ছুটিরঘণ্টা I লুয়াংপ্রাবাং
সেখানে ইতিহাসের নানা উপাদান। প্রার্থনার সৌন্দর্য। নৈসর্গিক মায়া। লিখেছেন মঈনুস সুলতান
লাওসের লুয়াংপ্রাবাং শহরে আজকাল পর্যটক আসছে বিস্তর। এখানে তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের একটি বিমানবন্দর। রাজকীয় এ রাজধানী শহরটি এখন ইউনেসকো স্বীকৃত ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’। পাঁচ-সাত শ বছরের পুরোনো এ নগরীর অলিগলিতে গড়ে উঠেছে ‘বানপাক’ বা অতিথিশালা। সবই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আর সান্ধ্য নৃত্যগীতে জমজমাট। আমরা প্রথম লুয়াংপ্রাবাং শহরে আসি অনেক বছর আগে, ১৯৯৫ সালে। তখন এত কিছু ছিল না। বিমানবন্দরে ছিল যাত্রীছাউনি হিসেবে ছোট্ট একটি চারচালা ঘর। শহরতলিতে একটি পর্যটন অফিস ছিল বটে; কিন্তু তা কখন খুলবে, কেউ জানত না। এমনকি আমরাও ঠিক জানতাম না যে লুয়াংপ্রাবাংয়ে যেতে পাসপোর্ট ভিসা লাগবে। আমাদের না জানাতে কিন্তু তেমন কিছু অসুবিধা হয়নি। আমি ও হলেন আমাদের পনেরো মাসের কন্যা কাজরিকে কোলে করে লাওসের হালজামানার রাজধানী ভিয়েনচান এয়ারপোর্টে হাজির হয়েছিলাম। দেশের মধ্যে এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে যে ছাড়পত্র লাগতে পারে, সেই জ্ঞান তখনো অর্জন করে উঠতে পারিনি। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জবাবে পরিষ্কার লাও ভাষায় ‘জানি না’ বলেছিলাম। কর্মকর্তারা আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন। পরেরবার যেন এ ধরনের ভুল না করি, তার জন্য শাসিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের ভ্রমণ আটকাননি। চোখ পিটপিট করা তরুণ ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের ব্যাগ নিজ হাতে বহন করে প্লেনের সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন।
লুয়াংপ্রাবাং শহরটি যেহেতু রাজকীয় হিসেবে প্রসিদ্ধ; তাই রাজপ্রাসাদ দিয়ে আমরা ভ্রমণের সূচনা করি। শোনা যায়, বেলা দশটা নাগাদ দর্শকদের ঢুকতে দেয়া হয় সেখানে। আমরা ঠিক দশটা পনেরো মিনিটে রাজদোরে হাজির হই। প্রায় ঘুমন্ত এক প্রহরী আমাদের পরের দিন আসতে বলেন। আমি জোড়হাতে তাকে বলি- অনেক দূরদেশ থেকে পাসপোর্ট ছাড়াই চলে এসেছি, চৌকিদার মশাই, তুমি আমাদের বিমুখ করবে? করজোড়ে কাজ কিন্তু হাসিল হয়। খুলে যায় রাজপুরির লৌহকপাট। আমরা তালগাছে ছাওয়া নুড়ি বিছানো একটি দীর্ঘপথ দিয়ে প্রাসাদের মূল গৃহের দিকে অগ্রসর হই। আমাদের বাঁ পাশে একটি গোলাকার শাপলা পুকুর দৃষ্টিকে করে তোলে সজল ও রঙিন। দুপাশে দুটি মরচে পড়া কামানে সাজানো মার্বেল পাথরের সিঁড়ি দিয়ে আমরা সরাসরি চলে যাই মস্ত বড় দুটি সোনালি ফ্রেমের আয়নায় সজ্জিত প্রটোকল রুমে। এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা হয় মাঝবয়সী আরেক চৌকিদার দম্পতির। দুজনে কাঠের মেঝেতে বসে বেতের ঝুড়ি থেকে কিছু একটা খাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে অবাক হয়ে তাকান, তারপর হেসে ওঠেন আপাত বিনা কারণে। আমরা ভাবি কৌতুককর কিছু করে বসলাম কি? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব মেলে না। দুজনে আমাদের হাতের ইশারায় পাশের একটি কক্ষে যেতে বলেন। কক্ষটির দরোজায় ইংরেজিতে লেখা ‘কিংস্ রিসেপশন রুম’। আমরা রাজকীয় অভ্যর্থনা কক্ষে খানিকটা সময় কাটাই। দেয়ালে লাও গ্রাম, নিসর্গ এবং সংস্কৃতির নানা প্রতীক ফ্রেস্কো করে আঁকা। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হয় রানির রিসেপশন রুম। কক্ষটি আকারে ছোট, তবে দেয়ালে রাজার একটি লাইফ সাইজ পোর্ট্রেট রাখা। প্রাসাদের এদিকে আরও দুটি বৃহৎ হলকক্ষ। ঠিক বুঝতে পারি না, আগেকার দিনে এ কক্ষগুলো কী কাজে ব্যবহৃত হতো। কামরা দুটির দেয়ালের পাশে বেশ ক’টি শোকেস। এগুলোতে সাজানো রয়েছে নানা রাষ্ট্র থেকে রাজপরিবারকে দেয়া রকমারি সব উপহার। একটি শোকেসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাঠানো উপহার দেখে আমরা অবাক হই। চৌকিদার মহিলা এসে আমাদের সিংহাসনকক্ষে নিয়ে যান। কক্ষটি বিশাল ও নতুন। একটি ফলক পড়ে জানা যায়, কামরাটি ষাটের দশকে মূল প্রাসাদের সঙ্গে সংযোজিত হয়। বর্তমানে এখানে সিংহাসন ছাড়াও আছে রাজকীয় হাতির সোনালি হাওদা। কামরাটির সম্পূর্ণ ছাদ ও দেয়ালের কিয়দংশ উজ্জ্বল রঙিন কাচ বসিয়ে দৌড়ের নাও, মহিষ ও রাখাল, নৃত্যরত নারী, বৌদ্ধ শ্রমণ ও হাতির পিঠে শিকার ইত্যাদি প্রতীকী ভঙ্গিতে আঁকা। ঝাড়বাতির বিচ্ছুরিত আলো কাচের রকমারি প্রতীকে প্রতিফলিত হয়ে আশ্চর্য সুন্দর বর্ণালি সৃষ্টি করেছে। ঝাড়বাতির ঠিক নিচে রাখা আয়নার কাসকেটে রাজকীয় শিরোভূষণের নমুনা। আমি সেদিকে তাকাচ্ছি দেখে নারী প্রহরী আমাকে বললেন- ‘মুট্কুট’। বস্তুটি যে রাজার মুকুট এবং শব্দটি যে আমাদের ভাষার অনুরূপ, তাতে আমার কোনো সন্দেহ থাকে না।
সিংহাসনকক্ষটিতে দেখার অনেক কিছু ছিল। কিন্তু শান্তিতে দর্শন সমাপন করা যায় না। আমাদের শিশুকন্যা কাজরি জ্বালাতন শুরু করে। হাত-পা ছোড়া ক্রন্দনরত একটি শিশুকে নিয়ে প্রাসাদের বাকি অংশটুকু দেখবো, না আপাতত দেখাটেখা বাদ দিয়ে হোটেলে ফিরে যাবো- এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ি। নারী প্রহরী হলেনের কাছ থেকে কাজরিকে কোলে নেন। পুরুষ প্রহরীকেও তৎপর হতে দেখা যায়। উনি কোথা থেকে নিয়ে আসেন একটি রকিং হর্স বা দোলানো যায় এ রকম একটি কাঠের ঘোড়া। কাজরিকে ঘোড়ায় বসিয়ে দোল দিতেই তার মুখে হাসি ফোটে। পুরুষ প্রহরীটি এবার লাও ভাষায় আমাদের কিছু বলেন। তার বলা বাক্যগুলোর মধ্যে আমি কেবল একটিমাত্র শব্দ শনাক্ত করতে পারি; শব্দটি হচ্ছে ‘রাজখট’। আমার অনুমিত অনুবাদ হচ্ছে ‘রাজপুত্র’। আমরা আন্দাজ করি, দোল দেয়ার কাঠের ঘোড়াটি একসময় লাও রাজার পুত্র ব্যবহার করতেন। নারী প্রহরী আমাদের লাও ভাষায় ও হাতের ইশারায় এগিয়ে যেতে বলেন। বুঝতে পারি, কাজরিকে সাময়িক দেখভাল করতে তার কোনো আপত্তি নেই। নিজের মেয়েকে অন্যেরা লালন পালন করবে, আমরা পিতা-মাতা তার জ্বালাতন থেকে রেহাই পাবো- এর চেয়ে আনন্দের কিছু কি হতে পারে? আমরা এ সুযোগে প্রাসাদের বাকি অংশটুকু দেখতে যাই। সিংহাসনকক্ষের পেছনে লাইব্রেরি। মস্ত মস্ত কাঠের সিন্দুকে রাখা তালপত্রের পুঁথি। আমরা দীর্ঘ কাঠের করিডর দিয়ে রাজা-রানির শয়নকক্ষ ছাড়িয়ে এসে পৌঁছি তাদের ছেলেমেয়েদের ঘরে। এ কামরায় রাজপুত্র ও কন্যাদের খেলনা ছাড়াও আছে দেয়ালে ঝোলানো রামায়ণ নৃত্যের অনেক মুখোশ। কাজরিকে ছেড়ে এসেছি বলে আমাদের দুজনের মনে তখন খানিক দ্বিধা আর তাড়া। আমরা দ্রুত সবকিছু একনজর চোখ বুলিয়ে নিতে চাচ্ছি। প্রাসাদের বাঁ দিকে একটি টেনিস কোর্ট। অনেক দিন কোর্টটি কেউ ব্যবহার করেনি। আমরা কোর্টের উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাই পেছন দিকে নদীর তীরে। মেকং নদীর পাড়ে রাজকীয় বোট-হাউস বা নাও-ঘর। ঘরটি দ্বিতল। নিচের তলায় রাখা অতি দীর্ঘ সোনালি কারুকাজ করা একটি দৌড়ের নাও। আমরা উপরের ডেকে উঠে দাঁড়াই। হলেন আমাকে জিজ্ঞেস করে- ‘তুমি লাও রাজা সম্পর্কে কি জানো?’ আমি তাকে বলি, ‘এ প্রাসাদের শেষ রাজা যাকে লাও ভাষায় চাও সিবিত্ বা পালাছা বলা হয়ে থাকে, তিনি সিংহাসন ত্যাগে বাধ্য হন সত্তর দশকের মাঝামাঝি দেশে প্যাটেট লাও পার্টির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কারণেই। রাজার কাজিন প্রিন্স সুভানুভঙ্গ, যিনি “রেড প্রিন্স” নামে খ্যাত, নিযুক্ত হন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। সাবেক রাজাকে কাগজপত্রে নতুন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়। তার পুত্র যুবরাজকে দেয়া হয় সংসদের একটি আসন।’ হলেন মন্তব্য করে, ‘অন্যান্য দেশের বিপ্লবের মতো এখানে তাহলে রাজপরিবারকে হত্যা করা হয়নি।’ আমি তার মন্তব্যের জবাবে বলি- ‘এখানে বিপ্লবের পর তেমন কাউকেই হত্যা করা হয়নি বটে, তবে কিছুদিনের মধ্যে সাবেক রাজা ও যুবরাজকে প্রাসাদ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের একটি অজ্ঞাত স্থানে। দুজনেই সেখানে মারা যান, শোনা যায় ম্যালেরিয়া রোগে। রাজপরিবারের এখন বেশির ভাগ ফ্রান্সে নির্বাসিত।’ এ পর্যন্ত শুনে খানিক চঞ্চল হয়ে হলেন বলে- ‘তুমি এখানে আরেকটু সময় দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলে দাঁড়াতে পারো, আমি কিন্তু কাজরির কাছে ফিরে যাচ্ছি।’ অগত্যা আমাদের ফিরতে হয় যেখানে কাজরিকে রেখে গিয়েছিলাম, সেখানে।
ফিরে এসে দেখি, কাজরি কাঠের ঘোড়া ছেড়ে পুরুষ প্রহরীর পিঠে চড়ছে। আমাদের সাময়িক অনুপস্থিতিতে তার কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হলো না। সে দিব্যি মানুষ রূপী ঘোড়াকে চরিয়ে বেড়াচ্ছে সিংহাসনকক্ষের নরম গালিচা মোড়া মেঝেতে। বেলা হয়ে যাচ্ছে, তাই আমরা বিদায় নিতে চাই। কিন্তু প্রহরী যুগল আমাদের ছাড়েন না। তাদের কথা থেকে আন্দাজ করি যে ‘প্রাবাং’ মূর্তিটি না দেখে আমাদের প্রাসাদ ত্যাগ করা উচিত হবে না। ফলে, আমরা সেদিকেই যাই। রাজদেবতা প্রাবাং প্রাসাদেই থাকেন। তার আসন রাজার রিসেপশন রুমের সঙ্গেই। একটি পুষ্পশোভিত বেদিতে প্রাবাং দাঁড়িয়ে আছেন। ‘প্রাবাং’ থেকে যে লুয়াংপ্রাবাং শহরের নামের উৎপত্তি হয়েছে তা জানতাম, তবে তার সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু আমাদের জানা নেই। কাজরিকে নারী প্রহরী ‘কাওলাম’ বা বাঁশের মধ্যে বিন্নি চাল ও কোরা নারকেলের পুর ভরে বাঁশের চোঙটি পুড়িয়ে তৈরি একধরনের খাবার খাওয়াচ্ছে। এ সুযোগে হলেন ঝোলা থেকে বের করে লাও সংস্কৃতির ওপর প্রকান্ড একখানা বই। অনেক খুঁজে এক স্থানে ‘প্রাবাং’ সম্পর্কে খানিক তথ্য পাওয়া যায়। সে যা পড়ে শোনায় তার সারমর্ম হচ্ছে- ‘ফা নুম নামের এক লাও কুমার কম্বোডিয়ার রাজদরবারে বড় হন এবং পরে তিনি কম্বোডিয়ান এক রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। এ রাজকুমারই কালে কালে লাওসে প্রথম রাজ্য স্থাপন করেন পনেরো শতকে। কম্বোডিয়া থেকে এখানে আসার সময় তাকে দেয়া হয় প্রাবাং নামে সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরি অত্যন্ত প্রাচীন বুদ্ধমূর্তিটি। এটি নির্মিত হয় শ্রীলঙ্কায়, প্রায় হাজার বছর আগে। তাকে কম্বোডিয়ার খেমার রাজার দরবারে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। ফা নুম তার রাজধানী গড়ে তুললে শহরটির নাম হয় লুয়াংপ্রাবাং।’ সে থেকেই প্রাবাং বাস করছেন প্রাসাদে। প্রতিবছর একবার তিনি নিকটবর্তী রাজমন্দিরে দিন তিনেকের জন্য যান, মহাসমারোহে জনগণের সঙ্গে মিলিত হতে। প্রহরী দম্পতি আমাদের দৈহিক অঙ্গভঙ্গি করে ‘প্রাবাং’কে প্রণাম জানাতে বললেন। তাদের কথাবার্তায় আমরা আরও জানতে পারি, রাজা ও রানি নাকি নিত্যদিন ‘প্রাবাং’কে পূজা দিতেন। কাজরিকে অনেক কষ্টে প্রহরী দম্পতির মায়া ছাড়িয়ে আমরা হোটেলে ফিরে আসি।
পড়ন্ত বিকেলে আমরা আবার বেরোই লুয়াংপ্রাবাং শহরটির আরও খানিক দেখতে। আমরা যে রাজপথ দিয়ে হাঁটি, তার দুপাশে শত শত বছরের প্রাচীন বৌদ্ধমন্দিররাজি। কোনো কোনো মন্দিরের প্রবেশদ্বারে পাথর, কড়ি ও শঙ্খে তৈরি ফণা তোলা মহানাগ। একটি মন্দিরের দেয়ালের সোনালি চিত্রকলা আমাদের অনুভূতিকে মুহূর্তের জন্য করে তোলে আনমনা ও রঙিন। আমরা ঔপনিবেশিক যুগের ফরাসি ধাঁচের বাংলো বাড়িগুলোতে বৈকালিক তৎপরতা দেখতে পাই। অবশেষে আবার এসে পৌঁছাই প্রাসাদের প্রধান ফটকে।
রাজকীয় প্রাঙ্গণের ঠিক উল্টো দিকে সুউচ্চ পুছি পাহাড়। ধাপে ধাপে চক্রাকারে উঠে গেছে ইটে বাঁধানো সিঁড়ি। আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকি। সিঁড়ির দুপাশে সারি দিয়ে লাগানো শ্বেত চম্পার গাছ। আমরা কায়ক্লেশে উপরে উঠতে থাকি। থেকে থেকে একটি-দুটি চম্পা ঝরে পড়ে পথে। মিনিট বিশেক চলার পর চূড়ায় পৌঁছাই। পুছি পাহাড়ের শীর্ষে একটি রাজকীয় পর্যবেক্ষণ মন্দির। আমরা মন্দিরের বারান্দায় বসে জোরে জোরে শ্বাস ফেলি। হু হু হাওয়ায় আমাদের ক্লান্তি ও ঘাম মুছে যেতে থাকে। আমরা পর্যবেক্ষণ মন্দিরের চারদিকের ঘেরা বেলকনিতে হাঁটি। লুয়াংপ্রাবাং শহরটির এক প্রান্তে মেকং ও নামকান নদী দুটি যুগল সরীসৃপের মিথুনরেখার মতো মিলিত হয়েছে। সঙ্গমস্থলের উপর বেলাশেষের সূর্যকে অসম্ভব রক্তিম দেখায়। পুছি পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকাই। নারকেলবীথির ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে, ছোট্ট ছোট্ট ফরাসি ধাঁচের বাংলো বাড়িগুলো। মন্দির ও প্রাসাদের শীর্ষে তামার ছত্রিতে শেষ বেলাকার সূর্যালোক ঝিকিয়ে ওঠে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, বেলা পড়ে আসছে দেখে আমরা সাবধানে নিচে নামতে শুরু করি। কাজরি ততক্ষণে আমার কাঁধে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ফেরার পথে রাজমন্দির ওয়াট্ সিয়েং থংয়ের সামনে এসে আমরা প্রায় সম্মোহিত হয়ে পড়ি। মন্দির প্রাঙ্গণের সর্বত্র ভাসছে খানিক অন্ধকারে নানা রঙের আলোর ফুলঝুরি। আমরা ঘুমন্ত মেয়েটিকে নিয়ে আঙিনায় ঢুকি। বাঁধানো প্রাঙ্গণের এখানে-সেখানে সর্বত্র জটলা করছেন আলোকিত ফানুস হাতে নানা বয়সের পূজারি। কারও হাতে সোলায় তৈরি পদ্মফুলের আকৃতি, কারও হাতে রঙিন কাগজে তৈরি নৌকা, মন্দির অথবা তারকার আকৃতি। সব কটিতে জ্বলছে একটি বা দুটি করে মোমবাতি ও ধূপকাঠি। সমগ্র পরিবেশকে সম্মোহিত করে প্রাঙ্গণে জ্বলছে গোটা তিনেক নৌকা। নৌকাগুলো কলাগাছে তৈরি। নরম বাকলে উপরে সারি দিয়ে জ্বলছে অসংখ্য মোমবাতি। পূজারিদের কেউ কেউ মন্দিরের চারদিকে চক্রাকারে ঘুরছেন। ঘুরে এসে সিঁড়িতে নতজানু হয়ে প্রণাম করে চলে যাচ্ছেন নদীর দিকে। আমরা ঘুমন্ত মেয়েটিকে কাঁধে নিয়ে তাদের অনুসরণ করি। নদীতে ভাসছে অজস্র আলোর মালা। আলো সব দুলে দুলে চলে যাচ্ছে দূর থেকে বহু দূরে। বাঁধানো ঘাট বেয়ে পূজারিরা হাতে আলোকিত পদ্মফুল বা নৌকা নিয়ে নীরবে নেমে যাচ্ছেন। নদীর জলের কাছে এসে ভাসমান ফানুসটিতে টাকা ও ফুল রেখে জলপ্রণাম করে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। আমরা তাদের সঙ্গে ঘাট ধরে নামি। সম্ভবত বিদেশি হওয়ার কারণে, অথবা আমার কাঁধে ফুটফুটে একটি ঘুমন্ত শিশু থাকার কারণে, সবার দৃষ্টি আমাদের দিকে। এক বৃদ্ধা পূজারি সোলায় তৈরি পদ্মফুলের আকৃতির একটি ফানুস আমাদের হাতে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজস্ব ভাষায় কিছু একটা বলেন। আমরা তাঁর ভাষা বুঝতে পারি না, কিন্তু আন্তরিকতাটুকু আমাদের ছুঁয়ে যায়। হলেন মোমবাতি ও ধূপকাঠিতে আগুন ধরায়। আমি পকেট থেকে লাও টাকা হাজার কিপের একটি নোট ফানুসে রাখি। হলেন বলে- ‘লেট্স উইশ্’। আমরা ফানুসটি ভাসাতে ভাসাতে প্রার্থনা করি- আবার যেন লুয়াংপ্রাবাংয়ে আসতে পারি।
mainussultan@hotmail.com
ছবি: লেখক