রসনাবিলাস I পাগলার আস্তানায়!
ভোজনরসিকদের জন্য নতুন এক ফুড ভেন্যু এটি। এর মেনু অনেক মুখরোচক ও পুষ্টিকর খাবারে সাজানো, তবে কাচ্চিটাই সেখানে আসল
ঢাকার আকাশ-বাতাস এখন কাচ্চিময়। এর স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ শিখতে ব্যস্ত যেন এ শহরের প্রায় সব রেস্টুরেন্ট। তবে যারা কাচ্চিভোজী, তাদের পাগলা না হলে কি আর চলে? তাই ঢাকা শহরের মাটিতে, বনানীর রেস্টুরেন্ট পাড়ার নতুন আগন্তুক পাগলা বাবুর্চি বাই ম্যাড শেফ। জি, যাদের বার্গারের স্বাদে এর আগে মোহিত হয়েছেন, তারাই এবার কাচ্চি এবং তৎসংক্রান্ত খাবার নিয়ে হাজির হয়েছেন। তাই পাগলা বাবুর্চির আস্তানায় গিয়ে হাজির টিম ক্যানভাস।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই আমন্ত্রণ জানায় রিকশা আর্ট আর পপ আর্ট ঘরানার মিশেলে তৈরি কোলাজ। খানিক অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে আলোকিত এই জায়গা দেখলে একটা আশার আলো জাগে— খাবারটা মন্দ হবে না। টেক আউট নেওয়ার জন্য সেখানেই ওয়েটিং জোন। পাগলা বাউলের একতারা, ভ্যান, রিকশা, নৌকা, ঠেলাগাড়ি, হুলো বিড়াল আর ভুলো কুকুর, খাসি, বিরিয়ানির প্লেট হাতে বিমোহিত যুবক, বিয়েবাড়ি থেকে পালানো বর-কনে— এসব দেখতে দেখতেই সময় পার করে দেওয়া যায়। দরজা ঠেলে নাক বরাবর পানের কারবার, ডানে ক্যাশ কাউন্টার উজিয়ে। বাম দিকে এগিয়ে গেলে অনেকটা এল প্যাটার্নের বসার জায়গা। প্রান্তের কাছাকাছি মূল কিচেন আর ফুড কাউন্টার। মূল রাস্তার ওপরে, গ্লাসে ঘেরা বলে প্রাকৃতিক আলো রয়েছে প্রচুর। এ ছাড়া রয়েছে নীল রঙের হাঁড়িকে ঝুলিয়ে দিয়ে টাংস্টেন বাতির হলদে আলো। সাদা-নীলের পুরো দেয়ালজুড়ে রয়েছে আরও নানা ধরনের সংলাপে ভরা কার্টুন; যা রেস্টুরেন্টের অ্যাপিল খানিকটা বাড়িয়েই দেয়।
ম্যানেজার মিরাজুল ইসলাম আর সহকারী ম্যানেজার টনি গোমেস লেগে গেলেন আমাদের আপ্যায়নে, কথায় কথায় জানা গেল এখানে কমবেশি ৬০ জন একসঙ্গে বসে খেতে পারেন। এমন এক টেবিল দখল করে নিলাম আমরাও। ছবি তোলা, খাওয়া চলল একই সঙ্গে। তবে খাওয়ার থেকে বলা ভালো চেখে দেখা হলো অন্য খাবারগুলো, খেয়েছি তো কাচ্চিটাই। প্রথমে এলো তাবলে দ্যু’য়ত মেনুর মানে সেট মেনুর স্টিকি ঘি-ভাত, সংগত দিচ্ছে বিফ ঝোল চাপ। ঘি-ভাতে ঘিই মূল আকর্ষণ, আর সঙ্গে ঝালে ঝোলে চাপ। বলা দরকার, মোগল এই খাবার আমাদের এখানে মূলত বিহারি সম্প্রদায়ের হাত ধরেই টিকে আছে। আর তারা যেটা খাওয়ান, সেটা হলো মাংসের পাতলা এক চিকন খন্ড, যা সিনার বা পেছনের রান থেকে নেওয়া হয়, ফিতা দিয়ে মাপলে পুরুত্ব এক ইঞ্চির বেশি হবে না। চর্বি আর ঘিয়ে ভাজা একটু শুকনো ধরনের গ্রেভি। তবে প্রথাগত মাপ আর গ্রেভির ধরনে পরিবর্তন এসেছে পাগলা বাবুর্চিতে। তাই নতুনত্বের একটু ধাক্কা লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমকালীন ঢাকার স্বাদের সঙ্গে খানিকটা মিথস্ক্রিয়ার মতোই ব্যাপারটা। একই কথা প্রযোজ্য সোনালি মোরগ মুসাল্লামের ক্ষেত্রেও। তাবলে দ্যু’য়ত মেনুতে রয়েছে দুটো কাচ্চি প্ল্যাটার, দুজনের জন্য দুটো করে কম্বো— ঘি-ভাত বা সাদা পোলাও দিয়ে বিফ ঝোল চাপ আর সোনালি মোরগ মুসাল্লাম। ঘি ভাজা চিকেন খিচুড়িও রয়েছে, পরিবেশিত হয় ডিম আর বেগুন ভাজা দিয়ে।
এবার বসা হলো কাচ্চি নিয়ে। ধোঁয়া ওঠা কাচ্চি, তাতে উঁকি দেওয়া রঙিলা আলু আর কালচে-খয়েরি খাসির মাংসের আহ্বান এই বাংলায়, লক্ষ্ণৌর অপদস্থ নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর আগমনের পর কে কবে অস্বীকার করতে পেরেছে? বিরিয়ানিতে আলু তারই অবদান, আর কাচ্চি বিরিয়ানি তো তার বাবুর্চির আবিষ্কার।
কোনো সন্দেহের অবকাশ ছাড়াই পাগলা বাবুর্চির তারকা খাবার হলো কাচ্চি বিরিয়ানি। আমি আমার তরিকায় প্রথমে পরখ করলাম— ছড়িয়ে, ঘ্রাণ শুঁকে, স্বাদে আর আলুতে। আরও একটু ঝরঝরে করা গেলে ভালো হতো, তবে পাগলা বাবুর্চি যেমনটা করে, সেটা নতুন ঢাকার অনেক নামিদামি বিরিয়ানি ব্র্যান্ডও করে না। কাচ্চি বিরিয়ানিতে চাল ও মাংসের ঘ্রাণ হতে হবে অভিন্ন। মাংস, মসলার গুণে আর বিরিয়ানি, কাটার গুণে— স্বাদে অসাধারণ আর রসাল হবে। মাংস তো রসাল হবেই, আর হাত দিলেই যেন খুলে আসে, বিনা শ্রমে। বিরিয়ানিতে মসলার সূক্ষ্ম ঘ্রাণ ও স্বাদ আসবে। আর সবশেষে পরীক্ষা আলুর। আলুর স্বাদ বিরিয়ানিতে থাকা মাংসের সঙ্গে টক্কর দিতে পারঙ্গম হতে হবে। এই চার পরীক্ষায় পাস হলো পাগলা বাবুর্চির কাচ্চি। এই কাচ্চির একটা বড় গুণ হলো, এর মসলা খানিকটা কম। ফলে পরিবার নিয়ে খেতে গেলে, বিশেষত বাচ্চা আর যাদের ঝালে রুচি কম, তারা এই কাচ্চি অনায়াসে গলাধঃকরণ করতে পারে। মাঝেমধ্যে আলুবোখারার চাটনি আর বোরহানির সংগত ছিল। বোরহানিতেও মসলার বাহুল্য ছিল না, বরং খানিকটা ভোঁতা স্বাদ। খুব সম্ভবত পুরান ঢাকা থেকে নতুন ঢাকার করপোরেট পাড়ার খাদকদের আন্তর্জাতিক স্বাদেন্দ্রিয়র সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার চেষ্টায় আছে পাগলা বাবুর্চি। তবে যেহেতু কো-পার্টনার আদনান খান বলেই দিচ্ছেন, তারা ফিউশনের চেষ্টায় আছেন, তাই শহরে নতুন আগন্তুক হিসেবে একটা ছাড় তারা পেতেই পারেন।
খাওয়া শেষে মধুরেণ সমাপয়েতের ব্যাপার তো থাকেই। তাই নেওয়া হলো তাদের আলোড়ন তৈরি করা শাহি টুকরা। তরল মালাইয়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে কুচি কুচি করা কাঠবাদাম। মাঝে সেই রসে জারিত পাউরুটির টুকরোর ওপরে ম্যাস্কারপোনি চিজ অবশ্যই নতুনত্বের দাবিদার। লাল রঙা চেরি যে জেল্লা তৈরি করেছে, তাতে হামলে পড়া ছাড়া গতি ছিল না। এরপর এলো ম্যাংগো থ্রি-ওয়ে, এটাকে চালিয়ে দেওয়া যায় ফালুদার বিকল্প হিসেবে— নিচে সাগুদানা, ওপরে পাকা আমের স্বাদের জেলো, কিউব করা পাকা আম, পাকা আম ফ্লেভারের আইসক্রিম আর ফালুদায় ব্যবহৃত ক্রিমের বদলে এরা দিচ্ছে ম্যাস্কারপোনি চিজ।
আর ওপরে দুইখানা মিস্টার কুকি! সবশেষের ডেজার্টটা ফ্রুট ইয়োগার্টিনি— টক দইয়ের সঙ্গে ফলের মিশেল, ওপরে উঁকি দিচ্ছিল তারা মার্কা ভ্যানিলা কেক। সিম্পল, কিন্তু অসাধারণ। আরেক কো-পার্টনার ইকরাম মাহবুব অবশ্য বলেই দিচ্ছেন, ‘আমরা খানিকটা টুইস্ট দিতে চেয়েছি, সেটা কতটুকু মজাদার হলো, সেটার বিচার তো যারা খাচ্ছেন তাদের ওপরেই।’ আর পাগলা বাবুর্চির দাবি অনুযায়ী তারা কেবল কাচ্চি-বিরিয়ানির কারবারি নন, এই এলাকার যে বাংলা কুজিন, সেটাকেই খানিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। সব মিলিয়ে পাগলা বাবুর্চি বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন বা পরিবার নিয়ে খেতে যাওয়ার জন্য বেশ ভালো জায়গা।
পাগলা বাবুর্চি বাই ম্যাড শেফ, বাড়ি ১১৬, সড়ক ১১, ব্লক ই, বনানী, ঢাকা ১২০৯। ফোন: ০১৭৬১০৯৪৮৫৮। ফেসবুক: facebook.com/paglababurchi
i লেখা ও ছবি: আল মারুফ রাসেল