আলাপন I আমি ভালো অভিনয়ের সুযোগ খুঁজি-শর্মিলী আহমেদ
প্রকৃত নাম মাজেদা মল্লিক। তার অভিনয় শুরু ষাটের দশকে। তিয়াত্তর পেরিয়েছেন তিনি। রুপালি পর্দায় একসময়ের নায়িকা। এখন মায়ের কিংবা অন্য যেকোনো বয়োজ্যেষ্ঠ চরিত্রে সপ্রতিভ। নিজের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন মাহমুদ রানার সঙ্গে
ক্যানভাস: এখন কেমন আছেন আপনি?
শর্মিলী আহমেদ: বয়সের ভারে কখনো বসে থাকিনি ঘরে, অথচ এখন চার দেয়ালে বসিয়ে রেখেছে করোনা পরিস্থিতি। আমি আপাতত তেমন কাজ করছি না। বাসাতেই সময় কাটে। গত ১০০ বছরে এ রকম অবস্থা দেখেনি কেউ। যুদ্ধের সময়টাও এখনকার সময়ের চেয়ে ভিন্ন ছিল। এ কিসের মধ্যে পড়লাম, বুঝতে পারছি না। সব দুর্যোগেই অভিনয় করেছি। বন্যা, হরতাল, বাজে আবহাওয়া—কোনো কিছুতেই অভিনয়ে ছেদ পড়েনি। কিন্তু দেড় বছর ধরে পরিস্থিতি ভিন্ন। ঈদের অনেক নাটকের প্রস্তাব এসেছিল। বাদ দিয়েছি। কারণ, এই বয়সে রিস্ক নেওয়া ঠিক না। আর এই অবস্থায় শুটিং কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এখন আমি ঘরে থাকি বেশি সময়।
সত্যি বলতে কিছুই ভালো লাগে না। ঘরেই সময় কাটছে। পরিচিতজনেরা চলে যাচ্ছেন, তাই মনটা খারাপ থাকে। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই একটা করে দুঃসংবাদ পাই। ভীষণ খারাপ লাগে।
ক্যানভাস: অভিনয়ের শুরু কীভাবে?
শর্মিলী আহমেদ: আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন তো অভিনয়ের এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। আমার বাবা মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন মল্লিক বছরে দু-তিনটি নাটক তৈরি করতেন। তিনি উত্তরবঙ্গের নামকরা নাট্যাভিনেতা, নাট্যশিক্ষক, নাট্য পরিচালক ছিলেন। সেই সময়ই তাদের নাটকের দল ছিল ‘ঘোড়ামারা ড্রামাটিক ক্লাব’। রাজশাহীর অলকা সিনেমা হলে দু-তিন দিন সিনেমা চালানো বন্ধ রেখে সে মঞ্চে খুব জাঁকজমক করে নাটক করতেন। আমাদের বৈঠকখানায় সেই নাটকের রিহার্সাল হতো। বিকেল থেকে তারা মহড়া শুরু করতেন। বাইরে খেলে এসে রিহার্সালের আওয়াজ পেলেই ঢুকে এক কোণে চুপচাপ বসে মহড়া দেখতাম, খুব ভালো লাগত।
ক্যানভাস: প্রথম মঞ্চে উঠলেন কত বছর বয়সে?
শর্মিলী আহমেদ: চার বছর। তখনো রাজশাহীতে কোনো মেয়ে অভিনয় শুরু করেনি। ছেলেরাই মেয়ে সাজত। মেয়ে শিশুশিল্পী কোথায় পাবে? বাবার বন্ধুরা বললেন, ‘ওই তো লিলি, ও করুক।’ আব্বা বললেন, ‘ও কি পারবে? এত ছোট?’ মঞ্চাভিনয় কী, কীভাবে করতে হয়, কোনো কিছু না বুঝে খুশির চোটে বলে দিলাম, ‘পারব’। এরপর দৃশ্যটি আব্বা বোঝালেন, ‘তিন ভাই-বোনের তুমি সবার ছোট। মা-বাবার এত অভাব যে ঠিকমতো খেতে দিতে পারে না। খেতে চাইলে মা খুব রাগ করে, ‘এক বেলা খেয়ে থাকতে হবে।’ ক্ষুধায় চিৎকার করছ। ‘এত খাওয়া, খাওয়া করলে কোত্থেকে খাওয়া দেব’ বলে সে তোমাকে থাপ্পড় দেবে। আর তুমি ভ্যাঁ করে কেঁদে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে কোল থেকে নামিয়ে দেবে। ভয় নেই, ডায়ালগ বলতে হবে না।’ এই হলো অভিনয়। তবে মঞ্চে থাপ্পড় খেয়ে, এত মানুষের চিৎকার দেখে সত্যি সত্যি কেঁদে দিয়েছিলাম। দর্শকেরা খুব হাততালি দিচ্ছিল। মঞ্চে অভিনয় করলে মানুষ হাততালি দেয়! তখন থেকেই নেশা হয়ে গেল, অভিনয় করব।
ক্যানভাস: মঞ্চে নিয়মিত হলেন কীভাবে?
শর্মিলী আহমেদ: আব্বার পরিচালনায় অনেক নাটক করেছি। স্কুল (পিএম গার্লস হাইস্কুল) ও কলেজে (রাজশাহী সরকারি কলেজ) নাটক করেছি। স্কুলে নাটক হলেই আমার ডাক পড়ত। আব্বাই পরিচালনা করতেন। শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’তে শুকনো, পাতলা, ছোটখাটো ছিলাম বলে ‘অমূল্য’ করতে হয়েছে। মেয়েদের স্কুলে মেয়েরাই ছেলে, মেয়ের চরিত্র করেছি। কলেজেও পড়ার সময় অনেক নাটক করেছি। আব্বার গ্রুপে মঞ্চে অভিনয় করেছি।
ক্যানভাস: বেতারে কাজ করা কখন থেকে শুরু?
শর্মিলী আহমেদ: রাজশাহী বেতার চালু হলে ঘোষিকা হিসেবে ডাক পড়ল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ি। পড়ালেখার চাপে কীভাবে কাজ করব? আরডি (আঞ্চলিক পরিচালক) কাহহার সাহেব কবি বেগম সুফিয়া কামালের বড় মেয়ের স্বামী তিনি। আব্বার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। খুব আদর করতেন। বললেন, ‘মা, কলেজ থেকে এসে খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে থেকো। রেডিওর গাড়ি গিয়ে ছয়টায় নিয়ে আসবে। সাড়ে ১০টা পর্যন্ত উপস্থাপনার পর গাড়ি তোমায় বাসায় পৌঁছে দেবে। একটু কষ্ট করে রাতে পড়া সেরে ফেলো। তোমরা যদি কাজ না করো, তাহলে অন্য মেয়েরা এগিয়ে আসতে পারবে না। আমরাও ঘোষিকা পাব না।’ বললাম, ‘চাচা, পরীক্ষার সময়?’ বললেন, ‘ছুটি দেব।’ শর্ত দিলাম, ‘অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে।’ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার জন্য মাসে দুটি নাটক বরাদ্দ করা হলো।’ সারা দিন ঢাকা রেডিওর অনুষ্ঠান রিলে করে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ‘লাইভ অনুষ্ঠান’ চলত। আমি বাদে আরেকজন মাত্র অনুষ্ঠান ঘোষিকা ছিলেন। তাহেরা বেগম, যিনি আবু হেনা মোস্তফা কামাল সাহেবের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। আর এক কি দুজন পুরুষ ঘোষক ছিলেন। সে আমলে উপস্থাপনা করে মাসে ২১০ টাকা পেতাম। দুটি নাটকে ২৫ করে ৫০ টাকা। আমার মাসিক আয় ছিল প্রচুর, ২৬০!
ক্যানভাস: ঢাকা বেতারে কীভাবে শুরু?
শর্মিলী আহমেদ: আতিকুল হক চৌধুরী সুযোগ করে দিয়েছেন। তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে ‘মাজেদা মল্লিক’ নামে অভিনয় করতাম। পাঁচ-সাত দিন রিহার্সাল করে মাইক্রোফোনের সামনে যেতাম। শরৎচন্দ্রের অনেক নাটক করেছি। ‘চন্দ্রনাথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘মেজদিদি’, ‘মহেশ’, ‘নীলাম্বরী’, ‘শুভদা’, ‘শ্রীকান্ত’; এ ছাড়া ‘বিলাস’, ‘নির্জন সৈকতে’, ‘শীতের পাখি’, ‘নষ্ট নীড়’, ‘মন ও মানুষ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য নাটক করেছি। ঢাকা বেতারে আমি এত জনপ্রিয় শিল্পী ছিলাম যে মাজেদা মল্লিক অভিনয় করছেন জানলে শ্রোতারা রেডিও শুনতেনই। অনেক ভালো ভালো নাটকে অভিনয় করেছি।
ক্যানভাস: টিভিতে কীভাবে এলেন?
শর্মিলী আহমেদ: তখন মডি কোহেন নামের এক ইহুদি ছেলে অনুষ্ঠান ঘোষণা করতেন। সঙ্গে এক মহিলাও ঘোষণা করতেন। তার এখন অনেক বয়স, ভয়েস অব আমেরিকায় সংবাদ পড়েন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পর মডির সঙ্গে অনুষ্ঠান ঘোষণার জন্য ডেকেছিল। প্রতিদিনই অনুষ্ঠান ঘোষণা করতে হবে, কাজটি করতে হলে তো ঢাকায় স্থায়ী হতে হবে, রাজশাহী থেকে এসে করা সম্ভব নয়। ফলে করতে পারিনি। আতিকুল হক চৌধুরী টিভিতে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দিয়ে অভিনয় শুরু করালেন। তখন সিনেমার নামটি নিলাম ‘শর্মিলী আহমেদ’। তার নাটক দিয়ে টিভি অভিনয় শুরু করলাম। মাসে, দুই মাসে নাটক করলেও যত্ন করে অভিনয় করতাম। টিভিতে নায়িকা চরিত্রও করেছি।
ক্যানভাস: সিনেমার শুরুটা কীভাবে?
শর্মিলী আহমেদ: আবদুল জব্বার খান ও কামাল আহমেদ আব্বার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। আলী মনসুর, মহিউদ্দিনসহ আরও অনেক পরিচালক তার বন্ধু ছিলেন। জব্বার চাচা একদিন বললেন, ‘তোমার মেয়ে তো বেশ নাম করছে, রেডিও এবং মঞ্চে ভালো অভিনয় করছে, সিনেমায় দাও না কেন?’ এরপর তার প্রডাকশনে কামাল চাচার পরিচালনায় প্রথম ছবি করতে এলাম, নামটি মনে নেই। দ্বিতীয় নায়িকার চরিত্র। সুলতানা জামান মূল নায়িকা। তখন আব্বার অন্য পরিচালক বন্ধুরা বললেন, ‘দ্বিতীয় নায়িকা হলে সেটিই করতে হবে। আর মূল নায়িকা হতে পারবে না, দিয়ো না।’ ছবি না করে আমরা রাজশাহী চলে গেলাম। চাচার বন্ধু বজলুর রহমান উর্দু ছবি ‘ঠিকানা’য় অফার করলেন। চরিত্রটিও সাংঘাতিক। সেটিতে অভিনয় করলাম। আমার বিপরীতে নায়ক ছিলেন অবাঙালি হায়দার শফি। এখনো রিলিজ হয়নি। এরপর আমার অভিনয় দেখে অন্যরা ডাকা শুরু করলেন। সিনেমায় আমি নায়িকা হয়েই এসেছিলাম। তখন হঠাৎ উর্দু ছবি বানানো শুরু হলো। ফলে জুগনু, পাঞ্চি বাউরাসহ চারটি উর্দু ছবি করলাম। এরপর আবার বাংলা ছবির দিকে দর্শক ঝুঁকে পড়ল। সুভাষ দত্তের ‘আবির্ভাব’ করলাম। পড়ালেখার অসুবিধা হবে বলে বছরে একটি ছবি করতাম।
ক্যানভাস: শর্মিলী আহমেদ নামটি কীভাবে হলো?
শর্মিলী আহমেদ: রেডিওতে মাজেদা মল্লিক নামেই অভিনয় করতাম। এটিই আমার আসল নাম। তখন সিনেমাতে সব নায়িকার নাম ‘এস’ দিয়ে হতো। যেমন শাবানা, শবনম ইত্যাদি। ফলে আমার নামও তেমনটি রাখার কথা ভাবলেন ‘ঠিকানা’র পরিচালক বজলুর রহমান। আমি ডাকনাম মিলিয়ে লিলি মল্লিক রাখার কথা বললাম। তবে ছবিটির প্রধান সহকারী পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার আমজাদ হোসেন অনেকগুলো নাম লিখে বললেন, ‘কোন নামটি আপনার পছন্দ?’ আমি শর্মিলী বেছে নিলাম। বিয়ের পর থেকে আমার নামের সঙ্গে স্বামীর নাম মিলিয়ে ‘শর্মিলী আহমেদ’ নামে অভিনয় করছি।
ক্যানভাস: নায়িকা থেকে মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন কেন?
শর্মিলী আহমেদ: আমি তখন নায়িকা। ‘আগুন’-এর পরিচালক মোহসীন সাহেব বাসায় এসে তার নতুন সিনেমার গল্পটি শুনিয়ে বললেন, ‘শর্মিলী ভাবি, ছবিতে দুই নায়িকা আছে। একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র, যুবতী থেকে বৃদ্ধা; অন্যজন রোমান্টিক। কোনটি করবেন?’ বললাম, ‘রোমান্টিক নায়িকা মানে তো প্রেম, গান, গাছের ডাল ধরে অভিনয় করা। সারা জীবন নায়িকা হয়ে থাকব, এ প্রত্যাশা আমার নাই। ভালো অভিনেত্রী হতে চাই, এই চরিত্রই পছন্দ।’ ছবিতে রাজ্জাক সাহেব প্রথমে আমার স্বামী, আমাদের একটি সন্তান আছে। সে বড় হয়ে আবার রাজ্জাক। স্বামী ছেলের দুই চরিত্র তিনি করলেন। এই ছবিটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি মারা যাওয়ার পর সেদিনও মধুমিতায় দেখিয়েছে ছবিটি। এতে অভিনয়ের পর প্রতিটি পত্রিকার হেডলাইন হয়েছিল, ‘মা চরিত্রে শর্মিলী আহমেদ সার্থক, অসাধারণ অভিনয় করেছেন।’
ক্যানভাস: সেই বয়সে এমন ঝুঁকি কেন নিলেন?
শর্মিলী আহমেদ: নায়িকা ছাড়া অন্য চরিত্র করব না। তেমন কিছু আমার ছিল না। তাহলে তো নায়িকার চরিত্রই করতাম। মোহসীন সাহেব আমাকে বলেছিলেনও, ‘আপনি যেটি করবেন, করুন, বাকিটিতে অন্য শিল্পী দেখব।’ নায়িকা থাকা অবস্থায়ই তো আমি কেন্দ্রীয় চরিত্র বেছে নিয়েছি। পরে শাবানা রোমান্টিক চরিত্রটি করেছে। সে বলেছিল, ‘শর্মিলী আপা, সেই চরিত্রটির ওপর আমার কী যে লোভ ছিল! কিন্তু করিনি কেন জানেন? এক বয়সে গিয়ে চুল পাকাতে হবে, এরপর থেকে নায়িকা হিসেবে মানুষ আমাকে আর নেবে না। আমাদের দেশটি এমনই।’ তাকে বলেছি, ‘চুল পাকালে পাকাব। কিন্তু আমি ভালো অভিনয়ের সুযোগ খুঁজে বেড়াই।’ নায়িকা হিসেবে ভালো অভিনয়ের সুযোগ থাকলে সেটি করব, না নিলে মা-ই করব। এরপর থেকে দেখি, রোমান্টিক নায়িকা নয়, মা চরিত্রের অফার আসতে লাগল। শাবানার কথাই সত্য হলো। তবে রোমান্টিক নায়িকা বা মা, যেকোনো চরিত্রে আমি দেখেছি, সেটি কেন্দ্রীয় চরিত্র কি না, গল্পে আমার চরিত্র কত গুরুত্বপূর্ণ। যুবতী থেকে বৃদ্ধা, মা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, অভিনয়ের প্রচুর সুযোগ আছে এমন চরিত্রগুলোয় অভিনয় করতাম। ‘আগুন’-এর পর বুলবুল আহমেদ বললেন, ‘ভাবি, এটিও মায়ের চরিত্র। কিন্তু একেবারে নেগেটিভ, করবেন?’ বললাম, ‘খুব সুন্দর চরিত্র। অভিনয়ের প্রচন্ড সুযোগ, কেন করব না?’ তার পরিচালনায় ‘আকর্ষণ’ করলাম। আমি জাফর ইকবালের মা। বিরাট বড়লোক, হুইলচেয়ারে গিয়ে বিরাট অফিস চালাই, ছেলেকে নিয়ন্ত্রণ করি। অফিসের কর্মচারী চম্পা গরিবের মেয়ে। তাদের প্রেম হয়, কিন্তু আমি মেনে নিই না। ছেলের সঙ্গে সংঘাত করে তাকে বিদেশে পাঠিয়ে চম্পাকে ছাঁটাই করা থেকে শুরু করে অনেক বাজে কাজ করি। এই ছবিও খুব প্রশংসিত হয়েছে। নায়িকা থাকা অবস্থায়ই সুভাষ দত্তের ‘আলিঙ্গন’-এ কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘মা’ করেছি। ‘আরাধনা’য় বুলবুল আহমেদ একই চেহারায় দ্বৈত নায়ক ছিলেন। আমি ও কবরী নায়িকা। কবরীর সঙ্গে গ্রামের বুলবুলের প্রেম হয়। তবে শহরের বুলবুল আহমেদের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আলমগীর কবিরের ‘রূপালী সৈকত’-এ নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি ও জয়শ্রী কবির নায়িকা ছিলাম, বুলবুল আহমেদ নায়ক। এ-ও আমার স্মরণীয় ছবি। ‘দুই নয়ন’ ও ‘দহন’-এ অভিনয় করেছি।
ক্যানভাস: আপনার স্বামীও তো সিনেমায় জড়িয়েছেন?
শর্মিলী আহমেদ: রাকিবউদ্দিন আহমেদ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ থাকার পর কাপ্তাইয়ের সুইডেন-বাংলাদেশ টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার নিজের ক্যামেরা ছিল। ঢাকায় থাকতে প্রচুর ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছেন। সরকারি ২৫-৩০টি প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন। আজ পর্যন্ত তার মতো এত মেধাবী, বিনয়ী, শিক্ষিত, ভদ্রলোক আমার চোখে পড়েনি। আস্তে আস্তে ভালো লাগা, শেষ পর্যন্ত বিয়ে। আমাদের নিজস্ব ক্যামেরা ছিল, নিজে ক্যামেরা চালিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতেন। বাসায় ফিল্মের অনেক বই ছিল। ক্যামেরা, সিনেমা পরিচালনা নিয়ে পড়ালেখা করতেন।
ক্যানভাস: আপনার পরিবারের পরের প্রজন্মের কেউ অভিনয় করেন?
শর্মিলী আহমেদ: স্কুলে পড়ার সময় থেকে আমার মেয়ে তনিমা আহমেদ অভিনয় করে। স্কুলে রবীন্দ্রনাথের নাটক করেছিল। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ইঞ্জিনিয়ারদের ছেলে-মেয়েদের নাটকে অভিনয় করেছে। বিটিভিতে ক্লাস নাইন থেকে অভিনয় করছে। প্রথম নাটকটি মমতাজউদদীন আহমদ পরিচালনা করেছেন, আসাদুজ্জামান নূর তার নায়ক ছিল। সে বিটিভির প্রচুর এক পর্ব, ধারাবাহিক ও অনেক প্যাকেজ নাটকে অভিনয় করেছে। অনেক সিরিয়াল করেছে। এসটিভি ইউএস-এ চাকরি করত। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ছিল। তাতে অভিনয়ে ছয়-সাত বছরের বিরতি পড়ল। এরপর থেকে সে একটু কম অভিনয় করছে। কিন্তু কণ্ঠস্বর খুব ভালো। নাইন থেকে শুরু করে এখনো ফিল্মে ডাবিং করে, নায়িকার ভয়েস দেয়। ঋতুপর্ণা থেকে রিয়া সেন—যত ভারতীয় নায়িকা এসেছে, সবার ভয়েস দিয়েছে। অপু বিশ্বাস, বর্ষার ভয়েসও দিয়েছে। এখনো অনেকের ভয়েস দেয়।
ক্যানভাস: অবসরের সময়ও কি অভিনয়ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন?
শর্মিলী আহমেদ: যদিও নাটক এখন আমার পেশা, কিন্তু নাটক আমার নেশা, আমার ভালোবাসা। নাটক ছাড়া আমি আমার অস্তিত্বই কল্পনা করতে পারি না। বয়স হয়ে গেছে, মাঝেমধ্যেই শরীর অসুস্থ থাকে। চার-পাঁচ দিন বাসায় থাকতে হয়। তখন অস্থির লাগে সহশিল্পীদের দেখছি না, কথা বলতে পারছি না, অভিনয় করতে পারছি না। আবার সেই পরিবেশে গেলে সুস্থতা বোধ করি। জানি না ভালো অভিনেত্রী কি না, দর্শক ভালো জানেন; কিন্তু ভালোবেসে, অন্তর দিয়ে আমি অভিনয়ের চেষ্টা করি। যখন নায়িকা ছিলাম, তখন বোরকা পরিনি, সবার সঙ্গে মিশতাম। এখনো শপিং করি, বাইরে যাই, অচেনা মানুষ রাস্তা পার হচ্ছেন, বলেন, আসসালামু আলাইকুম, ভালো আছেন? শরীরটা ভালো? জ্যামে গাড়ি থামলে ড্রাইভার বলেন, আন্টি, ভালো আছেন? মোটরসাইকেল আরোহী ভদ্রলোকও সালাম দেন। আমি জীবনে অনেক সামাজিক, বিভিন্ন সংগঠন, বাচসাস পুরস্কার পেয়েছি; কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাইনি। অনেকে বলেন, কেন একুশে পদক পাওনি? তোমার পাওয়া উচিত ছিল। আমি মনে করি না উচিত ছিল। হয়তো আমি একুশে পদক পাওয়ার যোগ্য নই, সে কারণে পাইনি। এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপই নেই। মানুষের ভালোবাসাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
ক্যানভাস: অভিনয়জীবনে কোনো অতৃপ্তি আছে কি না?
শর্মিলী আহমেদ: দীর্ঘ ক্যারিয়ারে একটি অতৃপ্তি আছে আমার। পছন্দের ভালো চরিত্রে এখনো অভিনয় করা হয়ে ওঠেনি। আরও অনেক বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করতে পারতাম।
ছবি: বিশ্বরঙ