ে নিতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে নামিয়ে নিতে হয়। কুসুম গরম থাকতে পান করা যাবে। দিনে দুই বেলা পান করলে উপকার মিলবে। গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা হলেই ওষুধ সেবন ঠিক না। সহনীয় গরম পানিতে আধা কাপ লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যথা কমে যাবে। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি পানের অভ্যাস বাদ দিতে হবে। এতে খাবার ভালো হজম হয় না। আর গ্যাসে পেট ফেঁপে যায়। অস্থির লাগে। খাবারের আধা ঘণ্টা পরে পানি পান করা ভালো। খুব প্রয়োজন হলে খাবারের মাঝে এক ঢোঁক পানি পান করা যেতে পারে।
পেট ফাঁপা সমস্যায় কাঁচা রসুন উপকারী। এই মসলা মলাশয়ে জীবাণু বৃদ্ধিকে বাধা দেয়। কয়েক কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে পেট ফাঁপা কমে যাবে। বদহজমের জন্য ১ কাপ পানিতে ১ টেবিল চামচ সাদা ভিনেগার ও ১ চা-চামচ মধু মিশিয়ে পান করলে উপকার মিলবে। বেকিং সোডা বদহজম সমস্যা দূর করতে খুবই কার্যকর। আধা গ্লাস পানিতে আধা চা-চামচ বেকিং সোডা মিশিয়ে পান করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কুসুম গরম পানিতে সামান্য লবণ মিশিয়ে পান করলেও বেশ উপকার মেলে।
ছবি: ইন্টারনেট