ত্বকতত্ত্ব I অ্যান্টিপলিউশন প্রটোকল
পরিবেশদূষণের বিরূপ প্রভাব থেকে বাঁচতে বিশেষ প্রক্রিয়ার পরিচর্যা। ত্বকবান্ধব সব পণ্য যোগে। স্বাভাবিক সৌন্দর্য রক্ষায়। জানাচ্ছেন সারাহ্ দীনা
দূষণ। যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশ—কমবেশি সবারই জানা। ত্বকেও যে দূষণের প্রভাব পড়ে, সে কথা জানা আছে তো? এ ধরনের দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণের ফলে ত্বকে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আইকিউএয়ার বায়ুমান সূচকের মাধ্যমে এ বছর জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের ১৬ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ। এ ছাড়া দেশের আরও তিনটি শহর ও এলাকা রয়েছে ২০২০ সালের শীর্ষ ১০০ দূষিত শহরের মধ্যে। এগুলো হলো ঢাকা, ঢাকার আজিমপুর ও গাজীপুরের শ্রীপুর। অবস্থান যথাক্রমে ২৩, ৬০ ও ৬১ নম্বরে।
বায়ুদূষণের নেতিবাচক প্রভাব ত্বকে দৃষ্টিগোচর হয় ধীরে ধীরে। স্কিন ইনফ্লামেশনের কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকে দায়ী করেন ত্বক বিশেষজ্ঞরা। ত্বকে ইরিটেশন, বার্নিং অনুভূতি তৈরি করে এটি। এর সঙ্গে আরও একটি দুশ্চিন্তার বিষয় রয়েছে। বায়ুদূষণের ফলে ত্বকে বয়সের ছাপ দ্রুত তৈরি হয়।
বায়ুদূষণে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বটে, কিন্তু কীভাবে হয় তা জানা জরুরি। ত্বকের যত্ন নিয়ে কাজ করা নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন স্কয়ার লেজার ডারমাটোলজির ডারমাটোলজিস্ট অ্যানি চাপাস তাদের দেশের বায়ুদূষণ থেকে জানতে পারেন, দূষিত বায়ুতে থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণাসদৃশ বস্তু, সেগুলোতে পাওয়া গেছে কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন—যা ওজন ও বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখে। আমাদের দেশের দূষিত বায়ুতেও থাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, যা বায়ুকে দূষিত করে। অ্যানি আরও জানিয়েছেন, এ ধরনের দূষণের প্রভাবে ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। ত্বকের মাইক্রোফ্লোরাতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ত্বকে বলিরেখা বাড়ায়। একই সঙ্গে ত্বকের প্রাকৃতিক রং, অর্থাৎ পিগমেন্টেশনও প্রভাবিত হয়। এর কারণ, এই ক্ষুদ্র কণাগুলো ত্বকে আঘাত করে, ত্বকে প্রবেশের চেষ্টা চালায় এবং লোমকূপ বন্ধ করে দেয়। এতে ত্বকের ওপরের অংশ শুধু নোংরা হয়, বিষয়টি কিন্তু মোটেও এত সহজ নয়। লোমকূপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ত্বকে অক্সিজেনেশনের মাত্রা কমে যায়। অক্সিজেনের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়। ত্বক সজীবতা হারিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। বায়ুদূষণে প্রায় প্রতিদিনই ত্বকের ক্ষতি হয়। তাই এর প্রভাব মারাত্মক। এতে ত্বক দুর্বল হয়ে পড়ে। দূষণসহ সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা হারায়। আক্রান্ত হয় সহজেই।
‘হাফপোস্ট’-এর মাধ্যমে ক্যালিফোর্নিয়ার ডারমাটোলজিস্ট দেবিকা আইসক্রিমওয়ালার বক্তব্য অনুসারে, বায়ুদূষণের কারণে ত্বক মলিন ও অমসৃণ হয়ে যায়। তার মতে, দূষিত বায়ুর নিয়মিত সংস্পর্শে ত্বকের কোলাজেন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি ত্বকের কোষগুলোকে সংযুক্ত রাখতে সাহায্য করে। তাই কোলাজেন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ত্বক নিজস্ব সৌন্দর্য এবং স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকে।
অ্যান্টিপলিউশন স্কিন কেয়ারের মূল উদ্দেশ্য ত্বক ও বায়ূদূষণের মাঝে বাধা তৈরি করা। কারণ, ত্বক আমাদের দেহের এমন একটি অঙ্গ, যা বাতাসের সংস্পর্শে আসে নিত্যদিন। চাইলেই বাতাস এড়িয়ে চলার উপায় নেই। অ্যান্টিপলিউশন স্কিন কেয়ারের উদ্দেশ্য ত্বককে দূষিত বাতাসের কারণে তৈরি ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা।
ত্বকে বায়ুদূষণের প্রভাব
মলিনতা
ব্ল্যাকহেডস
পিম্পল
হাইপার পিগমেন্টেশন
ত্বকে বয়সের অকালছাপ
শুষ্কতা।
তাই অপেক্ষা না করে আগে থেকেই ত্বকে দূষণের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠা জরুরি।
ডারমাটোলজিস্ট দেবিকা ও অ্যানির মতে, বায়ুদূষণ থেকে ত্বককে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য শক্তিশালী ভূমিকা রাখে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এর মধ্যে ভিটামিন সি বিশেষ। এই দুই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ত্বক পরিচর্যায় সচেতন সব ব্যক্তির উচিত প্রতিদিনের স্কিন কেয়ার রুটিনের তালিকায় ভিটামিন সি রাখা। কীভাবে কাজ করে এই ভিটামিন? অ্যানির মতে, ভিটামিন সি ত্বককে ফ্রি র্যাডিকেলের প্রভাব থেকে রক্ষা করে। ফ্রি র্যাডিকেল একধরনের অস্থিতিশীল পরমাণু। সেগুলো সংস্পর্শে এসে ত্বকের কোষগুলো নষ্ট করে এবং ত্বককে করে তোলে নিষ্প্রভ ও মলিন। ত্বক তারুণ্য হারায়। ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করতে চাইলে এ বিষয়েও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। ত্বকের ধরন বুঝে চাহিদা অনুযায়ী ময়শ্চারাইজার বেছে নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে হতে হবে নিয়মিত। বাতাসে ভেসে বেড়ানো কণাগুলোর সঙ্গে ত্বকের দূরত্ব তৈরি করতে হবে। ময়শ্চারাইজারের পরত এ ক্ষেত্রে দারুণ কার্যকর। ত্বকের যত্নের কথা ভাবতে গিয়ে প্রসাধনের অধিক ব্যবহারকে উৎসাহিত করা যাবে না একদমই। এ ক্ষেত্রে অ্যাসিড জাতীয় এবং রেটিনলের মতো উপাদান ব্যবহারে সাবধান হতে হবে সবার আগে। যত কম সম্ভব ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো। কারণ, এগুলো ত্বককে আরও বেশি সংবেদনশীল করে তোলে। ফলে দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়ে।
ব্যবহার করা যেতে পারে এক্সফোলিয়েটিং এজেন্ট। স্যালিসাইলিক ও ল্যাকটিক অ্যাসিডের ব্যবহার ত্বকের জন্য ইতিবাচক। সানস্ক্রিনের কথা ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখা চাই, দূষিত বাতাস যেমন ত্বকে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করে, তেমনি সূর্যের প্রখর তাপে ত্বকের ক্ষতি আরও ত্বরান্বিত হয়। ডারমাটোলজিস্টের মত এ ক্ষেত্রে মিনারেল সমৃদ্ধ সানস্ক্রিন ব্যবহারের।
বায়ুদূষণ থেকে নিজের ত্বককে সুরক্ষা দিতে শুধু যে পরিচর্যার উপাদান ব্যবহার করলেই হবে, তা কিন্তু নয়। নজর দিতে হবে ডায়েটের দিকেও। ভিটামিন সি-সহ অন্যান্য অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রাখতে হবে রেগুলার ডায়েটের তালিকায়। নিয়মিত এই খাদ্য উপাদানগুলো পেলে ত্বক বায়ুদূষণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার শক্তি পাবে।
সচেতন হওয়ার সময়
কখন সচেতন হতে হবে ত্বকে বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে? আমাদের দেশের বায়ু দূষিত—এ কথা ইতিমধ্যে জানা গেছে গবেষণার মাধ্যমে। বড় শহরগুলোতে এই দূষণের মাত্রা বেশি। যানবাহনের আধিক্য, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং শিল্প এলাকা বসবাসের জায়গা থেকে খুব বেশি দূরে না হওয়ার কারণে বড় শহরের নাগরিকদের ত্বকের ক্ষতির শঙ্কা তুলনামূলক বেশি। এর সঙ্গে আছে উন্নয়নকাজের প্রভাব। সড়ক উন্নয়ন, সেতু ও ফ্লাইওভার মেরামত ও নির্মাণের প্রভাব বাতাসকে দূষিত করে। অঞ্চলভেদে তাই দূষণের পরিমাণ ভিন্ন। নিজ বসবাসের অবস্থানের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। বায়ু দূষিত কি না, জানা চাই। যদি হয়ে থাকে, তাহলে সাবধানতার ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে ওঠা দরকার। বায়ুদূষণ থেকে নিরাপদ থাকতে ত্বকের পরিচর্যা করতে হবে নিয়মিত।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ত্বক ও দেহকে বায়ুদূষণের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত করে তোলে বলে জানা যায়। তাই বিষয়টি রুটিন করে মেনে চলা যেতে পারে। এ ছাড়া—
দিনে দুবার মেকআপ তুলতে হবে যত্নের সঙ্গে। এতে ত্বকে দূষিত কণা বসে থাকতে পারবে না।
সপ্তাহে দুই দিন ত্বক এক্সফোলিয়েট করা দরকার। জমে থাকা ময়লা উঠে আসবে।
সকাল ও রাতে ত্বকে ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। ত্বক পরিষ্কার করে নিয়ে প্রথমে সেরাম ব্যবহার করা জরুরি। এর শক্তিশালী উপাদান ত্বককে শক্তি জোগাবে। ফিরিয়ে দেবে আর্দ্রতা। ময়শ্চারাইজ বেছে নেওয়া চাই ত্বকের ধরন ও চাহিদা বুঝে। ক্রিম, লোশন, ফ্লুইড, জেল—এ ক্ষেত্রে পছন্দসইটি ব্যবহার করা যেতে পারে
ত্বকে সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার ডায়েটে রাখা চাই।
এরপরেও যদি সমস্যা না কমে। তাহলে অবশ্যই ডারমাটোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।
মডেল: বৃষ্টি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দীন