ফিচার I কার লোন ফিরিস্তি
গাড়ি কিনবেন? চাইলেই পাওয়া যায় ঋণ, তবে ‘শর্ত প্রযোজ্য’! চোখ-কান খোলা রাখলেই চলবে না, মগজটাও সচল রাখা চাই…
মনে আছে, প্রিয় মানুষটির হাত ধরে বলেছিলেন, চাকরি হলেই একটা গাড়ি নেব? সেই গাড়িতে প্রথম বসাব তোমায়? মনে পড়ে তখনকার ছুটির দিনের প্ল্যান? তার কাঁধে মাথা রেখেই তো বলেছিলেন, ছুটির দিন মানেই লং ড্রাইভ। তোমাকে পাশে বসিয়ে রাঙাব স্বপ্ন! আমাদের অসংখ্য সম্পর্কই যেন গড়ে ওঠে এই গাড়ি ঘিরে। সম্পর্কের বন্ধনগুলো পোক্ত হয় ছোট্ট একটা গাড়ির জানালা খোলা বাতাসের এলোমেলো চুলে। স্বপ্নরা যেন নদী হয়ে ছুটে যায় গাড়ির চাকা ধরে। সেই নদীর বয়ে যাওয়া দেখতে গাড়ি যে আমাদের চাই-ই চাই! নিজের বা নিজেদের একটা ব্যক্তিগত গাড়ি চাওয়াটা এখন কেবলই স্বপ্ন নয়; চাইলেই প্রিয় মানুষটিকে পাশে বসিয়ে ধরতে পারেন স্টিয়ারিং হুইল। মেলতে পারে সম্পর্কের ডানা। চলুন, হেঁটে আসি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে!
বদলে গেল দিন
এই সেদিনও গাড়ি কেনায় ব্যাংকঋণ পাওয়া যেত ২০ লাখ টাকা। এর চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ ছিল না ব্যাংকের। সেই নিয়ম বদলে গেছে। গাড়ি কেনায় এখন ঋণ পাওয়া যায় ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এখন গাড়ির দামের অর্ধেক টাকা জোগান দিচ্ছে ব্যাংক। ২০১৪ সালের আগে কার লোনের অনুপাত ছিল ৭০:৩০; এখন বেড়ে হয়েছে ৫০:৫০। বুঝতেই পারছেন, গাড়ির দামের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ঋণ পরিবর্তন হয়ে ৫০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) অনুরোধেই এই পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের চেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও এক ধাপ এগিয়ে। তারা গাড়ির দামের ৮০ শতাংশ অথবা সর্বোচ্চ দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণসুবিধা দিচ্ছে।
এই দলে আপনিও
গাড়ি ঋণের আবেদনের ক্ষেত্রে জš§নিবন্ধন অথবা জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী আপনার বয়স ১৮ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে হতে হবে। বয়স ঠিক থাকলে চোখ দিন উপার্জনে। ব্যক্তিগতভাবে মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা হলেই গাড়ি ঋণ পেয়ে যাবেন আপনি। এ ছাড়া ঋণ দেওয়া হয় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানকেও। আপনি ছোট বা মাঝারি ব্যবসায়ী হলে ৫ বছর এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেই চলবে। চাকরিজীবী হলে আপনার চাকরি অবশ্যই স্থায়ী হতে হবে। চাকরির বয়স দুই বছর বা তার বেশি হলেই হবে। ট্রেইনি বা প্রবিশনাল পিরিয়ডে গাড়ি ঋণের আবেদন করা যায় না। ব্যবসায়ীদের ৫০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা আয় থাকতে হবে। আর বাড়ি, জমি বা ফ্ল্যাট বন্ধক রাখলে আপনার মাসিক আয় হতে হবে ৫০ হাজার টাকা। আপনি যদি স্বনিয়োজিত পেশাজীবী, যেমন ডাক্তার বা আইনজীবী হোন, তবে প্র্যাকটিসের বয়স অবশ্যই দুই বছর বা তার বেশি হতে হবে। শিক্ষক, চিকিৎসক, নারী উদ্যোক্তা ও তরুণ নির্বাহীদের দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা।
প্রয়োজন যেসব কাগজপত্র
চলুন, এবার দেখে নিই গাড়ি ঋণের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের তালিকা। সবার আগে প্রয়োজন ঋণ আবেদন ফরম। তারপর একে একে প্রয়োজন জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি, ভিজিটিং কার্ড, ব্যাংক হিসাবের বিবরণী, বেতনের হিসাবের বিবরণী, ট্রেড লাইসেন্স (ব্যবসায়ী হলে), মেমোরেন্ডাম, জামানতদারের ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র, কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন, আগের ঋণ থাকলে তার বিবরণী, আবাসিক পরিচয় নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ বা পানির বিল এবং বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট অথবা জমির দলিল। সেই সঙ্গে যে গাড়ি কিনতে আগ্রহী, তার মূল্যতালিকা।
অপেক্ষায় সিআইবি রিপোর্ট
এসব কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক বা ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আপনার খোঁজখবর নেবে। এ ক্ষেত্রে মূলত কাগজপত্রের পাশাপাশি দেখা হয় আগে কোথা থেকে লোন নেওয়া হয়েছে কিংবা অপরিশোধিত লোন আছে কি না। বাংলাদেশ ব্যাংক এতে সময় নেয় তিন থেকে পাঁচ দিন। যদি আপনার কোনো লোন আগে নেওয়া না থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) থেকে রিপোর্ট পাবে। তারপর প্রতিষ্ঠান আপনাকে জানাবে, আপনি লোন পাবার জন্য বিবেচিত হয়েছেন কি না। বিক্রেতা আপনাকে গাড়ির একটি কোটেশন দেবে, যা গাড়ির মূল্যের সমান। আপনাকে সেটি সেই ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে।
প্রক্রিয়ার চোখরাঙানি
এই প্রক্রিয়ায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আসলে এসব তেমন কষ্টেরই না! গ্রাহকের সুবিধার কথা ভেবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নিজেরাই গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে রাখে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর ৭ দিনের মধ্যে ব্যাংক গাড়ির ঋণ মঞ্জুর করে থাকলে বেশ কিছু ব্যাংক ও ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান এখন এক দিনেই ঋণ দিয়ে দেয়। তা ছাড়া ব্যাংক এখন বড় ঋণের চেয়ে ছোট ভোক্তা ঋণের প্রতি বেশি আগ্রহী। কারণ, এসব ঋণ সহজে আদায় করা যায়। তাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ির ঋণের মতো প্রয়োজনীয় ছোট ঋণ প্রদানে মনোযোগী।
সুদহার ও পরিশোধের উপায়
বর্তমানে দেশি-বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহকভেদে গাড়ি ঋণের সুদহার ১১ থেকে ১৪ শতাংশ। এসব ঋণ ৫ থেকে ৬ বছর মেয়াদি। গাড়ি কেনার পরের মাস থেকেই ঋণ পরিশোধ শুরু করতে হয়। ঋণে কেনা গাড়ির মালিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহক দুজনই। ঋণ শোধ হয়ে গেলে মালিকানা গ্রাহকের নামে স্থানান্তরিত হয়। নতুন ও রিকন্ডিশন্ড—দুই ধরনের গাড়ি কিনতেই এ ঋণ পাওয়া যায়।
ঋণ কীভাবে
প্রায় সব ব্যাংকই গাড়ি ঋণ দিয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে ইস্টার্ণ ব্যাংক ১১ শতাংশ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ১৪ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংক ১২ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংক ১১ শতাংশ সুদে গাড়ির ঋণ দিয়ে থাকে। এ ছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকও ঋণ দেয়। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১৩ শতাংশ সুদের হারে গাড়ি কেনার ঋণ দিচ্ছে। সিটি ব্যাংক ১১.৫০ শতাংশ সুদের হারে সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। তবে তাদের এই ঋণ শুধু নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ব্যাংক ছাড়া লঙ্কাবাংলা ফিন্যান্স, আইডিএলসি ফিন্যান্সসহ বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান গাড়ি ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যক্তিপর্যায়ে এই ঋণের সুদ হার ১১.৭৫ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১১ শতাংশ। আইডিএলসি ফিন্যান্স লিমিটেড নতুন ও পুরাতন উভয় ধরনের গাড়ির ক্ষেত্রে সেটির দামের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেয়। আইডিএলসি ফিন্যান্স ১১.৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ সুদের হার ধার্য করেছে এ ক্ষেত্রে। শর্ত অনুযায়ী এই সুদের হার কমবেশি হতে পারে।
রেড অ্যালার্ট
গাড়ির ঋণ তুলনামূলক নিরাপদ। তবে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের কথাও মাথায় রাখতে হবে। কোনো কারণে যদি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান গাড়িটি জব্দ করে নিয়ে নেবে। এরপর ঋণের টাকার জন্য সেই গাড়ি বিক্রি করে দেয়। হয়তো এ জন্যই গাড়ি ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই চিন্তামুক্ত।
আপনি নিশ্চয়ই সব জেনে নামবেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে দেখবেন প্রিয়জনের তৃপ্তির হাসি। এর চেয়ে দামি আর কীই-বা আছে পৃথিবীতে!
আশিক মুস্তাফা
ছবি: ইন্টারনেট