skip to Main Content

এডিটরস কলাম I সংযমের মাহাত্ম্য

রোজার রয়েছে বহু ধরনের সংযমের তাৎপর্য। এ সংযম শুধু পানাহার কিংবা কেনাকাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাপ্তি বিশাল

বছর ঘুরে আবার এলো মাহে রমজান। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বহু আকাঙ্ক্ষিত মাস। সিয়াম সাধনার মাস। কল্যাণময় মাস। জীবনকে সব ধরনের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেওয়ার মাস। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস। এ মাসেই নাজিল হয়েছিল পবিত্র কোরআন। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের ‘সুরা বাকারা’য় আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পারো।’
প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক মুসলমানের জন্য এ মাসে রোজা রাখা ফরজ। রহমত ও বরকতের বিবেচনায় এ মাস বাদবাকি মাসগুলোর তুলনায় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের সামনে এ মাস হাজির হয় কল্যাণের বার্তা নিয়ে। রোজা আত্মিক শুদ্ধতা দানের পাশাপাশি সব ধরনের সামাজিক বৈষম্য দূর করে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করে আমাদের। সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেকোনো ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে গরিব, দুঃখী, অনাহারীদের কষ্ট উপলব্ধির শিক্ষা দেয় রোজা। তাই তাদের পাশে থাকার, কাঁধে কাঁধ রেখে জীবন কাটানোর মহাগুরুত্বপূর্ণ পাঠ পাই আমরা।

দুই
সিয়াম অর্থ আত্মসংযম। রোজার রয়েছে বহু ধরনের সংযমের তাৎপর্য। এ সংযম শুধু পানাহার কিংবা কেনাকাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাপ্তি বিশাল। মানুষকে প্রকৃত মানুষ হওয়ার পাঠ দেয় এটি। দেহ ও মনকে সংযমের অনুশাসনে রেখে ধর্মীয় জীবনবিধানের পরিপন্থী সব ধরনের অমানবিক ও অসামাজিক কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখার শিক্ষা দেয় রোজা। মিথ্যা কথা বলা, বাজে কথা বলা, কুদৃষ্টি দেওয়া, অন্যের বদনাম করার মতো যাবতীয় পাপাচার থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সিয়াম সাধনা করা একজন মানুষকে তার মানবিক ইচ্ছাশক্তির বিকাশ, সংযম ও আত্ম-উন্নয়নের পথে নিয়ে যায়। তাকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করে। তাই রমজানের প্রকৃত তাৎপর্য মনে ধারণ করে, জীবনযাপনে তার চর্চা অব্যাহত রেখে, আল্লাহর প্রিয় বান্দায় নিজেকে পরিণত করার এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয় আমাদের কারও।

তিন
দুর্ভাগ্যক্রমে ‘লোকদেখানো’ রোজা রাখার অভ্যাস দেখা যায় সমাজের অনেকের মধ্যে। এর কুফল আমরা দেখতে পাই খোলা চোখেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানান ধরনের অনাচার, অবিচারের দেখা মেলে, যা কারও কাঙ্ক্ষিত নয়। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজেকে মনেপ্রাণে নিবেদন না করে, সামাজিক চাপে রোজা পালনের ‘অভিনয়’ করে বেড়ান, তারা হয়তো ভুলে যান—আল্লাহ সবই দেখেন এবং বোঝেন। সংযমের প্রকৃত তাৎপর্য ধারণ করলে এবং তা মেনে চললে মানবজীবনে নেমে আসে রহমত। এ প্রসঙ্গে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘রমজান মাসের প্রথমাংশে রহমত, দ্বিতীয়াংশে মাগফিরাত অর্থাৎ ক্ষমা, আর তৃতীয়াংশে নাজাত তথা দোজখ থেকে মুক্তি।’ (বুখারি)
আবার, অনেকেই অজ্ঞতার কারণে জানেন না রোজা পালনের প্রকৃত বিধান। চলুন, জেনে নিই কোন কোন কারণে ভঙ্গ হয় রোজা: জেনে-শুনে পানাহার করলে; কেউ জোর করে কিছু খাইয়ে দিলে; নাকে বা কানের ভেতরে ওষুধ দিলে; অসুখের কারণে কোনো বস্তু বা খাদ্য পেটের ভেতরে দিলে; মস্তিষ্কে কোনো ওষুধের তেজ প্রবেশ করলে; যেসব বস্তু খাদ্য নয়—যেমন লোহা, কাঠ, মাটি ইত্যাদি কোনো কারণে গিলে ফেললে; ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করলে; সেহরি খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর রাত আছে ভেবে ভুলক্রমে সকালে সেহরি খেলে; সূর্যাস্ত হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের আগেই ইফতার করলে; ভুলে কিছু খেয়ে ফেলার পর রোজা ভেঙে গেছে ভেবে ইচ্ছেকৃতভাবে কিছু খেলে; রোজা রাখা অবস্থায় কুলি করতে গিয়ে গলার ভেতরে পানি ঢুকে গেলে; নিয়ত ছাড়া রোজা রাখার পর ইচ্ছা করে রোজা ভাঙলে; ইচ্ছাকৃতভাবে ধূমপান করলে এবং ধূপ ও আগরবাতি বা এ-জাতীয় কিছু জ্বালিয়ে পরিকল্পিতভাবে তার ধোঁয়া গ্রহণ করলে।
অন্যদিকে রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—অকারণে কোনো কিছু মুখের মধ্যে রেখে চিবানো; লবণ বা অন্য কোনো বস্তুর স্বাদ নিয়ে থুতু করে তা আবার ফেলে দেওয়া; কয়লা, পেস্ট বা মাজন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা; ফরজ গোসলের প্রয়োজন সত্ত্বেও দিনমান গোসল না করা; শিঙা লাগানো; রক্তদান করা; গিবত বা পরনিন্দায় লিপ্ত হওয়া; মারামারি, ঝগড়া ও গালিগালাজ করা।

চার
রমজানের প্রকৃত বার্তা মেনে চলে, সব ধরনের অন্যায়, অনাচার, দুরাচার, পাপাচার, অকল্যাণকর কাজ থেকে নিজেকে দূরে রেখে, আল্লাহর পথে আত্মনিবেদনের বড় সুযোগ রমজান মাস। তাই যারা শুধুই নিজেকে নিয়ে মগ্ন, যারা প্রতিবেশীর দুঃখ-কষ্টে এগিয়ে আসেন না, যারা অন্যায়-অনাচার দেখেও না দেখার ভান করেন, তাদের জন্য নিজেদের শুধরে নেওয়ার, মানবিক মানুষ হওয়ার চর্চা চালানোর এক দারুণ সময় এটি।
মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক নিয়ম মেনে রোজা পালনের তৌফিক দান করুন। সবার কল্যাণ হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top