ফিচার I পাচক-পাচিকার রন্ধনভেদ
নারী-পুরুষের স্বভাব ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা। এর প্রভাব পড়তে পারে তাদের রান্নায়। তবে নারী ও পুরুষ রসুইকরের এসব ফারাক সর্বজনীন নয়
শুরুতে বলে নেওয়া ভালো, রান্নার স্বাদ বাড়া-কমায় কোনো লিঙ্গভেদ নেই। হ্যাঁ, নারী ও পুরুষের আচরণ রান্নাঘরে এক না-ও হতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে রসনায়। কিন্তু সেগুলো নিতান্তই গৌণ। সে জন্য লৈঙ্গিক পার্থক্য দায়ী নয়। তাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্যকে নারী-পুরুষের রান্নার মুখ্য পার্থক্য হিসেবে না দেখে হালকাভাবে নেওয়াই বরং ভালো। কেননা, রান্নাঘরে নারী-পুরুষের আচরণে সামান্য কিছু পার্থক্য দেখা গেলেও তা নিছক মজার। সাধারণত পুরুষেরা রান্নাঘরে বেশ বিচলিত বোধ করেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বেগ পেতে হয়। তা ছাড়া পুরুষেরা রান্নার ক্ষেত্রে খুব বেশি পারফেকশনিস্ট হয়ে থাকেন। ১০ মিলিলিটার বলতে তারা ১০ মিলিলিটারই বোঝেন। সেই পরিমাণ নির্ধারণে আশ্রয় নেন মাপনির। কেননা, রান্নার উপকরণের ক্ষেত্রে পুরুষের আন্দাজশক্তি কম। তা ছাড়া তারা খুব সিলেবাস মেনে রান্না করেন। অনেক সময় রেসিপিতে বলে দেওয়া দু-একটি উপকরণ কম পড়লে রান্নার স্বাদের কোনো হেরফের হয় না। কিন্তু পুরুষেরা সেই ঝুঁকি নিতে রাজি নন। তারা সব উপকরণ সঠিকভাবে হাতের কাছে চান; আর তা একেবারে পরিমাণমতো। ফলে রান্নাঘরে তাদের সময় ব্যয় হয় বেশি। তবে ওই একই ডিশ তৈরি করতে নারীদের খুবই কম সময় লাগতে পারে। এর মূল কারণ নারীদের চোখের মাপ এবং রান্নায় ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা। রান্নাঘরে নারীরা বেশ গোছালো। তেল, ঝোল, ধোঁয়া ও ঝাঁজের সঙ্গে তারা বেশ ঘনিষ্ঠ বলে রান্নাঘর তাদের কাছে বিব্রতকর মনে হয় না। তারা সেই পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে যান। রান্নার সময় থাকেন খুব শান্ত। মেজাজ ধরে রাখতে পারেন। ফলে পুরুষদের তুলনায় নারীর রান্না ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
রান্নাঘরে রন্ধনপ্রণালিগত ভুল পুরুষেরা মেনে নিতে চান না। ধরা যাক, কোনো রেসিপিতে আগে আলু দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তারপর বেগুন। যদি কোনোভাবে আগে বেগুন দেওয়া হয়, পুরুষেরা মনে করেন, রান্নায় বিরাট ভুল হয়ে গেছে। এমনকি এসব ক্ষেত্রে একজন পুরুষ তার রান্নার সহকারীকে বকাঝকা পর্যন্ত করেন। কোনো কোনো পুরুষ তো সে রান্না আবার নতুন করে শুরু করেন, কিন্তু নারীরা তা করেন না। তারা ভুলটা শোধরানোর উপায় খুঁজে নেন এবং রান্না চালিয়ে যান। রান্নায় ভুলভ্রান্তির ক্ষেত্রে নারীকে সাধারণত উত্তেজিত হতে দেখা যায় না।
পুরুষেরা রান্নার উপকরণে সঞ্চয়ী হয়ে থাকেন। বয়ামের শেষ মসলাটুকু যত কমই হোক না কেন, সঞ্চয় করে রাখেন। এমনকি সেটা রাখার যদি জায়গা না থাকে, তাহলে রাখেন অন্য কোথাও। কিন্তু নারীরা সাধারণত গেরস্থালি কাজে সঞ্চয়ী হলেও রান্নাঘরে খুব একটা হিসেবি নন। কারণ, তারা জঞ্জাল পছন্দ করেন না। প্যাকেটের তলানিতে সামান্য মসলা থাকলে ফেলে দিয়ে জঞ্জাল কমান। তারপর নতুন প্যাকেট কিনে আনেন।
মাংসের পদ রান্নার ক্ষেত্রে পুরুষেরা বেশি মাংস ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। মানে, আলু দিয়ে মাংস রান্না করতে দিলে পুরুষের ডিশে মাংসের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু নারীদের ডিশে মাংসের চেয়ে আলু বেশি থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া যেকোনো পদ তৈরিতে পুরুষেরা মসলা বেশি দেওয়ার পক্ষে। তারা মনে করেন, যত মসলা তত স্বাদ। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এর উল্টো। তারা স্বাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মসলা ব্যবহারের পক্ষপাতী নন সাধারণত।
বেকিংয়ে পুরুষের অনীহা বেশি। তারা এ কাজ এড়িয়ে চলতে চান। বেকিং রান্নার একটি অংশ হলেও পুরুষেরা মনে করেন, এটি নারীদের কাজ। এ কারণে প্রাচ্যের দেশগুলোতে কেকজাতীয় আইটেম তৈরিতে নারীদের যতটা সম্পৃক্ততা দেখা যায়, পুরুষদের ততটা নয়। বেকিংয়ের এই উদাসীনতার কারণেই আনাড়ি পুরুষের বেকড ফুডগুলোর রং ও স্বাদ খুব একটা জুতসই হয় না। কিন্তু নারীদের পদগুলো হয়ে থাকে বেশ দৃষ্টিনন্দন ও মুখরোচক।
রান্নাঘরে পুরুষেরা স্বতঃস্ফূর্ত না হলেও বারবিকিউর বেলায় তারা বেশ প্রফুল্ল। এদিকটায় নারীরা আবার অতটা প্রাণবন্ত নন। খেয়াল করলে দেখা যায়, বাড়ির বাইরে কিংবা ছাদের বারবিকিউগুলোতে পুরুষেরা নিজ গরজেই অংশ নেন। কয়লা কিংবা জ্বালানিতে আগুন দেওয়া থেকে শুরু করে মাংস ঝলসানো—সবকিছুতে অংশ নেওয়ার চেষ্টায় থাকেন পুরুষ। কিন্তু নারীরা এসব স্থানে কেমন যেন চুপসে যান। তারা সহভূমিকা পালন করলেও মূল রাঁধুনির দায়িত্ব নিতে চান না। শুধু বারবিকিউর বেলাতেই এমনটা ঘটে, তা নয়। পিকনিকে গেলেও আনাড়ি পুরুষটি রাঁধুনি হয়ে উঠতে চান। বিপরীত দিকে পাকা রাঁধুনি নারীও পিকনিকের রান্না থেকে দূরত্ব বজায় রাখার পক্ষে।
একজন পুরুষ রান্নার পেছনে যতটা না শ্রম দেন, তার চেয়ে বেশি শো-অফ করতে পছন্দ করেন। তিনি তার রান্নার স্বীকৃতি পেতে হয়ে ওঠেন মরিয়া। স্বাদ কেমন হলো, তা জানতে মুখিয়ে থাকেন। অবশ্য নারীরাও তা চান, তবে পুরুষের মতো এত প্রকটভাবে নয়।
নারীরা রান্নাঘরে সময়ের সমন্বয় করতে পারেন, কিন্তু পুরুষেরা তা পারেন না। যেমন, নারীরা ভাবেন—ডিম সেদ্ধ হতে আরও ৫ মিনিট লাগবে; এই অবসরে থালাবাসনগুলো ধুয়ে নেওয়া যাক। কিন্তু পুরুষেরা তা না করে ডিম সেদ্ধ হওয়ার জন্য চুলার পাশে ৫ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। অন্যদিকে নারীরা রান্নাঘরের আবর্জনা একটু একটু করে জমিয়ে রান্না শেষে একবারে পরিষ্কার করে ফেলেন। কিন্তু পুরুষেরা একটু ময়লা জমলেই তা ফেলে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, এতক্ষণ ফিরিস্তি দেওয়া এই পার্থক্যগুলো নারী-পুরুষনির্বিশেষে সর্বজনীন নয়। এসব পার্থক্য থাকতেও পারে, আবার না-ও থাকতে পারে। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে নারী ও পুরুষ রাঁধুনির স্বভাব ভিন্ন হতে পারে, আবার একও হতে পারে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট