ফিচার I আহারে প্রেম আহা রে!
প্রেম না থাকলে কিছু খাবারের হয়তো উৎপত্তিই হতো না। এমনকি প্রেম নিবেদনের আগে প্রেমিকাকে ভরপেট খাওয়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন গবেষকেরা
প্রেম ও দাম্পত্যের সঙ্গে খাবারের প্রত্যক্ষ একটা যোগ আছে। লাভ প্রপোজ কিংবা বিয়ের দেখাদেখি আজকাল রেস্তোরাঁতেই হয়। খাবারের জন্য যেমন যুদ্ধ হয়েছে, তেমনি কিছু খাবারের উদ্ভব ও নামকরণ হয়েছে প্রেম ঘিরে। এ নিয়ে বাকরখানির ইতিহাসে চোখ বোলানো যেতে পারে। এর উৎপত্তির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এক অম্লান প্রণয়-কিচ্ছা। প্রচলিত ঘটনাটি হলো: মুর্শিদকুলি খাঁ দেওয়ানি লাভ করে বাংলায় আসেন ১৭০০ সালে। তার সঙ্গে আসেন আগা বাখর খান। বাখর তখন বালক। কেউ তাকে মুর্শিদকুলির সন্তান বলেন, কেউ বলেন পালকপুত্র। বাখরকে পুত্রস্নেহেই লালন করেছেন মুর্শিদকুলি খাঁ। বড় হয়ে বাখর সুপুরুষ হয়ে ওঠেন। আসীন হন সেনাবাহিনীর উচ্চ আসনে।
একসময় মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থাপন করেন মুর্শিদকুলি খাঁ। বাখর তখন চট্টগ্রামে উচ্চ পদে আসীন। সে সময় বর্তমান বাংলাদেশের আরামবাগ নামের স্থানে ছিল খনি বেগম নামে একজন নর্তকীর বসবাস। ওই নারীর প্রেমে মজেন বাখন। কিন্তু প্রেমের পথে কাঁটা ছিল। বাধা হয়ে দাঁড়ান আরেক রাজসদস্যের পুত্র; নাম—জয়নুল খাঁ।
জয়নুলও খনি বেগমের প্রেমে পড়েছিলেন। নানান ছলাকলায় তাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে যায়। শেষে উপায়ান্তর না দেখে বাঁকা পথ বেছে নেন। খনিকে অপহরণের চেষ্টা চালান। তাতে বাধা দেন প্রেমিক বাখর খান। এই ‘বাধা’ দেওয়াটিই ‘হত্যা’ নামে চাউর হয়। গুজব ওঠে, বাখর হত্যা করেছেন জয়নুলকে। গুজব পৌঁছায় জয়নুলের বাবার কান পর্যন্ত। পুত্রের মৃত্যুসংবাদে উন্মত্ত হয়ে বাখরকে গ্রেপ্তার করান তিনি। বাখরের বিচার করেন মুর্শিদকুলি খাঁ। বিচারে তাকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে মৃত্যুদন্ডের রায় দেওয়া হয়। কিন্তু রায় কার্যকরে সফল হওয়া যায়নি। বাঘকে বাহুবলে পরাস্ত করে খাঁচা ভেঙে পালিয়ে যান বাখর খান। সেই ফুরসতে জয়নুল ফিরে এসে খনিকে অপহরণ করে গভীর জঙ্গলে বন্দি করে রাখেন। খবর পেয়ে তাকে উদ্ধারে যান বাখর। ঘন জঙ্গল থেকে পালাতে গিয়ে সাপের ছোবলের শিকার হন খনি। মুমূর্ষু খনির সঙ্গে পথিমধ্যে সাক্ষাৎ হয় বাখরের। তার কোলে মাথা রেখেই মারা যান খনি।
পাশাপাশি আরেকটি ঘটনাও প্রচলিত আছে। বাখর যখন খনিকে উদ্ধারে জঙ্গলের দিকে যান, তার পিছু নেন উজির জাহান্দার খান। তিনি সম্ভবত জয়নুল খানের পিতা। জয়নুলের সঙ্গে জঙ্গলে দাঙ্গা বাধে বাখরের। জয়নুল বাখরকে হত্যার চেষ্টা করেন, কিন্তু উজির জাহান্দার তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করেন জয়নুলকে। মৃত্যুর আগে জয়নুল তলোয়ার চালান খনির ওপর। মৃত্যু হয় খনি বেগমের। বাকেরগঞ্জে সমাধিস্থ করা হয় তাকে। বাখর সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে থেকে যান সমাধি অঞ্চলেই। মানে দক্ষিণবঙ্গে।
পরে বিধায়কের পদ গ্রহণ করে সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন বাখর। তখন রসুইঘরে বিভিন্ন খাবার নিয়ে চর্চা করতেন তিনি। এ সময়ে রুটি জাতীয় একটি খাবার তৈরি করেন। নিজের প্রেমের স্মৃতিস্বরূপ সেই খাবারের নাম দেন ‘বাখরখনি’। পরবর্তী সময়ে কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে তা ‘বাকরখানি’ নামে পরিচিতি পায়। বাখর তার আবিষ্কৃত এই খাদ্যকে রাজপরিবারে আবদ্ধ না রেখে গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন ঢাকা, বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গায় খাবারটি জনপ্রিয়। অবশ্য অনেকে বাকরখানির উৎপত্তিস্থল হিসেবে সিলেটের কথাও বলেন। সে যা-ই হোক, এই খাবারের উৎপত্তির পেছনে এভাবে জড়িয়ে আছে বাখর ও খনির প্রেমের ইতিহাস। বলে রাখা ভালো, জয়নুল, বাখর—এসব ব্যক্তির নামের বানান একেকজন একেকভাবে লেখেন।
সঙ্গিনীর প্রতি প্রেম থেকে আরও কিছু খাবারের উৎপত্তির কথা শোনা যায়। যেমন ফেতুচ্চিনি আলফ্রেদো। ঘটনাটি রোমের। সেখানকার এক রেস্তোরাঁর প্রধান শেফ ছিলেন আলফ্রেদো দি লেলিও। স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন এই রসুইকর। তাই তো গর্ভবতী অবস্থায় তাকে বিশেষ পদ খাওয়ানোর ইচ্ছা হয়েছিল আলফ্রেদোর। নিজের ভালোবাসার সঙ্গে পনির ও মাখন মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন বিশেষ এক পদ। সেটি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় খাবার। তা ছাড়া প্রথম বিক্রয়যোগ্য পুডিং তৈরির ইতিহাসও জড়িয়ে আছে প্রেমের সঙ্গে। এটি ব্রিটেনের ঘটনা। সাল ছিল ১৮৩৭। সে দেশের বাসিন্দা ছিলেন আলফ্রেড বার্ড। তার স্ত্রীর ছিল ডিমের প্রতি অনীহা। তাই আলফ্রেড স্ত্রীকে খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে পুডিং তৈরির রেসিপি আবিষ্কার করেন। সেটিই ছিল বিক্রয়যোগ্য প্রথম পুডিং।
প্রেমিকাকে খুশি রাখতে বেশি করে খাওয়ানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণাও হয়েছে। সেটি যৌথভাবে করেছে ফিলাডেলফিয়ার ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া। গবেষণা মারফত জানা গেছে, খালি পেটে থাকা অবস্থায় নারীরা রোমান্টিক মুডে থাকেন না; থাকেন ভরা পেটে। গবেষণা চালানোর জন্য স্বাভাবিক ওজনের কজন নারীকে ৮ ঘণ্টা অভুক্ত রাখা হয়েছিল। এরপর এমআরআইয়ের মাধ্যমে দেখা গেছে, তাদের মস্তিষ্ক সাধারণ জড় বস্তু ও রোমান্টিক ছবি দেখে একইভাবে সাড়া দিচ্ছে। কিন্তু ভরা পেটে তাদেরকে রোমান্টিক ছবিগুলো দেখানো হলে তাদের মস্তিষ্ক দিয়েছে ইতিবাচক সাড়া। এসব উপাত্ত বিবেচনা করে গবেষকেরা মত দিয়েছেন, ক্ষুধার্ত অবস্থায় নারীরা প্রেমিকের দিকে নয়, মনোযোগ দেন খাবারের দিকে। তাই প্রেম নিবেদনের আগে প্রেমিকাকে বেশি করে খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট