যাপনচিত্র I ইচ্ছেডানার শক্তি
মমতাজ বেগম। ‘মমতাজ’ নামেই অধিক খ্যাত। একাধারে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, জাতীয় সংসদ সদস্য এবং উদ্যোক্তা। প্রায় ১০ হাজার গানে ছড়িয়েছেন কণ্ঠের জাদু। ব্যস্ততার ফাঁকে তার একান্ত জীবনের গল্প…
ঘুমঘুম সকাল
ঘুমোতে খুব পছন্দ করেন তিনি। সুযোগ পেলে সকাল ১০টা-১১টা পর্যন্ত একটু আয়েশ করে ঘুমিয়ে নিতে চান। কিন্তু গানের ব্যস্ততা, রাজনৈতিক ব্যস্ততা, সামাজিক কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততার মিছিলে একটু বেলা করে ঘুমোনোর সুযোগ পাওয়া তার পক্ষে বেশ মুশকিল। বেশির ভাগ দিনই খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। প্রস্তুতি নিতে হয় বৈচিত্র্যময় ব্যস্তজীবনের কর্মযজ্ঞের। তবু বিরল অবসর যদি মিলে যায় কোনো দিন কোনোমতে, মমতাজ সেদিন একটু দেরি করেই ওঠেন ঘুম থেকে। তারপর মন দেন জমে থাকা নিজের কাজকর্মে। নিজের ঘর, নিজের বিছানা, নিজের শখের শাড়িগুলো গুছিয়ে রাখতে ভালো লাগে তার। তা ছাড়া বাসায় কী রান্না হবে, কে কোন কাজ করবে—সেই সব গৃহস্থালি দিকনির্দেশনাও দিতে হয়। বললেন, ‘নিজের হাতে রান্না না করলেও সবকিছু দেখভাল করতে হয় আমাকেই।’ দিনের প্রথম দুই প্রহর এভাবেই কেটে যায়।
সন্তানের ঘ্রাণ
অবসর দিনে পরিবারকে সময় দিতে ভালোবাসেন এই গানের পাখি। সংসারে তার দুই মেয়ে, এক ছেলে। ঘরদোর গোছানো শেষে ওদের সঙ্গে সময় কাটান। গল্পের ছলে জেনে নেন, কোন সন্তানের পড়াশোনার কী অবস্থা, কী প্রয়োজন। সেগুলো মেটানোর পদক্ষেপ নেন। ওদের প্রিয় কোনো খাবার সামনে নিয়ে বসে যান আড্ডায়। বললেন, ‘করোনাকালে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বাসার বাইরে খুব একটা যেতে পারিনি। এখন সেই সুযোগ করে উঠতে পারলে বের হই। নয়তো অনলাইনে খাবার অর্ডার করি।’ তবু অখণ্ড অবসর বলতে যা বোঝায়, তা যেন আর লেখা নেই এই তুমুল জনপ্রিয় মানুষটির ভাগ্যে। সেদিনও প্রচুর ফোনকল আসে, নানা সমস্যা নিয়ে বাড়ি এসে হাজির হয় তার নির্বাচনী এলাকার অনেক মানুষ; পরিবার ও সন্তানদের সময় দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তাই সেদিনও ফোনে কিংবা সাক্ষাতে বাইরের মানুষদেরও সময় দিতে হয়।
গানের চর্চা
‘আমি কোনো দিনই টাইম ধরে রেওয়াজ করিনি। এটা যদিও প্রত্যেক শিল্পীর প্রয়োজন এবং করা উচিত; কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ছোটবেলা থেকেই ভোরে উঠে রেওয়াজ করা হয়নি।’ কারণ হিসেবে বললেন, ‘আমার চর্চাটা সব সময়ই হতো বিকেল থেকে। যখন বাবার কাছে গান শিখতাম, তখন আমাদের উঠোনে গানের চর্চা সব সময় সন্ধ্যার পরে হতো। কখনোই ভোরবেলা উঠে করা হয়নি। সন্ধ্যাবেলা জোছনা রাতে চাঁদের আলোয়, কিংবা কুপি বাতি জ্বালিয়ে, উঠোনে পাটি বিছিয়ে, নিজেদের আত্মীয়স্বজন বা এলাকার লোকজনের সামনে আমাদের গানের আয়োজন বসত। আমার শেখাও হতো, আবার আশপাশের সবাই শুনত…এটা প্রতিনিয়ত ছিলই। যেদিন প্রোগ্রাম থাকত, ওই দিন রাতে আর এভাবে বসা হতো না।’
সন্ধ্যায় কেন? মমতাজ আরও বলেন, ‘আমাদের প্রোগ্রামগুলোই হতো রাতে। সারা রাত প্রোগ্রাম। প্রোগ্রাম শেষ করে সকালে ঘুমোতে যেতাম; তাই সন্ধ্যার আগে চর্চা করা সম্ভব হতো না। এখনো ঠিক ওই রকমই, যদি গান শুনতে বা গাইতে ইচ্ছে করে, আসলে সকালবেলাটা আমার জন্য কখনোই এসব করা ওভাবে হয় না। সব সময় বিকেলের দিকেই হয়ে থাকে। এখনো রেকর্ডিং বিকেল টাইমেই, আফটার লাঞ্চ প্রেফার করি। তখন বোধ হয় গলার সুরটা ভালো থাকে। অন্যদের কী হয় জানি না; তবে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপর আমার গলার সুর অতটা সুন্দর থাকে না। ঘুমঘুম, ভারী হয়ে থাকে কণ্ঠ। দুপুরের পরে বিকেল যত গড়াতে থাকে, আমার গলা তত খুলতে থাকে। এ কারণে বিকেলে, সন্ধ্যায় বা রাতে রেকর্ডিং করি।’
মাছের টান
সকালবেলা ভারী খাবার খেতে চান না এই গুণী শিল্পী। সকালটা হালকা নাশতা দিয়েই পার করেন। সাধারণত পানীয় বা জুস থাকে মেনুতে। দুপুর হলে বাসার খাবার খান। এ ক্ষেত্রে সবজি ও মাছ তার প্রিয়। তবে সেটা হতে হবে নদীর মাছ। চাষের মাছ তিনি একদম পছন্দ করেন না। মানিকগঞ্জের এই সাংসদ বললেন, ‘আমাদের এলাকা সবজির জন্য বিখ্যাত। সবজি খাই। এখনকার বাচ্চারা তো মাংস পছন্দ করে। মাংস খেতে আমার অত ভালো লাগে না।’ অন্যদিকে, রাতের বেলাও হালকা নাশতায় পার করেন তিনি। যদিও সন্তানেরা ফ্রোজেন ফুড, জাংক ফুড পছন্দ করে এ সময়ে; কিনে এনে সেগুলোর প্রক্রিয়াকরণে সন্তানদের তিনি সাহায্য করেন ঠিকই, তবে নিজে মুখে তোলেন না।
পোশাক-আশাক, সাজগোজ…
‘আমার প্রথম পছন্দ শাড়ি। শাড়িতে খুবই কমফোর্ট ফিল করি। আর শাড়ির মধ্যে ডিজাইনের শাড়ি খুব পছন্দ। দেশি জামদানি খুব পছন্দ। যেকোনো ডিজাইনারের কাপড়ের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে। শাড়ি পছন্দ করে কিনি, যখন যেখান থেকে পারি,’ বলেন মমতাজ। সাজগোজের ব্যাপারে বলেন, ‘আমি নিজের মতো করে নিজেই সাজতে পছন্দ করি। ন্যাচারাল সাজ পছন্দ। অতি মেকআপ, অতি সাজ আমার অপছন্দ। তবে অনেক সময় লাইটের কারণে, ক্যামেরার জন্য বেশি গর্জিয়াস সাজতে হয়। কিন্তু ফ্রেশ থাকা, স্কিনটাকে ফ্রেশ রাখা, ভালো রাখা—এর জন্য ভালো কোয়ালিটির বা ভালো ব্র্যান্ডের মেকআপ বা কসমেটিকস চিন্তাভাবনা করে ব্যবহার করি।’
নিজের গানে নিজের সন্ধান
সাত শতাধিক অ্যালবাম মুক্তি পেয়েছে তার। অ্যালবাম ও সিনেমার প্লেব্যাক মিলিয়ে গানের সংখ্যা ১০ হাজারের মতো। এর মধ্যে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে যাওয়া গান অনেক। তিনি বললেন, ‘আসলে গীতিকবিরা নিজের এবং আশপাশের মানুষের জীবনের গল্পই গানে তুলে আনেন। তাই বিশেষ করে আমার গান সবার জীবনের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে মিলে যায়। এ রকম অসংখ্য গান আছে। আধ্যাত্মিক গানগুলো বেশি ভালো লাগে।’ একটা গানের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করলেন এই শিল্পী। বললেন, ‘আমি শাহ আলম সরকারকে একদিন বলেছিলাম, “ভাই, একসময় আমার এই নাম, যশ, খ্যাতি; স্টেজে উঠলে এত হাততালি, এত মানুষের ভালোবাসা—সবই পড়ে থাকবে, আমি সেদিন এই পৃথিবীতেই থাকব না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাকে দু-একটা গান দিয়েন।”’ কথা রেখেছিলেন সেই গীতিকবি। মমতাজের জন্য তৈরি করেছিলেন জনপ্রিয় এই গান—‘এক কাপ চা নিয়ে ভাগ করে খাওয়া/ আড্ডার টেবিলে বসে/ মঞ্চে শ্রোতাদের হাততালি পাওয়া/ আমার এই বাংলাদেশে/ সব হয়ে যাবে স্মৃতি/ স্মৃতি হবে গাওয়া গীতি/ দেহ থেকে প্রাণটুকু বেরোলেই,/ লেখা হবে পত্রিকায় শোক সংবাদ:/ “ওরে, মমতাজ আর ভবে বেঁচে নেই…”।’
এ গানের সূত্র ধরে, স্মৃতিতে ডুব দিয়ে মমতাজ বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ির সামনেই চায়ের সুন্দর টংঘরগুলো ছিল। ওখানে বসে এলাকার লোকজনকে নিয়ে চা খেতাম, গল্প করতাম। আমরা হয়তো ১০ জন আছি, দোকানদারকে বলতাম, “পাঁচ-ছয়টা চা দাও, আর দুই-তিনটা খালি কাপ দাও, ভাগ করে খাই…।” এই যে দৈনন্দিন জীবন, এই যে সময়টা আমরা পার করে এসেছি, এটা একদম বাস্তব। পৃথিবী থেকে আমি চলে যাব—এটা একদিন হবেই হবে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এই গানটা আমার জীবনের জন্য সবচেয়ে সত্য গান।’
খ্যাতির বিড়ম্বনা
খ্যাতি অর্জন যতটা কষ্টের, সামলানো তার চেয়ে কম যাতনার নয়। তুমুল খ্যাতিমান মমতাজ বলেন, ‘খ্যাতি সামলানোর বিষয় হলো ধৈর্য থাকা এবং সবকিছুকে ইতিবাচকভাবে দেখা। প্রয়োজনে অনেক ছোট ছোট চাওয়াকে বিসর্জন দেওয়া।’ উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘সেদিন শুটিং শেষে ফেরার পর দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিশেষ দিবসে অনেক ছেলেমেয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে, ফুচকা খাচ্ছে। আমারও ইচ্ছে করল। অথচ গাড়ি থেকে নামতে পারিনি। নামলে দেখা যেত, হাজারটা সেলফির জন্য আমাকে প্রস্তুত হতে হচ্ছে, হাজার মানুষের হাজারও আবদার শুনতে হচ্ছে। তাই ছোটখাটো নিজের অনেক চাওয়া ইচ্ছে থাকলেও পূরণ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আমার ধৈর্য আছে। স্রষ্টা আমাকে এমন কিছু দিয়েছেন, যা এদের দেননি। এরা বসে আছে, এদের তো কেউ জিজ্ঞেস করছে না। এই যে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, কাছে আসার চেষ্টা করছে—এটা আমার অনেক জনমের প্রাপ্তি। এটাই আমার মনে ইতিবাচক ভাবনা জাগায়। এ কারণে ওই সব ছোটখাটো চাওয়া আরও গৌণ হয়ে যায় নিজের কাছে।’
জীবনবোধ
জীবনটাকে গড়তে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে মমতাজকে। যুদ্ধ বলতে পরিশ্রম বোঝান তিনি। বলেন, ‘টার্গেটের ব্যাপারে আপোসহীন ছিলাম। “আমি শেষ সীমানায় যেতে চাই”—এই ইচ্ছেশক্তি অনেক বড়। হাল ছাড়িনি কোনো কিছুতে। সাময়িকভাবে একটু কষ্ট লাগলেও প্রাপ্তিতে পরবর্তীকালে ভুলে গেছি।’
নতুন প্রজন্মের প্রতি তার পরামর্শ, ‘যেই মাধ্যমেই কাজ করবেন, প্রথমে মানসিকতা তৈরি করতে হবে, “আমি এখানে আছি। চেষ্টা করলে ওখানে যেতে পারব।” সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে। কেউ আপনাকে ঘরে এনে কিছু দিয়ে যাবে না। নিজেকেই অর্জন করতে হবে। পরিশ্রমের ফল কোনো না কোনোভাবে পাবেনই।’
রুদ্র আরিফ
ছবি: মাসুদ আনন্দ