ছুটিরঘণ্টা I বাজারের অলিগলিতে প্রাণের ঝরনা
মণিপুরের ইমা মার্কেট। নারী পরিচালিত পৃথিবীর একমাত্র বাজার। বাহারি পসরার পাশাপাশি নারী স্বাধীনতার এক অনন্য উদাহরণ। সেই বাজার ঘুরে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
এ এক বিরাট বাজার, যেখানে যেকোনো পোশাকে ভীষণ দর্পের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে পারেন নারীরা। আচমকা কোনো পুরুষের গায়ে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা নেই। কিংবা কেউ এখানে অভদ্রের মতো করে না ধাক্কাধাক্কি। তা ছাড়া অকারণে, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কোনো পুরুষের কটু কথা শোনার ভয়ও নেই। পশ্চাৎপদ মানসিকতার কেউ বলবে না, ‘আপনি তো মহিলা মানুষ, বাজারে এসেছেন কেন?’ এমন একটা বাজারের স্বপ্ন সম্ভবত বাজার করতে ভালোবাসা প্রত্যেক নারীই দেখেন। এ বাজারের নাম ইমা মার্কেট। ভারতের মণিপুর রাজ্যের হৃদয় এ বাজার। ফল, সবজি, কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে তৈজসপত্র—সবই পাওয়া যায়। আশ্চর্যের কথা হলো, এ বাজারের সব বিক্রেতাই নারী। শুধুই নারী পরিচালিত পৃথিবীর একমাত্র বাজার এটি।
একদিন আমি মণিপুরের রাজধানী ইমফলের কাংগলা প্রাসাদ দেখে সবে বেরিয়েছি। বাইরে বেশ মিষ্টি রোদ। শীত শেষে বসন্তকাল শুরু হয়েছে। মণিপুর রাজ্যের বসন্তকালের পাতা ঝরা, হাওয়ার নাচানাচি দেখতে দেখতে বিশাল প্রাসাদ প্রাঙ্গণ এসেছি পেরিয়ে। এতকালের এত ভ্রমণে, উত্তর-পূর্ব ভারতে এত বড় প্রাসাদ প্রাঙ্গণ এর আগে কখনো চোখে পড়েনি আমার। এখান থেকে আমার গন্তব্য ইমা মার্কেট। ইমা শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘মা’। তার মানে, মায়েদের বাজার।
ইমফল শহরে খুব একটা ট্যাক্সি বা অটোরিকশা চোখে পড়ে না। এখানে ভ্রমণার্থী তেমন আসেন না বললেই চলে। তাই আসার আগে আমাকে কতজন যে কত ভয় দেখাল! ‘ওখানে যেয়ো না, আন্ডারগ্রাউন্ড উগ্রবাদী দল আছে। ট্যুরিস্ট পেলে তো কথাই নেই। জিম্মি করে সরকারের কাছ থেকে তাদের দাবি আদায় করবে…’, আরও কত কী। নিজেকে অভয় দিলাম, আমি তো ট্যুরিস্ট নই। যখন যে দেশে যাই, তখন আমি সেই দেশেরই মানুষ। আমাকে কেন ধরবে লোকে? আমি তো নিরীহ গোবেচারা পথিক! দু দণ্ড বসে চলে যাব, এতে কারও কোনো ক্ষতি হবে না।
এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের নিজের গাড়ি বা মোটরসাইকেল আছে। আর গণপরিবহন হিসেবে টেম্পোর মতো একধরনের যানবাহন চলে। বাস চলে কদাচিৎ। আমি ততক্ষণে কাংগলা প্রাসাদের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে। ইমা মার্কেট এখান থেকে খানিক দূরে। হেঁটে যাওয়া যাবে না। বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে যাব। কয়েক মিনিট পর দেখি, টেম্পো চালিয়ে এক ইমা আসছেন আমার দিকে। ইমার পরনে জিনসের প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট, পায়ে স্নিকার, মাথায় হ্যাট, হাতে গ্লাভস, চোখে সানগ্লাস। মণিপুরি ইমা আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘যাবে কোথায়?’
আমি ইমা মার্কেটের কথা বলতেই ইশারায় বললেন, ‘আমার পাশে বসো।’ পাশে বসিয়ে উড়িয়ে চললেন টেম্পো। টেম্পো তো নয়, যেন পঙ্খিরাজ! পেছনে আরও চার যাত্রী বসা। সবাই স্থানীয়। মার্কেটের কাছে আমাকে নামিয়ে দিয়ে চালক ইমা বললেন, ‘এসে গিয়েছে।’ আমি তাকে ভাড়া সাধতেই মাথা নাড়িয়ে জোর গলায় বললেন, ‘তোমার কাছ থেকে টাকা নেবই না।’ তার ব্যবহারে আমি মুগ্ধ, আপ্লুত। জগতে এখনো পরদেশির অভ্যর্থনা বহাল আছে তাহলে! শুধু বললাম, ‘ইউ আর মাই হিরো।’ তিনি থাম্বস-আপ দেখিয়ে, পঙ্খিরাজ ঘুরিয়ে নিজ গন্তব্যে চললেন।
মূল ইমা মার্কেট আরও খানিকটা হাঁটা পথ। তবে পথের দু ধারেই বসেছে অস্থায়ী বাজার। টুকরি বা বড় বড় এনামেলের গামলা ভরে সব ইমা বসে পড়েছেন পসরা সাজিয়ে। কারও ঝুড়িতে ফল বা সবজি, কেউ বসেছেন তাজা মাছ নিয়ে, কেউ আবার এখানকার খাবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—শুঁটকি নিয়ে বসেছেন। এ রাজ্যে শুঁটকিকে বলা হয় নারি। কিছু কিছু শুঁটকির রং কুচকুচে কালো। সাধারণত এই শুঁটকির পেস্ট বানিয়ে সবজি বা স্যালাডে মিশিয়ে খাবার বানানো হয়।
এতক্ষণে আকাশের এক কোনা দিয়ে রোদের সোনারং ছড়িয়ে পড়ছে। বিকেলের আলো গুঁড়ো গুঁড়ো সোনালি আফসানের মতো গায়ে-মুখে মেখে যাচ্ছে, মায়া বাড়াচ্ছে। আরেক দিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখি, মণিপুরি স্বতন্ত্র, স্বাবলম্বী, আত্মবিশ্বাসী মেয়েরা টেম্পল বর্ডারের ফানেক পরে সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। ফানেক হলো লুঙ্গির মতো করে পরিধেয় মণিপুরি নারীদের বস্ত্রখণ্ড। গায়ে ব্লাউজ আর রঙিন ওড়না জড়ানো। আমার এক অদ্ভুত কারণে মণিপুরের প্রতি আলাদা করে তোলা ভালোবাসা রাখা আছে। হঠাৎ উছলে পড়ে। আর ভারতের সব রাজ্যের মধ্যে মণিপুরি মেয়েদেরকে আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর ও নির্মল মনে হয়।
মণিপুরি মেয়েদের পরিধেয় ফানেকের সঙ্গে কিন্তু আমাদের দেশের মণিপুরি শাড়ির কাপড়ের কোনো মিল নেই। মণিপুরি শাড়ি তৈরি হয় খুব হালকা বুননে, কাপড়ের নিচে হাত রাখলে দেখা যায়। অন্যদিকে, ফানেক তৈরি হয় তুলনামূলক মোটা সুতি বা সুতি-সিল্ক মিক্সড কাপড় দিয়ে। এর সঙ্গে অতি অবশ্যই থাকে ত্রিভুজাকৃতির টেম্পল বর্ডার। অবশ্য মণিপুরি নারীরা পোশাকের সঙ্গে যে ট্র্যাডিশনাল ওড়না পরেন, সেটি বেশ মোলায়েম সুতি কাপড়ের টেম্পল বর্ডারের। একেক রং আর তার পাড়ের শোভা দেখে মনে হয় যেন সারা দিন বসে বসে দেখি। অবস্থাপন্ন ঘরের নারীরা বিভিন্ন বাহারি ওড়না পরেন। সাধারণ নারীরা ওড়না সচরাচর পরেন না; ব্লাউজ আর ফানেক পরেই স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করেন পথেঘাটে।
মণিপুর রাজ্যে শুনেছি নারীদের জয়জয়কার। নারীরা এখানে অসীম স্বাধীনতা উপভোগ করেন। আমার এক বন্ধু তো বলেই ফেলেছিল, মণিপুরের নারীরা রাস্তায় সুদর্শন পুরুষ দেখলে মাঝেমধ্যে নাকি ‘টিজ’ করে! কথা নেহাত মিথ্যে নয়। ইমা বাজারের আশপাশে যেসংখ্যক নারীকে চলাফেরা দেখছি, তাতে এ ব্যাপারে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ কারণেই আমার মণিপুরি নারীদের এত ভালো লাগে। কী সহজ, সরল, সুন্দর, সাবলীল! গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালিয়ে, ফানেক, ব্লাউজ, ওড়না পরে নারীরা এসেছেন ইমা মার্কেটে বাজার করতে। কেউ কেউ পিঠে ছোট বাচ্চা কাপড় দিয়ে বেঁধে হেঁটে যাচ্ছেন বাজারের দিকে। এই বাজারে ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। বাজারটিও নতুন নয়। ৫০০ বছর ধরে মা হয়ে, ছায়া হয়ে, দাত্রী হয়ে আগলে রেখেছে এই অঞ্চলের নারীদের অর্থনীতি।
এ বাজারের সব ব্যবসায়ীই নারী, এটাই নিয়ম। তবে জিনিসপত্র কিনতে পুরুষেরাও আসতে পারেন। ইমা মার্কেটের বাইরে যেসব নারী বসেছেন, তাদের দোকান—ভাড়া দেবার সামর্থ্য নেই। এদের মাঝে কয়েকজন মুসলমান নারীকেও দেখলাম ঝুড়ি ভরে ফল, সবজি বা শুঁটকি নিয়ে ফুটপাতে বসে আছেন। এদের পরনে ফানেক, ব্লাউজ আর মাথায় ওড়না। এরাও অন্যদের মতো উচ্ছল, প্রাণচঞ্চল।
ইমা মার্কেট দেখতে আমাদের দেশের যেকোনো বাজারের মতো। দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্র থেকে শুরু করে স্থানীয় তৈরি শৌখিন যেকোনো জিনিস এখানে পাওয়া যায়। টিনের চাল আর টিনের বেড়া দেওয়া বিশাল এই মার্কেট দেখা শুরু করলাম সবজির বাজার দিয়ে। সব ধরনের তাজা সবজি রাখা। সবুজ রং ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। মণিপুরের পাহাড়ি পথের মতো মখমলি, জ্বলজ্বলে সবুজ ছড়ানো এখানে। টাটকা ঘ্রাণে আমারও এদের মতো ইমা বিক্রেতা হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। সবজির পাশে ফলের বাজার। তার পাশে পানসুপারির পসরা নিয়ে বসেছেন আমাদের ইমা। এ রাজ্যে পানের খুব কদর। পান ছাড়া মণিপুরি আদবকায়দা যেন ঠিকমতো প্রকাশ পায় না। বাজারের আলাদা অংশ করা আছে পানসুপারির জন্য। ক্রেতাও অনেক।
এদের পাশে হস্তশিল্পের দোকান পাশাপাশি সাজানো। মণিপুরি ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা পুতুল, বাঁশের ঝুড়ি, ডালা, কুলা, মাদুর সাজানো দোকানে দোকানে। এদিকটায় ভিড় কম। এক দোকানের ইমা তাই লম্বা হয়ে শুয়ে দুপুরের বিশ্রাম করছেন। আহা, কী নির্ভার, নিশ্চিন্ত জীবন! কী স্বাধীন যাপন! পুরুষ ক্রেতারা সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন; কিন্তু নিজ দোকানে শুয়ে থাকা ইমার দিকে বাজে দৃষ্টিতে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। এর খানিক দূরে সারি সারি দোকান ছুরি, চাকু, দা, বঁটি, কোদাল, কাস্তের। এত সুন্দর করে সাজানো এসব অস্ত্রশস্ত্র দেখে মোটেও ভয় লাগে না। উল্টো মনে হয়, কী যে গোবেচারা, রংবেরঙে সেজে আসর রঙিন করতে চাইছে! এরপরই বিশাল সেকশন আমাদের, মানে নারীদের অতি প্রিয় কাপড়ের দোকানে ঠাসা। এটাই এ মার্কেটের মূল আকর্ষণ। অস্থায়ী দোকানগুলোতে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ ফানেক আর ওড়না রঙধনু হয়ে খেলছে যেন। একটা শিশুকে চকোলেটের বিশাল দোকানে ছেড়ে দিলে যে অবস্থা হবে, আমার এখন সেই অবস্থা! কোন দোকান ছেড়ে কোন দোকানে যাব, কী রেখে কী দেখব, দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি।
সব রঙের ফানেক আর ওড়না আছে এদের স্টকে। টেম্পল বর্ডার আর জমিনে ফুল-পাতা নকশার বুনন। এই নকশার সঙ্গে আমাদের দেশের মণিপুরি শাড়ির নকশার কোনো ফারাক নেই। তবে কাপড়ের সুতা আমাদের চেয়ে ভিন্ন। কাপড়ের সেকশনের ইমাদের আমার কাছে সবচেয়ে চঞ্চল বলে মনে হলো। একেকজনের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে; কিন্তু এই মায়েরা আচরণে একদল কিশোরী যেন। আসলে কিশোরী হয়ে উঠবার জন্য কোনো বাঁধাধরা বয়স থাকতে নেই। যেকোনো বয়সই কিশোরী হওয়ার জন্য আদর্শ—এই ইমারা যেন তার এক দারুণ দৃষ্টান্ত। এরা প্রায় প্রত্যেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি। সকালে গোসল সেরে, চন্দনের টিকা এঁকে নেন কপালের উপরিভাগ থেকে নাক অবধি। কানে গোঁজেন ফুল। পূত-পবিত্র হয়ে খোলেন নিজ নিজ ব্যবসার পসরা। এখন এরা আমার সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত। একশ জনের বেশি ইমার ছবি তুলেছি আমি এই বাজারে; কিন্তু কারোরই এতটুকু ক্লান্তি নেই। এরা এতই প্রাণবন্ত, ভ্রমণক্লান্তি ভুলে আমিও চাঙা হয়ে উঠেছি। এরা ছবি তোলার সময় নিজে থেকেই বিভিন্ন পোজ দিয়ে আমাকে হাসাচ্ছেন; হাসছেন নিজেরাও। আমাকে ফল, স্ন্যাকস খেতে দিচ্ছেন। কোনো জড়তা নেই। পাহাড়ি ঝরনার মতো কলকল করে বয়ে যাচ্ছে প্রাণোচ্ছ্বাস। সবচেয়ে মন ভরিয়ে দেওয়া ব্যাপার হলো, এই ব্যবসায়ী নারীদের মাঝে কোনো ধরনের ঈর্ষা বা প্রতিযোগিতার মনোভাব নেই। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আপনজন। সবার মুখেই হাসি। কত কিছু যে শেখার আছে এই ইমাদের কাছ থেকে।
সন্ধ্যা হলে বন্ধ হয় বাজার। যে যার সংসারে ফিরে যান। আমি ফিরি মণিপুরি ইমাদের খুব কাছ থেকে দেখা স্মৃতি মনে সাজিয়ে, মালা বানিয়ে গলায় পরে। স্বপ্নের মতো এক জনপদকে খুব কাছ থেকে দেখে, জেনে, মনের মাঝে কয়েক হাজার পিছুডাক নিয়ে আমি সত্যিই সত্যিই ইমা বাজারের ইমাদের মতো হওয়ার বাসনা নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
ছবি: লেখক