ফিচার I অল্পে অনন্য
দামি আসবাব বা নামি দোকানের হোমওয়্যার নয়, হালকা কিছু পরিবর্তনেই অন্দর হয়ে উঠতে পারে সুন্দর। কীভাবে? জানাচ্ছেন দীপান্বিতা ইতি
উৎসব মানেই নতুন সাজে সেজে ওঠে বাঙালি মন। উৎসবের রঙে আমরা যেমন রাঙিয়ে তুলি নিজেদের, তেমনি নতুন সজ্জায় সাজানো হয় প্রতিটি গৃহকোণ। কোভিডের কঠিন পরিস্থিতি পার করে উৎসবের এই সময়টা সবার জন্য একটু বেশিই আপন। দীর্ঘদিন গৃহবাসের পর ঘরের প্রতি তৈরি হয়েছে অন্য রকম মমতা। আর তাই নিজেকে সাজিয়ে তোলার পাশাপাশি নান্দনিক অন্দরসজ্জার প্রতি মনোযোগটা আন্তরিক। গৃহসজ্জার প্রতিটি অনুষঙ্গ ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটায়। তবে উৎসবমুখর পরিবেশে নতুন করে ঘর সাজানোর সাধ সবার থাকলেও সাধ্যটা কখনো কখনো বাদ সাধে। অবশ্য সজ্জায় রদবদল ঘটিয়ে অল্প খরচে যদি অন্দরে নতুনত্ব আনা যায়, মন্দ কি! দামি আসবাব বা নামি দোকানের হোমওয়্যার নয়, রুচিবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে হালকা কিছু পরিবর্তনেই অন্দর হয়ে উঠতে পারে অনন্য।
অন্দরসজ্জার উপকরণ যা-ই হোক, উৎসবের আয়োজনে ঘরের প্রতিটি কোণ হতে হবে পরিপাটি ও ছিমছাম। আর তার প্রথম শর্ত পরিচ্ছন্নতা। এখানে-সেখানে মাকড়সার বাসা, ধুলায় ধোঁয়া আসবাব, অপরিষ্কার পর্দা, নোংরা মেঝে বা তেল চিটচিটে বাসনকোসন—বিগ নো। ঘর ঝাড়– দেওয়ার আগে ঝুল ঝেড়ে নিতে হবে। শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে ফার্নিচার ক্লিনার ব্যবহার করলেই চকচকে হয়ে ওঠে ব্যবহৃত আসবাব। বিভিন্ন সুপারশপে লিকুইড ফার্নিচার ক্লিনার কিনতে পাওয়া যায়। তবে বেশি পুরোনো হলে উৎসব উপলক্ষে পালিশ করিয়ে নিলেই পুরান আসবাব নতুন রূপ দেখাবে। শোকেস, বুকশেলফ, ডাইনিং ওয়াগন বা ওয়াল কেবিনেটের ভেতরে জিনিসপত্র সরিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন। বারান্দা বা জানালার গ্রিল আর কাচের পরিচ্ছন্নতাও জরুরি। নিয়মিত মোছা হলে মেঝে খুব একটা নোংরা হয় না। তবে উৎসবের আমেজে ঘরের মেঝে ঝকঝকে করতে চাইলে টাইলস ক্লিনার দিয়ে টাইলসের মেঝে ও মেশিন পলিশিংয়ের মাধ্যমে মোজাইকের মেঝে পরিষ্কার করা যায় সহজে।
ঘরকে ঘর বানায় দেয়াল। তবে নাগরিক জীবনযাপনে ছোট জায়গায় দেয়ালকে বড্ড গায়ে পড়া মনে হয়। অবশ্য নান্দনিক উপস্থাপনায় বাধার প্রাচীর এই দেয়াল হয়ে উঠতে পারে নির্ভরতার স্বস্তি। একটু বুদ্ধি খরচ করলেই সাদামাটা দেয়াল বলে উঠতে পারে নানান গল্প। উৎসব সামনে রেখে পছন্দসই রঙে রাঙিয়ে তোলা যায় দেয়াল। ঘরের আকারকে প্রাধান্য দিয়ে রং নির্বাচন করতে হবে। হালকা রং ব্যবহার করলে ঘর বড় দেখায় আর গাঢ় রং ব্যবহার করলে ছোট। স্বস্তিদায়ক কোনো রং কিংবা একেক ঘরের মুড বুঝে একেক রঙে দেয়াল হয়ে উঠতে পারে কাব্যিক। তবে বাজেট মাথায় রেখে রঙের পরিকল্পনা যদি বাদ দিতে হয়, সে ক্ষেত্রে কম খরচের ওয়ালপেপার স্টিকার ঘরে আনতে পারে নতুনত্ব। নানা ধরন, ডিজাইন ও টেক্সচারের এই ওয়ালপেপারের পাশাপাশি লেমিনেট দেয়াল বেশ চলছে এখন। তা ছাড়া আজকাল থিম অনুযায়ী ওয়াল আর্ট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আর পছন্দসই ছবির ফ্রেমে পারিবারিক গল্পগাথা বা বিশেষ কোনো চিহ্ন দেয়ালকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
সবশেষে আসে ফ্লোটিং ওয়াল র্যাকের কথা। শোপিস, বই, গাছ বা ছবির ফ্রেম রাখতে র্যাকের বিকল্প নেই। কাঠ, প্লাইউড, প্লাস্টিক, সলিড লেমিনেট, রট আয়রন—নানা ধরনের ম্যাটেরিয়ালে তৈরি বিভিন্ন আকৃতি প্রকৃতির এই ওয়ালর্যাকগুলো দেয়ালে নতুন লেয়ার যোগ করে।
এবার আসি আসবাবে। পুরোনো আসবাবে ভিন্ন প্রতিস্থাপনে যদি ঘর সেজে ওঠে নতুন করে, তবে নতুন কেনার কী দরকার! দীর্ঘদিনের ব্যবহারে মলিন কাঠের জিনিসপত্র ফার্নিচার ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করে বা প্রয়োজনে পালিশ করিয়ে তার অবস্থান নিয়ে একটু ভাবতে হবে। এত দিন যেখানে ছিল, সেখানে না রেখে একটু ভিন্নভাবে সাজাতে হবে। দেয়াল থেকে একটু দূরত্ব রেখে সোফা, ডিভান, শোকেস বা বুকশেলফ এদিক-ওদিক সরিয়ে নতুন অবস্থানে নিয়ে গেলেই ঘরে চলে আসে নতুনত্ব। অবশ্য ঘরের আকার অনুযায়ী আসবাব পছন্দ করা দরকার। ফাঁকা জায়গা না থাকলে ঘরে খোলামেলা আবহ থাকে না। তাই আসবাবের আকার ও আধিক্য নিয়ে সচেষ্ট থাকা চাই।
যাপিত জীবনকে আড়ালে রাখে পর্দা। একান্ত নিজস্বতা আগলে রাখে। আবার ঘরের পরিবেশ বদলে দিতেও পর্দার জুড়ি নেই। নানান রঙের নানা ডিজাইনের বাহারি পর্দা যেমন ঝলমলে করে তোলে ঘর, তেমনই রং আর নকশায় বহন করে ঘরের মানুষের সুরুচির ছাপ। উৎসব উপলক্ষে নতুন পর্দা হতেই হবে, এমন নয়। পুরোনো পর্দা ধুয়ে আয়রন করে ঝুলিয়ে দিলেই প্রাত্যহিক জীবনের চেয়ে আলাদা হয়ে যায় ঘর। তবে দ্রুত ময়লা হয়ে যায়, এমন পর্দা ব্যবহার কষ্টকর। আলো প্রবেশের পথের কথা মাথায় রেখে পর্দা বাছাই করতে হবে। যেমন শোবার ঘরে ভারী পর্দা আর বসার ঘরে হালকা। পর্দার রঙের নির্বাচন ব্যক্তিগত রুচির ওপর নির্ভর করে, তবে ঘরের রং আর আলোর বিষয়টি বিবেচনা করা চাই।
আলোর কথা যখন এলো, এ নিয়ে দুটো কথা বলেই ফেলি! অল্প খরচে ঘরে আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে চাইলে ল্যাম্পের জুড়ি মেলা ভার। ঘরের এক কোণে একটি রঙিন ল্যাম্প রেখে দিলেই বদলে যায় ঘরের পরিবেশ। কখনো আলো-আঁধারি রহস্যময়তা আর কখনো লাল, নীল, হলুদের রোমান্টিসিজম। আবার সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো নানান শেডের ল্যাম্প পাওয়া যায় বাজারে গেলেই। হস্তশিল্পীদের তৈরি মাটি, কাঠ, কাপড়, কাগজ বা নারকেলের খোলের ল্যাম্পগুলোর দাম কিন্তু বেশি নয়। তবে আসবাব, দেয়ালের রং ও ঘরের মাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোর মাত্রা নির্ধারণ করা চাই। অবশ্য বিয়েবাড়ির আলোকসজ্জার মরিচবাতি ঘরের পিলার বা জানালার গ্রিলে জড়িয়ে দিলে মুহূর্তেই ঘরে আসবে উৎসবমুখর পরিবেশ।
পরিবেশ উৎসবমুখর করে তুলতে নিত্যনৈমিত্তিক অনুষঙ্গ ভুলে গেলে চলবে না। টেবিল ক্লথ, রানার, কুশন কভার, বিছানার চাদর বা বালিশের কভার ধুয়ে নতুন করে বিছিয়ে নিতে হবে। অবশ্য অনেকে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের মধ্য থেকে অনেকেই কিছু জিনিস আলাদা করে রাখেন বিশেষ দিনে ব্যবহারের জন্য। দেয়ালের রং, পর্দা, ঘরের আলোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেছে নিতে হবে টেবিলের ঢাকনা কিংবা বিছানার চাদর। কুশন কভারে এখন বিভিন্নতার অভাব নেই। তাই সোফা বা ডিভানে রংচঙে কুশন বদলে দিতে পারে ঘরের মুড। বসার ঘরের সেন্টার টেবিলের নিচে কিংবা আরামদায়ক কর্নারে নান্দনিক শোপিসের নিচে শতরঞ্জির ব্যবহার আভিজাত্যের পরিচয় দেয়। অবশ্য কার্পেট বা শতরঞ্জিতেও ভারী ডিজাইনের চেয়ে হালকা নকশা বা জ্যামিতিক প্যাটার্নের ছিমছাম আঁকিবুঁকি অনেকেরই ভালো লাগে।
শোপিস যেমন রুচি ও মানসিকতার পরিচয়, তেমনই সৌন্দর্যের সহজ সমাধান। কিন্তু যেমন তেমন শোপিস হলেই কি হয়! শুধু নামি দোকানের দামি শোপিস নয়, নান্দনিকতায় অনন্য হয়ে উঠতে পারে পথের ধারে হঠাৎ দেখা কোনো শোপিসও। তবে যেখানে যা পছন্দ হয়, তা কিনে এনে ঘর ভরালে হারিয়ে যাবে স্বতন্ত্র সৌন্দর্য, হয়ে উঠবে জঞ্জাল। আর ছোট বড় শোপিস পরিষ্কার করে রাখা তো কম ঝক্কি নয়! তাই ঘরের আকার, আসবাব, রং, আলো দেখে শোপিস পছন্দ করুন। অন্দরসজ্জায় বেশ জনপ্রিয় টেরাকোটা, বাঁশ-বেতের ঝুড়ি, শতরঞ্জি, নকশিকাঁথার মতো আরও অনেক দেশীয় উপকরণ। ভিন্ন রূপে, ভিন্ন আঙ্গিকে দেশীয় পণ্যের সজ্জা সত্যিই প্রশংসনীয়।
সবকিছুর পরেও অন্দরসজ্জা অপূর্ণ! প্রাণবন্ত নয় গৃহকোণ! সবুজের ছোঁয়া আছে কি সাধের অন্দরসজ্জায়? নাগরিক জীবনে নেই সবুজের তেমন সমারোহ। আমরা সব সময় সবুজের কাছাকাছি যেতে পারি না, অবকাশ থাকে না। তাই বাড়িতেই ইনডোর প্ল্যান্ট নয় কেন? তা ছাড়া ঘর সাজানোর বাজেট একটু কম হলে গাছ দারুণ কাজে লাগে। খুব বেশি ঝক্কি ছাড়াই ঘরের ভোল বদল করতে চাইলে মানিপ্ল্যান্ট, জিজি, পিস লিলি, রাবার প্ল্যান্ট, এরিকা পামের মতো ইনডোর প্ল্যান্ট আদর্শ। বাঁশ-বেতের ঝুড়ি, কাচের জার, বাতিল বা অব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়েই বানিয়ে ফেলা যায় প্ল্যান্টার।
তো, এবার উৎসবে নিজের অন্দরমহলে পরিবর্তন ও সজ্জার কী চমক হাজির করতে যাচ্ছেন আপনি?
ছবি: ইন্টারনেট