ফিচার I চলো মন স্টেকেশনে
নিউ নরমাল জীবনে বদলে গেছে ঘোরাঘুরির সংজ্ঞা! ভ্যাকেশনের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্টেকেশন। যারা ভাবছেন, এ আবার কী? এর সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে লিখেছেন আহমাদ শামীম
কর্মব্যস্ত জীবনে অবসরের ফুরসত মেলাই যখন ভার, তখন শহর থেকে দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটু বেড়িয়ে আসার সুযোগ কই? সুযোগ যদিও মেলে, কাজের সঙ্গে ছুটির সমন্বয় কিংবা অর্থকড়ি বা বাজেটের চিন্তা তো থাকেই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ইদানীং যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির স্বাস্থ্যসচেতনতার মতো বিষয়ও। এত এত চিন্তার ভিড়ে দেহ ও মনের প্রশান্তির জন্য কি তবে ঘুরে আসার ভাবনাই বাদ দিতে হবে?
সময়, অর্থ এবং স্বাস্থ্যসচেতনতার কথা মাথায় রেখে আপনার ‘ভ্যাকেশন’বিষয়ক চিন্তা দূর করতে পারে ভ্রমণের নতুনতর সংযোজন ‘স্টেকেশন’। বলতে পারেন, এটা আবার কী! নতুনতর বলা হলেও বিষয়টি এতটা নতুন কিন্তু নয়। তার আগে বলি, কারে বলে স্টেকেশন! ইংরেজি শব্দ ‘স্টে’ ও ‘ভ্যাকেশন’-এর যৌথ রূপ হলো ‘স্টেকেশন’। স্টেকেশনের সংজ্ঞায় অনেক কথাই হয়তো বলা যাবে। সহজ করে বললে, অবসর যাপনের জন্য দূরে কোথাও না গিয়ে বাসা বা শহরের আশপাশ থেকে এক দিনের জন্য ঘুরে আসা। প্রতিদিনের রুটিনমাফিক জীবন থেকে সংক্ষিপ্ত বিরতিও বলতে পারেন। আরও সহজ করে বললে, স্টেকেশন হচ্ছে অল্প বাজেটের স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ভ্রমণ বা অবস্থান।
ঘোরাঘুরি করতে যারা ভালোবাসেন, তারা দূরে হোক কিংবা কাছের—যেকোনো দর্শনীয় স্থান বা প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটাতে চান। একসময় যারা ছাত্র ছিলেন, এমনকি এখনকার ছাত্র-ছাত্রীদেরও অধিকাংশ ভ্রমণ হয়ে থাকে এক দিনে ঘুরে আসার মতো কোনো স্থানে। এর প্রধান কারণ, অল্প খরচে এসব ভ্রমণপর্ব সেরে ফেলা সম্ভব। এমনকি দেশের বিভিন্ন ট্রাভেলার্স গ্রুপও আশপাশের দর্শনীয় জায়গায় ‘ডে-ট্রিপ’ বা ‘বাজেট ট্রিপ’-এর আয়োজন করে থাকে।
তবে ট্রাভেল টার্ম হিসেবে স্টেকেশন আলোচনায় আসে মূলত ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা বা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিসের সময় থেকে। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভ্রমণপিয়াসীরা খরচ বাঁচাতে দূরে বা দেশের বাইরে যাওয়া বাদ দিয়ে নিজ শহর বা পাশের শহরকে বেছে নিতে থাকেন অবসর সময় কাটানোর জন্য। এতে রথ দেখা ও কলা বেচার মতো একসঙ্গে দুটোই হয়ে যায়—টাকাও বাঁচল, ভ্রমণও হয়ে গেল। এটি ধীরে ধীরে গ্লোবাল ট্রেন্ডে পরিণত হতে থাকে।
করোনাভাইরাস বাস্তবতার এই সময়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কোথাও যাওয়ার মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা ও সামাজিক দূরত্বের মতো বিধিনিষেধের বালাই তৈরি হয়েছে। ফলে এখন আবারও আলোচনায় এসেছে বা বলা যায় ট্রেন্ড তৈরি হয়েছে স্টেকেশনের। পাশাপাশি বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যখন দৈনন্দিন ও মাসিক খরচের হিসাব বেড়েই চলেছে, এই অবস্থায় মনের প্রশান্তির জন্য ঘুরতে যাওয়ার মতো খরুচে বিষয়ের চিন্তা করাটাও যেন বাহুল্য। ফলে আপনি ভ্যাকেশনে না গিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে যেতে পারেন স্টেকেশনে!
এবার দেখে নেওয়া যাক, কেমন হতে পারে স্টেকেশনের রুটিন। পরিবারের বা বন্ধুদের, মানে যাদের নিয়ে ঘুরতে যেতে চান, সবার কমন কোনো ছুটির দিন বেছে নিন। সকালে ইচ্ছেমতো ঘুমিয়ে নিন। চাইলে সবাই মিলে বাসায় বসেই ‘ডেইলি রুটিন’ ভুলে নিজেদের মতো আনন্দমুখর সময় কাটাতে পারেন। ঘরে রান্না না করে অনলাইনে অর্ডার দিতে পারেন পছন্দের খাবার। বাসার ড্রয়িংরুমকে মুভি থিয়েটার বানিয়ে ফেলে পছন্দের কোনো সিনেমা দেখুন সবাই মিলে। বৈকালিক আড্ডায় মেতে উঠুন স্মৃতি রোমন্থনে, কিংবা খেলতে পারেন অনেকে মিলে খেলা যায় এমন কোনো খেলা।
যদি মনে করেন—নাহ্, সবাই মিলে একটু বেড়িয়ে আসি! তাহলে ছুটির দিনটিতে ঘুরে দেখুন নিজ শহরের খুব বেশি যাওয়া হয় না এমন জায়গাগুলোতে; যেমন—জাদুঘর, লাইব্রেরি, শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানা, চলমান কোনো প্রদর্শনী, ঐতিহাসিক স্থান অথবা কোনো প্রকৃতিমুখর উদ্যানে। সেখানে নিজেদের মতো সময় কাটিয়ে পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের নিয়ে কাছের কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে সেরে নিতে পারেন লাঞ্চ। তারপর বিকেল নাগাদ সিনেমা হলে বা মঞ্চপাড়ায় গিয়ে দেখে নিলেন কোনো সিনেমা কিংবা মঞ্চনাটক। এরপর রাতের খাবার সেরে শরীর ও মনে প্রশান্তিসহ বাসায় ফিরলেন।
আর যদি ভেবে থাকেন, শহর থেকে একটু দূরে কোথাও গেলে মন্দ হয় না, তাহলে আপনাকে বলছি, রাজধানী ঢাকার আশপাশে দিনে গিয়ে দিনে ফেরা যায়—এমন অসংখ্য ঘুরে দেখবার মতো জায়গা আছে। এ ছাড়া রাজধানীর কাছেই তৈরি হয়েছে বেশ কিছু রিসোর্ট, যেখানে রাতে অবস্থান না করেই রয়েছে খাবারের ব্যবস্থাসহ বিনোদনের নানা উপাদান।
রাজধানী থেকে দিনে গিয়ে দিনে ফেরা যায়, এমন কিছু স্থানের মধ্যে প্রথমেই বলব গোলাপ গ্রামের কথা। সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের তুরাগ নদের তীরে সাদুল্লাপুর গ্রামে প্রায় সারা বছরই গোলাপের চাষ হয় বলে গ্রামটি ‘গোলাপ গ্রাম’ নামেই পরিচিত। প্রকৃতির সান্নিধ্যে নানা রঙের দিগন্তবিস্তারী গোলাপের মাঝে পুরো দিনটি কাটিয়ে এলে মন্দ হয় না। এ ছাড়া কাছে-ধারে অন্য কোথাও যেতে চাইলে সেটা হতে পারে সোনারগাঁয়ের পানাম নগর। ঈসা খাঁর আমলের বাংলার রাজধানী পানাম নগরের স্থাপনাগুলোও মনোমুগ্ধকর। এখানে এলে সোনারগাঁয়ের লোকজাদুঘর তো ঘুরবেনই, পাশাপাশি ঘুরে আসতে পারেন নিকটবর্তী মেঘনার পাড় থেকেও। ঢাকা থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে ইছামতী নদীর তীরে দুই শ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ নবাবগঞ্জের কলাকোপা বান্দুরাও হতে পারে স্টেকেশনের অন্যতম স্থান। এখান থেকে অল্প দূরত্বে নবাবগঞ্জেরই আরেক দর্শনীয় স্থান ‘মিনি কক্সবাজার’ হিসেবে খ্যাত পদ্মার পাড়ের মৈনট ঘাট।
ঢাকার উত্তরের জেলা গাজীপুরও হতে পারে স্টেকেশনের অন্যতম মাধ্যম। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে এ জেলায়। যেগুলোর মধ্যে বোলাই বিল, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিঘেরা নুহাশপল্লীসহ আছে জল-জঙ্গলের কাব্যের মতো দারুণ কিছু রিসোর্ট। এ ছাড়া ঢাকার পাশর্^বর্তী জেলা মানিকগঞ্জেই আছে দেশের সবচেয়ে বড় জমিদার বাড়িগুলোর একটি—বালিয়াটি জমিদার বাড়ি, যেতে পারেন সেখানেও। কিংবা ঘুরে আসতে পারেন টাঙ্গাইলের নান্দনিক স্থাপনাসমৃদ্ধ মহেরা জমিদার বাড়ি থেকে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরা নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর থেকেও ঘুরে আসতে পারেন এক দিনে। হাতে যখন মোবাইল আছে, তখন গুগল করেই দেখে নিন ‘ঘর হইতে দুই পা’ দূরত্বের দর্শনীয় স্থানগুলো, তারপর প্রতি মাসেই হোক না একবার স্টেকেশন!
আর, আপনি রাজধানীবাসী না হলেও অসুবিধা নেই। এমন জায়গার খোঁজ পাবেন আশপাশেই। এসব জায়গায় অল্প বাজেটের মধ্যেই পেতে পারেন দেহ ও মনের প্রশান্তি।
ব্যস্ততা যখন অবসর দেয় না কিংবা আর্থিক টানাপোড়েনে জীবন কঠিন ঠেকে অথবা করোনাভীতিতে সবই লাগে দুর্বিষহ, তখন সময় বের করে একটি দিন নিজেই ছুটি নিয়ে নিন। একটু পরিকল্পনাসহ অল্প বাজেটেই কাছে-ধারের কোনো স্থানে বা নিজ শহরের মধ্যেই চলে যান স্টেকেশনে। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে জীবনকে করে তুলুন আনন্দমুখর।
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু