ফিচার I ভ্রমণভোজের ভুলভ্রান্তি
একটা চমৎকার ট্যুরের আনন্দ ফিকে করে দিতে পারে ফুড পয়জনিং। একের অসুস্থতা হতে পারে দশের মন খারাপের কারণ। কেউ কেউ সপরিবারে ভ্রমণে বের হন, শিশুসন্তান নিয়ে। তবে অনেক ভ্রমণবিদের যাত্রায় খাদ্যপরিকল্পনা থাকে উপেক্ষিত। অথচ এই উদাসীনতার কারণে ভ্রমণটাই হতে পারে মাটি
যেকোনো যানবাহনে ভ্রমণের প্রধান সমস্যা হলো, সেটি যাত্রীর খেয়ালখুশিমতো থামে না। প্রাইভেট ভেহিকল হলে ভিন্ন কথা। ইমার্জেন্সি কেসের আলাপও আলাদা। তবে সাধারণত বাহনগুলো নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যাত্রাবিরতি দেয় না। ফলে ক্ষুধা নিবারণের জন্য তাতে চড়ার আগেই প্রস্তুতি নেওয়া ভালো। ভ্রমণকালে কিছু সাধারণ বিষয়ের দিকে নজর রাখলেই অনাকাক্সিক্ষত বিড়ম্বনা এড়ানো যেতে পারে, বিশেষ করে পানি পানে। দীর্ঘ যাত্রায় টয়লেট অপ্রতুল। অবশ্য বিমান কিংবা লঞ্চের বিষয় ভিন্ন। বেশির ভাগ যাত্রীবাহী গাড়ি তা থাকে না টয়লেট সুবিধা। ফলে পানি পানের টাইমিংয়ে খেয়াল রাখা চাই। নয়তো মূত্র চেপে সময় কাটাতে হতে পারে, যা কিডনিসহ শরীরের কিছু অঙ্গের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। একই সঙ্গে মানসিকভাবে অস্বস্তিদায়কও। ফলে ভ্রমণের মূল আনন্দটাই ফিকে হওয়ার শঙ্কা থাকে। তা ছাড়া, যাত্রাপথে যেকোনো স্থানের যেনতেন পানি পান না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমাদের দেশে রয়েছে পানিবাহিত রোগের ছড়াছড়ি। এর ওপর ভ্রমণ মানেই নতুন স্থানে গিয়ে নতুন বাতাসের মধ্যে পড়া। তাই অসুস্থ হওয়া থেকে রেহাই পেতে যাত্রাপথে বিশুদ্ধ পানি বহন অত্যন্ত জরুরি। তবে পানির বোতল মানেই তো ভারী। সে ক্ষেত্রে সঙ্গে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট নেওয়া যেতে পারে। এক লিটারে একটি হ্যালোজেন বড়ি ছেড়ে দিলেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পানি বিশুদ্ধ হবে। এ ক্ষেত্রে ফিটকিরিও হতে পারে সঙ্গী। পথের পাশের মিনারেল ওয়াটারের বোতল কেনার চেয়ে এসব বিশুদ্ধকরণ বড়ি নিরাপদ। কেননা আজকাল অনেক নকল কোম্পানির মিনারেল ওয়াটার বেরিয়েছে। সেগুলো কাঁধে বয়ে অনেক হকারই যাত্রীদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করেন। যাত্রাপথে তাড়াহুড়ার মধ্যে পরখ করে দেখার ফুরসত না-ও মিলতে পারে।
গেল খাওয়ার পানির বয়ান। এবার আসা যাক উদরপূর্তির রসদে। সবচেয়ে সহজ করে বললে ভ্রমণকালে খোসা ছাড়া ফল কিনে না খাওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। এমনকি যাত্রাবিরতিতে রেস্তোরাঁর স্যালাড চাখতেও জিভকে নিয়ন্ত্রণ করা কর্তব্য। খোসা ছাড়ানো কিংবা কাটা ফল ও সবজি অনেকক্ষণ ধরে মুক্ত পরিবেশে থাকলে প্রাকৃতিকভাবেই সেগুলোতে জীবাণু বাসা বাঁধে। এ কারণেই এড়ানোর পরামর্শ। খোসাযুক্ত কলা হতে পারে যাত্রাপথের ছোট ক্ষুধার বড় সমাধান। খাওয়া যেতে পারে ডিমও। তবে সেটা বেরোবার সময় নিজে সঙ্গে আনাই ভালো। পিপাসা মেটাতে পথের ধার থেকে ডাব খাওয়ার অভ্যাস আছে অনেকের। এ ক্ষেত্রে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তা কাটিয়ে নেওয়া চাই। স্ট্র ব্যবহার না করে ডাবের পানি বোতলে ভরে বহন করা যেতে পারে।
ভ্রমণে সবচেয়ে নিরাপদ খাবার থেকেও জীবাণু ছড়াতে পারে। এটা খাদ্যের দোষে নয়, নিজের হাত অপরিষ্কার থাকার কারণে। ভ্রমণ মানেই বিভিন্ন স্থানে স্পর্শ। ব্যাগের হাতল, টিকিট, বাসের দরজা, সিট, আরও কত কী! সেসব থেকে রেহাই পেতে প্রতিবার খাবারের আগে হাত পরিষ্কার করা চাই। অবশ্য বারবার হাত ধোয়া কিছুটা ঝামেলার বটে। তা ছাড়া এসি বাসে এই সুবিধা কম। নন-এসিতে জানালা দিয়ে হাত বাইরে বের করা ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে হ্যান্ড স্যানিটাইজারই ভরসা।
ফলমূল ছাড়া অন্যান্য খাবারের ক্ষেত্রে প্যাকেটজাত শুকনা খাদ্যগুলোই হতে পারে ভ্রমণের উত্তম সঙ্গী, বিশেষ করে বিস্কুট ও কেক। রাস্তা থেকে এসব খাবার কেনার আগে কিছুটা ধৈর্য ধরে মেয়াদ দেখে নিতে হয়। কেননা, তাড়াহুড়ার সুযোগে কিছু অসাধু হকার মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য গছিয়ে দিতে পারেন। তবে অতি গ্যাস্ট্রিকে ভোগা ব্যক্তিদের জন্য এ দুটি পদ উপযোগী না-ও হতে পারে। তা ছাড়া ভাজাপোড়া, যেমন শিঙাড়া, সমুচা, পুরি ইত্যাদি খাবার খোলা রেস্তোরাঁ থেকে কিনে না খাওয়াই ভালো।
ভ্রমণে গরম খাবার পরিহার করা স্বাস্থ্যসম্মত। এ ধরনের খাদ্য এড়ালে হাইজেননেস ও হজম উভয়ই সুরক্ষিত থাকে। যা-ই খাওয়া হোক, হতে হবে পরিমিত। অতিভোজন ভ্রমণকালে আলস্য আনে। এতে ঘুম-ঘুম ভাব আসতে পারে। অথচ ভ্রমণের মূল আনন্দই দর্শনে। অসময়ে ঘুমালে তো ভ্রমণের ষোলো আনাই মিছে! ভ্রমণের দিনে সকালে নাশতায় আঁশযুক্ত শর্করাজাতীয় খাবার খেলে উপকার মেলে। সঙ্গে লো ফ্যাট দই এবং সামান্য মিষ্টি চা বা কফি পান করা যেতে পারে। এতে ভ্রমণকালে প্রয়োজনীয় শক্তি মিলবে শরীরে। যাত্রার শুরুতে ও ভ্রমণকালে যতটা সম্ভব রেডমিট ও পোলাও না খাওয়া মঙ্গল।
ভ্রমণ যদি দুপুরে শুরু হয়, তাহলে লাঞ্চের সঙ্গে সঙ্গেই বাসা থেকে বেরোনো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে না। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক লাঞ্চ টাইমের ঘণ্টাখানেক আগেই খেয়ে নিতে হবে। তারপর হাঁটাহাঁটি ও বিশ্রাম নিয়ে বেরোলে শরীর-মন চাঙা থাকবে। কিছু জার্নি শুরু হয় রাতে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত হজম হয় এমন খাবার খেয়ে বেরোনো ভালো। স্যুপ হতে পারে পারফেক্ট ফুড। তা ছাড়া খাওয়া যেতে পারে লো-ফ্যাট মিল্ক। মেইন কোর্সে পরিমিত ভাত কিংবা আটার রুটি খেতে বারণ নেই। তবে বেশি খেলে সমস্যা। মোদ্দা কথা, ভ্রমণের খাবারগুলো প্রাকৃতিক হলেই ভালো। বেশি তেল-মসলাযুক্ত খাবার ভ্রমণবান্ধব নয়। এ জন্য ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন। বাদ দিতে হবে বেভারেজ ও ফ্লেভারড জুস। এগুলোর বদলে খাওয়া যেতে পারে পেয়ারা, আমড়া, আনারস কিংবা ঋতুভিত্তিক তাজা ফল।
শিশু নিয়ে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক থাকা চাই। ১৮ মাস বয়সের কম বয়সী শিশুদের নিয়ে দীর্ঘ যাত্রার ক্ষেত্রে ওর খাবার কী হবে, এ বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। আরেকটু বেশি বয়সের বাচ্চারা বাইরের খাবারের প্রতি বেশি আগ্রহী। তাই খোলা খাবার বিক্রি হয়—শিশু কোলে নিয়ে এমন স্থানের আশপাশে না থাকাই ভালো।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট