ফিচার I রোজার রেওয়াজ
পবিত্র মাস ঘিরে রয়েছে নানান রীতি। কোথাও কামান দাগানো, কোথাও ফানুস ওড়ানো…
যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে রমজান মাসজুড়ে রোজা রাখেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। এই বিশেষ মাস ঘিরে বিভিন্ন দেশে রয়েছে বিভিন্ন রীতি। সেগুলোর কোনোটি সর্বজনীন, কোনোটি আবার স্থানীয়। এ রকমই কয়েকটির খোঁজ নিয়ে এই আয়োজন।
সংযুক্ত আরব আমিরাত
রমজান মাসের আগের মাস, শাবানের ১৫তম রাতে ‘শবে বরাত’ উদযাপন করে মুসলিম বিশ্ব। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এটি ‘হক আল লাইলা’ নামে উদযাপন করা হয়। এ উদযাপনের মূল উদ্দেশ্য, আসন্ন রমজান মাস সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। বহুকাল ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে হক আল লাইলা যথাযোগ্য মর্যাদায় রমজান উদযাপনের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ঐতিহ্যগুলোর একটি হয়ে রয়েছে। এ রাতে শিশুরা আনন্দ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। আর দল বেঁধে সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করে গান গেয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিষ্টান্নের বিনিময় ঘটায়।
কুয়েত
সংযুক্ত আরব আমিরাতের হক আল লাইলার সঙ্গে কুয়েতের রমজান রেওয়াজ ‘কারকিয়ান’আন’-এর বেশ মিল রয়েছে। পার্থক্য হলো, শাবান মাসে নয়, বরং রমজান মাসেই এটি উদযাপন করা হয়। চলে তিন দিন। এ সময় শিশুরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ধর্মীয় গান গায়। ছেলে ও মেয়েদের গান আলাদা। প্রচলিত গানের পাশাপাশি শিশুরা কখনো কখনো নিজেদের মতো গান বানিয়ে গায়। রমজান মাসে রোজা রাখার শিক্ষা কারকিয়ান’আন-এর মাধ্যমে লাভ করে শিশুরা। যারা রোজা রেখেছে, তাদের মিষ্টান্ন দিয়ে পুরস্কৃত করা হয় এ সময়ে।
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ান মুসলমানদের কাছে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার একটি উপলক্ষ—‘পাদুসান’। দেশটিতে রমজান ঘিরে থাকা বিভিন্ন ঐতিহ্যের মধ্যে এটি অন্যতম। রোজা রাখা ও নামাজ পড়ার মাধ্যমে নিজের আত্মা ও শরীরকে পরিশুদ্ধ করে তোলার প্রস্তুতি নেওয়া হয় এর মাধ্যমে। রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই ইন্দোনেশিয়ান মুসলমানরা প্রাকৃতিক জলাশয়ে গোসল ও নিজেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রোজা রাখার জন্য প্রস্তুত হন। এটাই পাদুসান। এশিয়ান এই দেশে রমজানের আরও একটি অনন্য রেওয়াজ রয়েছে। নাম ‘নিয়েকার’। রমজান মাস শুরুর আগেই এটি শুরু হয়। প্রার্থনার মাধ্যমে পরিবারের মৃত সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এর উদ্দেশ্য।
মিসর
রমজান ঘিরে দুনিয়াজুড়ে চলা বিভিন্ন রেওয়াজের মধ্যে ‘ফানুস’ই সম্ভবত সবচেয়ে রঙিন ও বর্ণিল। ফানুস বলতে আমরা যা বুঝি, এটি কিন্তু তা নয়; বরং মিসরে এই উৎসব ঘিরে রংবেরঙের ফানুস বা বাতি জ্বালানো হয়। এ ছাড়া সেহরির সময় রাস্তায় ঘুরে ডেকে ডেকে মানুষকে ঘুম থেকে তোলার রেওয়াজ বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে রয়েছে। মিসরে এ কাজ যারা করেন, তাদের ‘মেসাহারাতি’ বলা হয়। মেসাহারাতির কাজ হলো হালকা চালে ড্রাম বাজিয়ে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলা।
মরক্কো
মিসরের মেসাহারাতির মতোই একইভাবে ড্রাম বাজিয়ে সেহরির জন্য মানুষকে জাগিয়ে তোলা হয় তুরস্কে। এ কাজ যারা করেন তাদের বলা হয় ‘নাফারস’। তবে তাদের রয়েছে বিশেষ সাজ। তারা ‘গানদোরা’ নামের একটি ঐতিহ্যবাহী টুপি পরেন মাথায়, পায়ে পরেন সাদামাটা চপ্পল; আর ড্রাম বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে কোমল গলায় ধর্মীয় গান গেয়ে এলাকাবাসীকে জাগিয়ে তোলেন। তাদের সেই মিষ্টি গানের অনুরণন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। নাফারস হিসেবে সাধারণত সবচেয়ে দরদি ও সৎ মানুষদের বেছে নেওয়া হয়।
ইরাক
রমজান মাসে হালকা আনন্দ করাকে খারাপ চোখে দেখেন না ইরাকি মুসলমানরা; বরং তাদের কাছে এটি একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এই হালকা আনন্দ উদযাপনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলন রয়েছে ‘মেইবেস’ খেলার। ইফতারির পর নামাজ শেষে ইরাকের পুরুষেরা নিজেদের বাড়ির আঙিনায় বা আশপাশে ঐতিহ্যবাহী এ খেলায় মেতে ওঠেন। প্রতিটি দলে থাকেন ৪০ থেকে ২৫০ জন খেলোয়াড়। এক গ্রুপের লিডার নিজের দলের কোনো এক সদস্যের কাছে বিচক্ষণতার সঙ্গে একটি আংটি পাস করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আংটি গোপনের এ খেলা। টিমের সব সদস্য এ সময় নিজ নিজ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখেন। কার হাতে আংটিটি আছে, সেটা অন্য টিমকে আন্দাজ করতে হয়। এই খেলা ইরাকে বহু প্রজন্ম ধরেই চলে আসছে।
লেবানন
দুনিয়াজুড়ে চলে আসা রমজানের সবচেয়ে পুরোনো রেওয়াজগুলোর একটি হলো ইফতারের সময় কামান দাগানো। লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে ‘মিদফা আল ইফতার’ নামের এই চর্চা শুরু হয় প্রায় ২০০ বছর আগে। মিসর থেকেই এই রেওয়াজের শুরু বলে ধারণা করা হয়। বলা হয়ে থাকে, অটোমান শাসনামলে রমজান মাসের কোনো একদিন তৎকালীন শাসক খোশ কাদাম সূর্যাস্তের কালে ভুল করে একবার কামান দাগিয়ে ফেলেছিলেন। কায়রো শহরজুড়ে অনুরণিত হয়েছিল সেই ধ্বনি। আর সেটিকে ভুল করে কায়রোবাসী ধরে নিয়েছিল ইফতারের সময় হওয়ার সংকেত হিসেবে। জনগণ এর ভূয়সী প্রশংসাও করেছিল। এভাবেই এটি জায়গা করে নেয় রীতিতে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই এই মিদফা আল ইফতারকে রোজা ভাঙার আনুষ্ঠানিক সংকেত হিসেবে ব্যবহারের জন্য গ্রহণ করে। উনিশ শতক থেকে এখনো লেবানন বিশেষ মর্যাদায় এর চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান
ঈদের আগের রাতে মেহেদি দিয়ে হাত রাঙানোর রেওয়াজ ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে। স্থানীয়ভাবে একে ‘চাঁদরাত’ বলা হয়। এ সময়ে পরিবার-প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধব মিলে নানান নকশার মেহেদি পরার ধুম পড়ে যায়।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট