skip to Main Content

এডিটরস কলাম I একটু শীতলতার জন্য…

ঈষৎ উষ্ণতার আশায় সোনাঝরা রোদে খানিক বসে থাকা, মৌসুমি পিঠার স্বাদে মন জুড়িয়ে নেওয়া, নানা গল্প-কথা আর সাংস্কৃতিক আয়োজনে বিভোর হওয়ার দিন এ যে!

‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়…’—কবি বিনয় মজুমদারের কবিতার এই পঙ্্ক্তির নানাবিধ অর্থ দাঁড় করানো যেতে পারে। তবে যে অর্থই দাঁড়াক, তার ভেতর থেকে মানুষের অন্তস্তলের পঙ্কিলতার একটা ছাপ ঠিকই উঁকি দেয়। বলছি না, মানুষ খারাপ! তবু জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারেই মানুষের কারণে প্রকৃতি কখনো কখনো এসে দাঁড়ায় কঠিন সময়ের মুখোমুখি।
এমনই কঠিন সময় বেশ কিছুকাল ধরেই চলছে। দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর উষ্ণতা। তীব্র গরমে জনজীবন হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। আশঙ্কাজনক হারে গলছে প্রাকৃতিক বরফখন্ড। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বিপন্নের দ্বারপ্রান্তে অনেক প্রাণী, পতঙ্গ ও উদ্ভিদ।
এই মারাত্মক বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অনেক বড় একটা দায় যে মানুষের, এ কথা এখন আর অজানা নয় কারও।
দুই
শুরুতেই মানুষের এই দায়ভারের কিছু নমুনা জানা যাক। বিশেষজ্ঞদের গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৫০ সাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণগুলো মানবসৃষ্ট। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, মাংস ও শস্য উৎপাদনে খামার ও কৃষিকাজের ব্যাপক বৃদ্ধি এবং অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য গাছ কেটে বন উজাড় করে ফেলার কারণে জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তনের সামনে আমরা। এসব কারণে নির্গত হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস, আর তাতে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। জানা গেছে, গত শতাব্দীর তুলনায় এ শতাব্দীতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে গেছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বরফ গলার মারাত্মক হার অনুমানের জন্য এবার একটি উদাহরণ টানা যাক: ১৯১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার গ্ল্যাসিয়ার ন্যাশনাল পার্কে ছিল প্রায় ১৫০ হিমবাহ; ২০১৭ সালে তা নেমে গেছে মাত্র ২৬-এ। বরফ গলার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমান শতক শেষ হওয়ার আগেই শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৫ মিটার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনটা ঘটলে পৃথিবীর অসংখ্য ভূখন্ড বিলীন হয়ে যাবে; আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও পড়ে যাবে ভয়ানক বিপদে—সেটা অনুমান করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।
তিন
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বনেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজের ছবি, করণীয় নিয়ে তাদের বিভিন্ন আলাপ-আলোচনা-সমাবেশের খবর আমরা হরদম দেখি। তবু কেন যেন ভরসা পাই না! বিশেষত, প্রভাবশালী বেশ কিছু রাষ্ট্রের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের বেলায়। তাদের কপালের ভাঁজকে ভান, আশ্বাসকে মেকি মনে হয়। অন্যদিকে, বিশ্বজুড়ে এ নিয়ে জেগে উঠেছে ব্যাপক সচেতনতা। বিশেষত সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের মতো এ প্রজন্মের পরিবেশবাদী আন্দোলনকর্মীরা আমাদের দেখাচ্ছেন স্বপ্ন। কে না জানে—তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠলে আশাবাদী হয়ে ওঠাই যায়।
চার
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সদিচ্ছা থাকলে এখনো পৃথিবীকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে বাঁচানো সম্ভব। এ জন্য পরিবার থেকে শুরু করে নিজ সমাজের নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে বলতে হবে কথা। ভাগ করে নিতে হবে সচেতনতাবোধ। গাছ ও বনায়ন কতটা জরুরি, সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। বন্ধ করতে হবে নির্বিচার বৃক্ষনিধন। গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর জন্য ব্যবহার করতে হবে নবায়নযোগ্য এনার্জি। সৌরবিদ্যুৎকে এ ক্ষেত্রে ভালো নিয়ামক হিসেবে দেখছেন গবেষকেরা। তা ছাড়া পানির অপব্যবহার শুধু কমানোই নয়, বরং বন্ধ করার জন্য চালাতে হবে প্রচেষ্টা। খাদ্য নষ্ট তো করা যাবেই না, বরং একটু পরিমার্জন করে নিতে হবে খাদ্যাভ্যাস; মাংসের ওপর চাপ কমিয়ে তৈরি করে নিতে হবে সুষম খাদ্যতালিকা। আর, যতটা সম্ভব যানবাহন এড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে হাঁটার অভ্যাস। এতে স্বাস্থ্য যেমন ভালো থাকবে, প্রকৃতিও খানিকটা রেহাই পাবে দূষণ থেকে। ধীরে ধীরে ফিরে আসবে সবুজের দিন।

পাঁচ
প্রকৃতির নিয়মে ষড়ঋতুর এই দেশে এসেছে শীতের কাল। প্রাণ ত্রাহি গরমের পর এবার যেন একটু স্বস্তি! ঈষৎ উষ্ণতার আশায় সোনাঝরা রোদে খানিক বসে থাকা, মৌসুমি পিঠার স্বাদে মন জুড়িয়ে নেওয়া, নানা গল্প-কথা আর সাংস্কৃতিক আয়োজনে বিভোর হওয়ার দিন এ যে! তবু আপাতদৃষ্টে তাপমাত্রাজনিত স্বস্তির এ সময়ে আমরা যেন ভুলে না যাই মানুষ হিসেবে নিজ দায়ভার। ক্রমাগত উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে ওঠা পৃথিবীকে যথাযোগ্য শীতলতা এনে দিতে, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়—নতুন প্রজন্মের জন্য ‘বাসযোগ্য বিশ্ব’ গড়ে তুলতে আমাদের রাখতে হবে অবদান। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী যত কর্মকান্ড, নিজ নিজ জায়গা থেকে সেগুলো পরিহার করার চেষ্টা চালানো আমাদের দায়িত্ব। কেননা, একই সঙ্গে মানুষ হিসেবে এ আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নও।
এর পাশাপাশি রয়েছে মানবিক দায়বোধ। আমরা জানি, করোনাভাইরাস অতিমারি আমাদের নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এর মারাত্মক আঘাত পড়েছে অর্থনীতিতে; বিশেষত, ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ সাধারণ মানুষের উপার্জনের ওপর। তাই শীতের তীব্রতায় কোনো প্রতিবেশী, চেনা-অচেনা সাধারণ মানুষ এক টুকরো গরম কাপড়ের জন্য, একমুঠো খাবারের জন্য কাতরালে আমরা যেন মানবিক মানুষ হয়ে যথাসাধ্য তাদের পাশে দাঁড়াই।

আমাদের হৃদয়ে ও প্রকৃতির বুকে নেমে আসুক সবুজ শীতলতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top