এই শহর এই সময় I জলবায়ু শরণার্থীর জীবনযুদ্ধ
১২ থেকে ২৬ নভেম্বর রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে অনুষ্ঠিত হলো খ্যাতিমান আলোকচিত্রী আবীর আবদুল্লাহর একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘ক্লাইমেট মাইগ্রেন্টস ইন বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থীদের নিয়ে ফ্রান্স ও কানাডার পর ঢাকায় বসল এই প্রদর্শনী। এতে জায়গা পেয়েছে ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে তোলা ৩৪টি আলোকচিত্র।
আবীর আবদুল্লাহ বলেন, ‘বৃহত্তর অর্থে জলবায়ু শরণার্থী ছিল এই প্রদর্শনীর মূল থিম। ২০০৭ সালে একটি অ্যাসাইনমেন্ট করেছিলাম শিকাগো ট্রিবিউনের হয়ে। সেটি করতে গিয়ে নোয়াখালীর এক চরে গিয়ে দেখি, ভাঙন চলছে। জানলাম, এখানকার মানুষ নদীভাঙনের কারণে প্রতিবছর ঘরবাড়ি হারিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যান। একধরনের মাইগ্রেশন বা ডিসপ্লেসমেন্ট বলা যায় একে। এরপরই এই প্রজেক্টের শুরু।’
‘এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের বড় একটি অংশের মানুষ, বিশেষ করে উপকূলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে যাচ্ছেন। এরপর থেকে যে বছরগুলোতে বড় ধরনের বন্যা হতো, আমি ছবি তুলতে যেতাম। সাইক্লোনগুলোও কাভার করেছি। প্রথম দিকে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহ ছিল, বাংলাদেশ যেহেতু বন্যাপ্রবণ এলাকা, এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক নেই। কিন্তু পরে দেখা গেল, যেখানে বছরে একবার বন্যা হতো, সেখানে দু-তিনবার বন্যা হচ্ছে। এটা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা ক্লাইমেট চেঞ্জের একটা বড় ইন্ডিকেশন,’ বলেন তিনি।
আবীর বলেন, ‘এত দুঃখ-দুর্দশার পরও মানুষ যে নিজের পায়ে দাঁড়ায়, সেই ক্ষমতাকে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ছবি তোলার ক্ষেত্রে সেদিকে দৃষ্টি রাখি।’
এক ছবিতে দেখা যায়, নদীতে ভেঙে যাচ্ছে স্কুলঘর। ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে দুই বালকের একধরনের হাহাকারের অভিব্যক্তি। ছবিটি প্রসঙ্গে আলোকচিত্রী বলেন, ‘ছবি তোলার আগে আমি ক্যারেক্টারগুলোকে অবজার্ভ করি। যেমন, এই ছবির বাচ্চাগুলো এই স্কুলেরই ছাত্র। তারা আর এই স্কুলে যেতে পারবে না—এই যে খুব অল্প সময়ের জন্য তাদের চেহারায় ফুটে ওঠা ভাবমূর্তি, তা দেখার জন্য প্রশিক্ষিত চোখ দরকার। দীর্ঘদিন ধরে ছবি তুলতে তুলতে সেটি আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে মনে করি।’
পেশাগতভাবে আবীর আবদুল্লাহর ফটোগ্রাফি শুরু ১৯৯৭ সালে। দৃক পিকচার লাইব্রেরি তার প্রথম কর্মক্ষেত্র। তার প্যাশন—ডকুমেন্টারি এবং সোশ্যাল ও এনভায়রনমেন্টাল ইস্যু। ২০০৫ সালে তিনি যোগ দেন ইউরোপিয়ান প্রেস এজেন্সিতে। ২০১৭-তে যোগ দেন প্রথম আলোতে, কনসালট্যান্ট হিসেবে। সেখানে ৩ বছর কাজ করেন। এরই মাঝে পাঠশালার প্রিন্সিপাল হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। এখন তিনি পুরোদস্তুর ফ্রিল্যান্সার!
‘আমি সব সময়ই একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ছবি তুলি। ২০০৭ সাল থেকে এই প্রজেক্টের কাজ শুরু করার কারণ, আমার তখনই মনে হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াবহ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তখনই বিজ্ঞানীরা বলাবলি করছিলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে আগামী ৫০ থেকে ৬০ বছরে বাংলাদেশের অনেকটা অংশ পানিতে ডুবে যাবে। এখন দেখছি, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই প্রভাব পড়ছে। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে আমি একটি বার্তা পৌঁছাতে চাই—যারা ধনী দেশ, যারা কার্বন দূষণের জন্য বেশি দায়ী, তারা যেন আরও দায়িত্ববান হয়, যেন এ দূষণ কমায়; শুধু কমালেই চলবে না, পাশাপাশি ন্যায্য দাবি—ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যেন ক্ষতিপূরণ পায়,’ বলেন তিনি।
ছবি: আবীর আবদুল্লাহর সৌজন্যে
রঙে ছড়ানো অভিব্যক্তি
১২ থেকে ১৫ নভেম্বর ২০২১। রাজধানীর বনানীর ঢাকা গ্যালারিতে থরে থরে সাজানো ছিল ৫৯টি চিত্রকর্ম। ভীষণ রঙিন। মূলত নারীদের অভিব্যক্তি থেকে ঠিকরে বের হচ্ছিল জীবনের দারুণ দ্যুতি। ‘মুখের অভিব্যক্তি’ শীর্ষক এই একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর শিল্পী শ্রুতি গুপ্তা কাসানা। ভারতীয় এই তরুণ চিত্রশিল্পী ও ফ্যাশন ডিজাইনার কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় থাকছেন।
প্রফেশনাল গ্যালারিতে এটি শ্রুতির প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী হলেও এর আগে ভারত ও বাংলাদেশে একক এবং যৌথ আরও গোটা সাতেক প্রদর্শনী হয়েছে তার চিত্রকর্মের। এগুলোর মধ্যে ২০১১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় প্রথম একক প্রদর্শনী। এরপর থেকে প্রতি ছয় মাসে অন্তত একটি একক কিংবা যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে এঁকে চলেছেন ছবি।
মুখের অভিব্যক্তি প্রদর্শনীর থিম প্রসঙ্গে শ্রুতি বলেন, ‘করোনাভাইরাস বাস্তবতায় এশীয়, বিশেষত বাংলাদেশি ও ভারতীয় নারীরা খুব একটা ভালো সময় কাটাননি। অনেকেই নানাভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। এমনকি শিকার হয়েছেন ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের। এই একুশ শতকে এসেও নারীদের এমন খারাপ অবস্থা দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। এ কারণে যে নারীদের আসলে কিছুই করার নেই—মূলত তাদের মুখের ছবি আঁকতে চেয়েছি। নারীদের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব—এই সম্ভাবনার চিত্র ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। এ কারণেই ছবিগুলো এত রঙিন। কেননা রং তো আনন্দ ও শক্তির বার্তা দেয়।’
শৈশবেই পেইন্টিংয়ে হাতেখড়ি শ্রুতির। ফিগারেটিভ পেইন্টিং তাকে বেশি টানে। আশপাশের জনজীবন থেকেই নেন প্রেরণা। তাদের চেহারা, অভিব্যক্তি, অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন, আচার-ব্যবহার ধারণ করে সেগুলোকে তুলির পরশে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে ভালোবাসেন। ‘আমি ভীষণ নারীবাদী। নারীকে দেখি ভীষণ শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে। এরা কারও ওপর নির্ভরশীল নন। যা চান, তা করতে পারেন বলে নারীকে আমি খুবই স্ট্রং ও ওয়াইডেস্ট সাবজেক্ট মনে করি,’ বলেন শ্রুতি।
তিনি আরও বলেন, ‘পেইন্টিং আমাকে অন্তরে শান্তি এনে দেয়। যে কথা মুখ ফুটে বলতে পারি না, সেই অনুভূতি ছবিতে এঁকে প্রকাশ করি।’
উদাহরণ দিতে গিয়ে বললেন, ‘আমার সন্তান যখন পড়াশোনার জন্য আবাসিক হোস্টেলে চলে গেল, তখন নিজের আবেগকে আশপাশের মানুষের কাছে ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারিনি। সেই বেদনাবোধ আমাকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিয়েছে।’
ব্যস্ত এই ফ্যাশন ডিজাইনার জানালেন, বাংলাদেশে আসার পরই চিত্রকর্মে বেশি মনোযোগী হয়েছেন। কাজের ফাঁকে একান্ত সময় মিললে বসে যান ক্যানভাসের সামনে। বলে রাখি, ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্ম নেওয়া শ্রুতি বেড়ে উঠেছেন লক্ষেèৗতে। বাবা চিকিৎসক। মা খুবই সৃজনশীল। দারুণ সব পোর্ট্রেট এঁকেছেন। বোনও দারুণ আঁকেন। শ্রুতির রক্তেই রয়েছে চিত্রশিল্প—এমনটা বিশ্বাস করেন নিজেই। ভারতের একটি ফ্যাশন ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেছেন। তারপর ন্যাশনাল ফ্যাশন ইনস্টিটিউট থেকে সোয়েটার ডিজাইনিংয়ের ওপর করেছেন পোস্টগ্র্যাজুয়েশন কোর্স। এরপর পুনা থেকে এমবিএ করে কর্মজীবনের শুরু। এর ফাঁকে ইন্টার্ন করেছেন কানাডায়।
২০০৬ সালে বিয়ের পর ঢাকায় আসেন শ্রুতি। তারপর থেকে এখানে রয়েছেন। মুখের অভিব্যক্তি প্রদর্শনী নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত শ্রুতি জানালেন, বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শকের কাছ থেকে দারুণ সাড়া পেয়েছেন তিনি। বললেন, ‘আনন্দের সঙ্গে জীবন কাটানোই আমার থিওরি।’
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: শ্রুতি গুপ্তা কাসানার সৌজন্যে