কভারস্টোরি I খাদ্যের উপনিবেশ
খাদ্য নিয়ে দাঙ্গার সূচনা কৃষি আবিষ্কারের লগ্ন থেকেই। কৈবর্ত বিদ্রোহকেও মাছকেন্দ্রিক যুদ্ধ বলেছেন কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তা। মসলার টানে ভারতবর্ষে আগ্রাসন চালানো পর্তুগিজরাও বদলে দিয়েছিল এই অঞ্চলের রসুইঘরের চিত্র। মগ জলদস্যুদের হাতে এই ভূখণ্ডের বন্দিচাষিদের দুর্দশা খাদ্যের উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রাসী ভূমিকা রেখেছে। সেসবের ফিরিস্তি সংক্ষেপে লিখেছেন শিবলী আহমেদ
সংকুচিত পৃথিবীতে বর্তমানে সবাই যেন এক জাতি। ক্রমশ ঘুচে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক ফারাক। খাদ্যসংস্কৃতিতেও ‘আমরা’ ও ‘তোমরা’র পার্থক্য প্রায় নেই বললেই চলে। খাবার যেখানেই উৎপন্ন হোক, রেসিপি যাদের আবিষ্কৃতই হোক, তাতে যেন সবার রয়েছে সমান অধিকার। ইন্টারনেট ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের বদৌলতে এসব সাংস্কৃতিক লেনদেন খুব দ্রুতই হচ্ছে। তবে এক জাতির খাদ্যাভ্যাস যখন আরেক জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেটাকে আর সংস্কৃতির লেনদেন বলা চলে না। তা আগ্রাসন, তা-ই উপনিবেশ। সাধারণত একটি জাতি যখন অন্য জাতির ওপর শারীরিক কিংবা কৌশলগত আক্রমণ চালিয়ে সেই জাতির আইন ও রাষ্ট্রসেনা নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সেই অঞ্চলকে দখলদার জাতির উপনিবেশ বলা চলে। শক্তিধর বিদেশিরা অবশ্য শুধু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নতুন ভূখণ্ডে আসেন না; বরং তাদের স্বভাব, অভ্যাস ও সংস্কৃতিও বয়ে আনেন। চাপ, কৌশল ও বৈবাহিক সম্পর্ক—এই তিন পন্থায় আগন্তুকদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে যায় দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের মানুষের ওপর। প্রথমত, বিজয়ীদের বয়ে আনা শস্য ও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে অভিযোজিত হতে বাধ্য হয় পরাজিত জাতি। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কৌশলে একটি জাতি তাদের নিজস্ব শস্য উৎপাদন বাদ দিয়ে অন্য জাতির বাজারের চাহিদা পূরণ করতে সেই জাতির নির্ধারিত শস্য চাষে পরোক্ষভাবে বাধ্য হয়। তৃতীয়ত, জয়ীরা অনেক সময় পরাজিত লোকদের বন্দি করে তাদের সুবিধাজনক অঞ্চলে নিয়ে নিজেদের পছন্দের শস্য চাষ করতে বাধ্য করেন। এই তিনভাবেই গড়ে উঠতে পারে খাদ্যের উপনিবেশ। আবার আপাতদৃষ্টে দেখা যায়, কিছু জাতি স্বেচ্ছায় অন্য জাতির রীতিনীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেটার পেছনেও চাপ থাকতে পারে। হয়তো শক্তিশালী বিজয়ীদের সান্নিধ্য পেতে এবং তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই পরাজিতরা মাথা পেতে নেন ভিন্ন সংস্কৃতিকে।
খাদ্যের উপনিবেশকে সরাসরি দাঙ্গাপ্রধান বলা চলে না। তবে হ্যাঁ, খাদ্যবস্তুর এই লেনাদেনার পেছনে ঔপনিবেশিক শাসকশক্তির কৌশল বেশ ভূমিকা পালন করেছে। কিছু স্থানে কয়েকটি খাবারকে অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোকমুখে শোনা যায়, এই অঞ্চলে চা তেমনই একটি চাপানো শস্য। এর চাষ নিয়ে একটি প্রশ্ন জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। তা হলো শস্যটি যেখানে ফলানো হয়, সেই স্থানকে ‘খেত’ না বলে ‘বাগান’ বলা হয় কেন? এর উত্তরে যে বিষয় লোকমুখে ঘুরে ফেরে, তা হলো—অন্যান্য ফসলি জমি গ্রাস করে সেখানে চা চাষে বাধ্য করা হয়েছিল বাংলার চাষিদের। কিন্তু কৃষকদের ওপর এই চাপকে যেন আগ্রাসন হিসেবে দেখা না হয়, তাই চা-খেতকে ‘চা-বাগান’ বলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল সেটিকে শৌখিন লোকেরা বাগান ভেবে সেখানে অবসর কাটাতে যাবেন। লোকে ভাববেন, বেশ উন্নতি করা হলো; আগে যেখানে খেত ছিল, এখন তা উন্নত হয়ে বাগানে পরিণত হয়েছে! ফলে আগ্রাসনটা ‘উন্নয়ন’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। যদিও এসব কথার কেতাবি প্রমাণ খুবই দুষ্প্রাপ্য। লোকমুখেই বেশি রটেছে এ কথা। যা কিছু রটে, কিছু না কিছু তো বটে! যাহোক, খাবার ও খাদ্যাভ্যাসের উপনিবেশ স্থাপনের কর্মকাণ্ড ঘটেছে একেবারে আদিম যুগ থেকেই। প্রাচীনে সেটি যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে এগিয়েছে। এখন চলছে কৌশলে, বিনা রক্তপাতে।
আদিম মানুষ ছিলেন ‘শিকার-সংগ্রাহক’। মানে তারা শিকার থেকে প্রাণিজ খাবার এবং সংগ্রহের মাধ্যমের ফলফলারি লাভ করে জীবনধারণ করতেন। আদিম পৃথিবীতে মানুষের নিকটবর্তী প্রতিবেশী ছিল গাছ। বিশ্ব ছিল অরণ্যে ঘেরা। ফলে আমিষ-নিরামিষ উভয় পদই ছিল হাতের নাগালে। পৃথিবীব্যাপী মানুষের বিস্তার তথা উপনিবেশ পশুমাংস কিংবা ফল সংগ্রহ করতে করতেই হয়েছে—এমনটা না-ও হতে পারে। তবে এটা ঠিক, এক স্থানের প্রাকৃতিক খাদ্যভান্ডারে টান পড়লে যাযাবর মানুষ তল্পিতল্পা গুটিয়ে সেই জায়গা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতেন। মানুষের ব্যাপক স্থানান্তর ঘটেছে সম্ভবত মাছকে কেন্দ্র করে। লুইস হেনরি মর্গান তার ‘অ্যানসিয়েন্ট সোসাইটি’ বইয়ে মানুষের প্রথম কৃত্রিম প্রক্রিয়াজাত খাদ্য হিসেবে মাছের কথাই বলেছেন। আদিম মানুষ তা খেতেন ঝলসে। বইতে আদিম সমাজকে নিম্ন, মধ্যম ও উচ্চ—এই তিন পর্যায়ে ভাগ করেছেন মর্গান। মাছের সঙ্গে সভ্যতার অগ্রগতি বিষয়ে তিনি যা লিখেছেন, সেটির মূলভাব অনেকটা এ রকম: বর্তমান সভ্যতায় আসতে মানুষকে সভ্যতার আরও বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়েছে। আহার্য হিসেবে মাছকে গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ ‘নিম্ন পর্যায়ের আদিম’ দশা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ‘মধ্যম পর্যায়ের আদিম’ স্তরে উন্নীত হয়। তীর-ধনুক আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল ধাপটি। ধারণা করা হয়, আগুন আবিষ্কারের পরপরই ভোজ্য হিসেবে মাছ খাওয়া শুরু মানুষের। আরও ভাবা হয়, মাছের খোঁজে নদী ও সাগরের তীর ধরে এগোতে এগোতে মানুষেরা ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো পৃথিবীতে। ফলে পৃথিবীর প্রথম উপনিবেশ হতে পারে মাছখেকোদের উপনিবেশ। হয়তো আফ্রিকা থেকে মাছ খাওয়ার অভ্যাস নিয়েই আদিম মানুষেরা বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে গেছেন। তবে এই উপনিবেশ ছিল নিষ্পাপ।
খাদ্যের জন্য দাঙ্গা বাধে মূলত কৃষি আবিষ্কারের পর। ইউভাল নোয়াহ হারারির লেখা ‘সেপিয়েন্স’ বইটির বক্তব্য অনুসারে, কৃষি আবিষ্কারের পর মানুষ একটি স্থানে থিতু হয়ে বসতে বাধ্য হয়। কেননা, ফসলি জমি পাহারা ও ফসল সংরক্ষণের জন্য মানুষকে যাযাবর জীবন বাদ দিতেই হতো। এর কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু যাদের চাষাবাদের ধৈর্য ছিল না, যারা ছিলেন বলবান, কিংবা যাযাবর জীবনেই যাদের সুখ, তাদের কেউ কেউ চালাতেন লুণ্ঠন। চাষির গোলা লুট করে শস্য নিয়ে যেতেন নিজেদের গোষ্ঠীতে। এভাবে এক অঞ্চলের খাবার আরেক অঞ্চলে পৌঁছাত। লুণ্ঠিত শস্য দিয়ে গড়ে উঠত উদ্বৃত্তভোগীদের কলোনি। আবার লুইস হেনরি মর্গানের মতে, বর্বর সমাজের মধ্যম পর্যায়ে পূর্ব গোলার্ধে পশুকে গৃহপালিত করা শুরু হয়। তার এই কথা থেকে ধারণা করা যেতে পারে, গৃহপালিত পশুমাংস ভক্ষণ মূলত পূর্ব গোলার্ধের মানুষের সংস্কৃতি। পশ্চিম গোলার্ধের মানুষের খাদ্যসংস্কৃতিতে তখনো হয়তো পশুমাংস নিয়মিত হয়নি। কেননা ঠিক ওই সময়েই পশ্চিম গোলার্ধে চালু হয় কৃষিকাজ। এসব মেনে নিলে বলতে হয়, যেকোনোভাবেই হোক, পশ্চিম গোলার্ধের লোকেরা তাদের খাদ্যসংস্কৃতি নিয়ে পূর্ব গোলার্ধে উপনিবেশ গড়েছেন। আবার পূর্বের লোকেরাও হয়তো তাদের পশুমাংস খাওয়ার অভ্যাস নিয়ে পশ্চিম গোলার্ধে গড়েছেন উপনিবেশ। কিন্তু এটা না-ও হতে পারে। কারণ, মানুষ যে আদিম থেকেই মাংসাশী, তা ছেদনদন্ত দেখেই বোঝা যায়।
উল্লিখিত বিষয়গুলো সবই অনুমান ও ধারণানির্ভর। তবে খাদ্য নিয়ে কোন্দল এবং খাদ্যবস্তুর জন্যই উপনিবেশ—পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে মোটাদাগে এমন ঘটনা ঘটছে সম্ভবত দুবার। একবার পাল যুগে। জেলে কৈবর্তদের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন পাল রাজারা। এতে তাদের রুটি-রিজিক ও পেশায় আঘাত লাগে। এ কারণেই কৈবর্ত বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে এই মত সর্বজনস্বীকৃত নয়। কেবল ড. বি. সেন এই বিদ্রোহের সামাজিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মাছের প্রসঙ্গ টেনেছেন। তার মতে, বৌদ্ধধর্মে মৎস্য হত্যা নিষিদ্ধ ছিল। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। ফলে সেকালে কৈবর্তদের সামাজিক অসুবিধা হচ্ছিল। দ্বিতীয় মহীপাল কঠোরভাবে মাছ না মারার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চেয়েছিলেন। ফলে কৈবর্তরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। আরেকটি দাঙ্গা হলো ভারতবর্ষে ইউরোপীয়দের সাম্রাজ্য বিস্তার। এর মূল কারণ ছিল ভারতীয় মসলা ও গোলমরিচের ওপর ইউরোপীয়দের লোভ। এই মসলা ও গোলমরিচের কারণে যেসব সংঘাত হয়, তাতে করে প্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের নানান শস্য ও খাদ্যসংস্কৃতির আদান-প্রদান ঘটে, যার প্রভাব এখনো রয়েছে। আবার এই ভূখণ্ডের মাটি এতটাই উর্বর, এখানে বীজ ফেললে আপনা থেকেই গাছ জন্মে, যা মরু অঞ্চলের মানুষদের জন্য ছিল খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার। মধু যেমন পতঙ্গকে আক্রমণ করে, এই অঞ্চলের মাটি তেমনভাবেই বিদেশি শক্তিকে প্রলুব্ধ করত। বলা হয়, একসময় বিশ্বের মোট খাবারের সিংহভাগই উৎপন্ন হতো এই ভারতবর্ষে। খুব প্রাচীনকালের কথা নয়, চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সোনারগাঁ যখন পূর্ববঙ্গের রাজধানী হয়, তখন সেখানে উৎপন্ন চাল তৎকালীন সিংহল, পেগু, চীন, জাভা, মলক্কস, সুমাত্রাসহ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হতো। যতীন্দ্রমোহন রায় রচিত ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইয়ে এসব তথ্য বিস্তারিত মেলে।
আমাদের অঞ্চলে নানান সময়ে নানান দেশের শাসকের উপস্থিতি ঘটেছে। তাদের সঙ্গে এসেছে ভিনদেশি শস্য, ফলমূল ইত্যাদি। বাজারে টিকে থাকতে হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে, ভিনদেশি শস্যগুলো এই অঞ্চলের মানুষকে চাষ করতেই হয়েছে। একটু প্রাচীন থেকে দেখা যাক। সেকালে বাংলার শস্য ছিল ধান, গম, যব, আখ ও কালাই। তা ছাড়া নারকেল ও নানা ধরনের মসলা চাষ হতো এখানকার মাটিতেই। তবে এ শস্যগুলোকেও এখানকার স্থানীয় শস্য বলা চলে না। হতে পারে অস্ট্রিক উপনিবেশকালে এই শস্যগুলো এখানে এসেছে। কারণ, চাষবাসের আগে এই অঞ্চলের মানুষ ছিলেন শিকার-সংগ্রাহক। আজ থেকে ৫-৬ হাজার বছর আগেও ভারত উপমহাদেশে ‘নেগ্রিটো’ জনগোষ্ঠী বসবাস করত। এই আদিবাসীরা চাষকর্ম জানতেন না। তাদেরকে হটিয়ে এই ভূখণ্ড দখল করেন অস্ট্রিকরা। দখলদারেরা কৃষিকাজ জানতেন। ফলে এই অঞ্চলে তারাই কৃষিকাজ শুরু করেন। অবশ্য অস্ট্রিক আগমনের কিছুকাল আগে এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছিলেন দ্রাবিড়রা। ভারতবর্ষে যেসব স্থানে পানির প্রাচুর্য ছিল না, সেখানকার আবাদি শস্য ছিল যব ও গম। এই ফসল দুটি চাষের প্রচলন করেছিল দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী। এই দ্রাবিড়রা এলেন কোথা থেকে? তাদের উপনিবেশ স্থাপনের বিষয়ে দুটি ধারণা প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, তারা ভারতবর্ষের স্থানীয়; কেউ বলেছেন দ্রাবিড়রা বিদেশি। যদি তারা স্থানীয় হন, তাহলে বলা চলে, যব ও গমই ভারতবর্ষের নিজস্ব খাবার। যদি তারা বিদেশি হন, তাহলে বলা চলে, এ দুটি শস্য বাইরে থেকে এসে এখানকার ভূমিতে উপনিবেশ গেড়েছে। এ দুটি ফসল হয়তো শিকার-সংগ্রাহক ভারতবর্ষের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন বহিরাগত দ্রাবিড়রা। ধানও বঙ্গাঞ্চলের নয়। বর্তমান বিজ্ঞানীদের ধারণা, এশিয়ায় প্রথম ধান চাষের প্রচলন চীনের পার্ল রিভার ভ্যালিতে। তা ৮ হাজার ২০০ থেকে ১৩ হাজার ৫০০ বছর আগে। জার্নাল নেচারে প্রকাশিত এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, চীনের পার্ল উপত্যকা থেকেই ধান পূর্ব এশিয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার লাভ করে। ধানের বিস্তারের সঙ্গে উপনিবেশবাদের কিছুটা সংযোগ আছে। যেমন গ্রিস ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ধানের প্রচলন ঘটান আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের ভারত অভিযানের অভিযাত্রীরা। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৪-৩২৪ অব্দে। ইউরোপের অভিযাত্রীরা পরে নতুন নতুন মহাদেশ আবিষ্কার শুরু করেন। তাদের সঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ে ধান শস্যটি। সেনাবাহিনীর যুদ্ধযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে কিছু খাদ্য বিশ্বের এদেশ থেকে ওদেশ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলা চলে খিচুড়ির কথা। পদটি উৎপত্তির নানামাত্রিক ইতিহাস রয়েছে। তাতে ভাগ বসান স্কটিশরাও। তাদের দাবি, স্কটিশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ‘কেডজ্রি’ নামের একটি পদ ভারতবর্ষে আসে; তারপর তা ইংল্যান্ডে ফেরত যায়। কেডজ্রিকে অনেকেই খিচুড়ির আদি পদ ভাবেন।
মধ্যযুগে বাংলার রসনায় যুক্ত হতে থাকে ইন্দো-পারসিক খাবার। ধারণা করা হয়, ভারতবর্ষের পোলাও কিংবা ইংল্যান্ডের ‘পিলাফে’র আঁতুড়ঘর পারস্য। বিরিয়ানির আমদানি নিয়েও একটি দুর্বল ইতিহাস প্রচলিত আছে। তা হলো, হাজার বছর আগে আরব যাযাবরেরা হাঁড়িতে চাল, মাংস ও মসলা মিশিয়ে মাটিতে গর্ত করে রান্না করতেন। তৈমুর লংয়ের বদৌলতে যাযাবরদের সেই পদ কাজাখস্তান ও আফগানিস্তান পেরিয়ে ভারতবর্ষে পৌঁছায়। ১৪ শতকে। তা ছাড়া পারস্য থেকে বাংলায় আসা একটি মিষ্টান্ন হলো ফিরনি। কলকাতার লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য তার ‘খানা তল্লাশি’ বইয়ে ‘শির বিরিঞ্জ’ নামের একটি পারসিয়ান খাবারের উল্লেখ করেছেন। পারস্যে দুধকে বলা হতো ‘শির’ এবং ফারসি ‘বিরিঞ্জ’ শব্দের অর্থ চাল বা ভাত। সেই অঞ্চলে তৎকালে চালের গুঁড়া, গোলাপজল ও পেস্তাবাদাম দিয়ে ফিরনি তৈরি হতো। সেই ফিরনিই পারস্য থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। ক্ষীরও তা-ই।
ঔপনিবেশিক যুগেই বাংলার খাবারে বিদেশিদের পদ ঢুকে পড়ে সবচেয়ে বেশি। মসলার টানে এই অঞ্চলে আসা পর্তুগিজরা এখানকার বাসিন্দাদের রসুইঘরের চেহারাই বদলে দিয়েছিলেন। খাদ্যাভ্যাসে এনেছিলেন বিরাট পরিবর্তন। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ভারতীয়রা কিচেন গার্ডেনের ব্যবহার শেখেন ওলন্দাজদের কাছ থেকে। আলু খাওয়া শেখেন পর্তুগিজদের কাছ থেকে। তা ছাড়া ঔপনিবেশিক ইতিহাসে আলু খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। শোনা যায়, দুটি বিশ্বযুদ্ধেই আলুর ওপর নির্ভর করেছে জার্মানি। ভারতবর্ষের মানুষ দুধ কেটে ছানা তৈরির কৌশল শিখেছিলেন পর্তুগিজদের কাছ থেকেই। অবশ্য দুধ কেটে ফেলার বিষয়টিও যে পর্তুগিজদের নিজস্ব আবিষ্কার, তা না-ও হতে পারে। ওপরে বলা হয়েছে, পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধে যখন কৃষিকাজের প্রচলন ঘটে, পূর্ব গোলার্ধ তখন পশুকে গৃহপালিত করতে শেখে। পশুপালক গোষ্ঠীদের হাতেই প্রথম দুধ কেটে ছানা তৈরি হয়েছিল। আকস্মিকভাবেই। তারা দুধ সংগ্রহের জন্য প্রাণীর পাকস্থলী দিয়ে এক প্রকার ব্যাগ তৈরি করতেন। কখনো কখনো সেই থলে থেকে রেনেট নামের একপ্রকার এনজাইম নিঃসৃত হতো, যা দুধকে কেটে ফেলত। মূলত কোন খাবার কোথা থেকে এসে কোথায় উপনিবেশ গড়েছে, তা হলফ করে বলা সত্যিই কঠিন। তবে ভারতবর্ষের মানুষ দুধ কেটে ছানা তৈরি যে পর্তুগিজদের কাছ থেকেই শিখেছেন, এ কথা ঐতিহাসিক। এমনকি আগে এই অঞ্চলের লোকেরা মিষ্টি তৈরি করতে ক্ষীর ব্যবহার করলেও পর্তুগিজ উপনিবেশ তৈরির পর ছানা দিয়েই তা বানাতে শুরু করেছিলেন। মূলত ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার রাষ্ট্রীয় কার্যে সক্রিয় ছিলেন পর্তুগিজরা। এ সময়েই তাদের আনা রেসিপি, খাদ্যাভ্যাস ও শস্যগুলো উপনিবেশ গড়ে বাংলার পাতে ও শস্যক্ষেত্রে। দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের নানান ফল ও শুকনা খাবার এ ভূখণ্ডে বয়ে এনেছিলেন তারা। কথিত আছে, পর্তুগিজরা ঝালের সঙ্গে ভারতবর্ষের মানুষের পরিচয় ঘটিয়ে দেন। কথাটি সর্বাংশে সঠিক না-ও হতে পারে। কারণ, নীহাররঞ্জন রায়ের লেখা ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব)’ বইতে ‘পিপ্পলী’ নামের একটি ভেষজের হদিস মেলে, যা সাধারণের কাছে পিপুল নামে পরিচিত। এর ফলের স্বাদ ঝাল। ঔপনিবেশিক আমলের আগে ভারতবর্ষের মানুষ ঝাল হিসেবে পিপুল খেত। তাই বলা যেতে পারে, পর্তুগিজ উপনিবেশ এই অঞ্চলে মরিচ নিয়ে এলেও ঝাল স্বাদ এখানে আগে থেকেই ছিল।
ভেতো বাঙালির সকালের খাবারের মেনুও বদলে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন পর্তুগিজরা। সকালে পাউরুটি কিংবা বিস্কুট খাওয়ার অভ্যাস গড়ে দিয়েছিলেন তারাই। ধারণা করা হয়, দুটি পদই এই অঞ্চলে পর্তুগিজরা আমদানি করেছিলেন। তবে পাউরুটি যে পর্তুগিজদের নিজস্ব খাবার, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে না। কারণ, ৩ হাজার ৫০০ বছর আগে মিসরে খাবারটি ছিল। সেখান থেকেই হয়তো কোনোভাবে তা বিশ্বে ছড়িয়েছে। খাবারটির উৎপত্তি যেখানেই হোক, বাংলাদেশে এসেছে পর্তুগিজদের ঝোলায় চেপেই। তারা চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক ঘাঁটি গাড়ার সময় সঙ্গে এনেছিলেন এই বিশেষ রুটি। সনাতন ধর্মাবলম্বী-অধ্যুষিত অঞ্চলে এই পদের ওপর বিশেষ বিদ্বেষ ছিল। তারা একে ধর্মনাশক খাদ্য মনে করতেন। কেননা, এগুলো তৈরি করতেন বিদেশি ময়রা। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, পাউরুটিকে সাদরে গ্রহণ করেনি ভারতবর্ষ। কোনো না কোনোভাবে তা এই অঞ্চলের মানুষের মেনুতে চেপে বসেছে।
খাদ্যবিষয়ক আরেকটি আগ্রাসনের অভিযোগ আছে ডার্ক চকলেটের বিরুদ্ধে। ঘানা ও আইভরি কোস্টের চাষিরা পড়েছেন কোকোয়া বীজ চাষের মারপ্যাঁচে। এই শস্য উপনিবেশ তৈরি করে নিয়েছে আইভরি কোস্টের রিজার্ভ ফরেস্টে। ফলে চাষিরা বেশি লাভের আশায় এবং মাত্র ৪-৫টি বড় বড় কোকোয়া ট্রেডার কোম্পানির চাহিদা পূরণের জন্য উজাড় করে ফেলছেন তাদের বনভূমি। কিছু কোম্পানির চাহিদা মজুত ও দামকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, কোকোয়া কম চাষ করলে কৃষকদের না খেয়ে মরতে হয়, আর বেশি চাষ করলে এই বীজের দাম স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ কমে যায়। সাধারণ চাষিরা এই মারপ্যাঁচ বুঝতে না পেরে বেশি বেশি কোকোয়া ফলানোকেই লাভজনক মনে করেন। কিন্তু অতিরিক্ত বীজ ফলাতে চাই বাড়তি শ্রমিক। শ্রম বাড়াতে তারা কোকোয়া ভূমিতে শিশুশ্রমিক নিয়োগ করেন। এসব শিশু আসে পাচারের মাধ্যমে। ঘানা ও আইভরি কোস্টে পাচার হওয়া শিশুদের কোকোয়া চাষে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই তথ্যের অনুসন্ধান শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। ব্রিটিশ ডকুমেন্টারি ‘স্লেভারি: আ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেশন’ (২০০০) তৈরিকালে আফ্রিকার প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে শিশুদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, যেখানে অভিযোগের সত্যতা মেলে। দিনের পর দিন বেতন ছাড়াই শিশুদের দিয়ে চাষ করানো হয় কোকোয়া। এমনকি শিশুচাষিদের শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণও মিলেছে।
উপনিবেশ আমলে যে কেবল খাদ্যবস্তুর আমদানি হয়েছে তা নয়, অনেক সময় শাসকগোষ্ঠীকে তাড়াতেও অস্ত্রের বিকল্প হিসেবে কাজ করেছে খাদ্য। যেমন ব্রিটিশদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল একধরনের রুটি। ইতিহাসে ঘটনাটি ‘চাপাতি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালের ঘটনা। উত্তর ভারতের কিছু গ্রাম থেকে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল চাপাতি নামের একধরনের রুটি। খাবারটির অস্বাভাবিকভাবে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি ব্রিটিশ প্রশাসনের নজরে আনেন সেই সময়ের মাথুরার ম্যাজিস্ট্রেট মার্ক থ্রনহিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই রুটি দক্ষিণে নর্মদা নদীর তীর থেকে উত্তরে নেপালের সীমানা পর্যন্ত কয়েক শ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। তা-ও আবার এক রাতের মধ্যেই! থ্রনহিল তার অফিসে চাপাতি রুটি খুব গভীরভাবে পরীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তাতে তিনি অস্বাভাবিক কিছু বা বিশেষ কোনো বার্তা খুঁজে পাননি। ব্রিটিশরা হয়তো ভেবেছিলেন, সম্ভাব্য কোনো দাঙ্গার বার্তা ছড়িয়ে যাচ্ছে রুটির মাধ্যমে। এমনকি ব্রিটিশ প্রশাসনের ঘুম কেড়ে নেয় সেই সাধারণ চাপাতি।
খাবারের উপনিবেশ সরলরৈখিকভাবে ব্যাখ্যার বিষয় নয়। ফলে এর ফিরিস্তি দেওয়া কিছুটা জটিল। শুধু যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ীরা পরাজিতদের ওপর তাদের খাদ্যসংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে খাবারের উপনিবেশ তৈরি করেছেন—এমনটা সর্বাংশে ঘটেনি; বরং আরও বিচিত্র কায়দায় বিভিন্ন আগ্রাসনের মাধ্যমে নিজেদের ফসলকে বিদেশিদের তৃণভূমিতে ফলাতে বাধ্য করা কিংবা বিদেশিদের শস্য নিজেদের খেতে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রাচীন ট্রাইবাল সমাজের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বিজয়ী গোত্র পরাজিত গোষ্ঠীর আদিবাসীদের ধরে এনে নিজেদের ভূমিতে নিজস্ব ফসল চাষ করতে বাধ্য করেছে। এটিকে এক অর্থে খাদ্যের উপনিবেশ বলা চলে। খুব বেশি দিনের নয় এবং খুব বেশি দূরের নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী আরাকান অঞ্চলের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সতেরো শতকে মগ জলদস্যুরা দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার লোকদের ধরে ধরে লোহার শিক দিয়ে প্রথমে হাতের তালু ছিদ্র করতেন। তারপর ছিদ্রের ভেতর দিয়ে চিকন বেত ঢুকিয়ে বেঁধে জাহাজে করে নিয়ে যেতেন আরাকানে। বন্দিদের দাস বানিয়ে জঙ্গল সাফ করিয়ে কৃষিকাজ করানো হতো। আবদুল হক চৌধুরীর লেখা বই ‘প্রাচীন আরাকান রোয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ অধিবাসী’ এবং এম. এম. হাবিব উল্লাহ রচিত ‘রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’ বইতে এই ঘটনার বিবৃতি মেলে। অনুমান করা যেতে পারে, মগ দস্যুরা নিশ্চয়ই তাদের প্রয়োজনীয় শস্যই চাষ করাতেন সেসব দুর্ভাগা চাষিকে দিয়ে। মূলত প্রতিটি খাবারের পেছনেই রয়েছে এমন কিছু হাহাকারের বয়ান। সেসব আর্তনাদের জন্মদাতা ক্ষমতাধর ঔপনিবেশিকেরা। এখনো বাংলাদেশের বেশ কিছু ধানিজমি অসাধু ব্যবসায়ীদের কূটচাপে তামাক চাষে ব্যবহৃত হতে বাধ্য হয়।
মডেল: অভিনেত্রী পূর্ণিমা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব ও জুয়েলারি: কিয়ারা
ছবি: জিয়া উদ্দীন