টেকসহি I প্রকৃত সত্য!
‘শতভাগ প্রাকৃতিক’ই কি সব সৌন্দর্য সমস্যার সমাধান? পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের ফলে খোদ পরিবেশেরই বারোটা বেজে যাচ্ছে না তো?
পরিবেশের উপাদানে পরিতৃপ্তি—এই ধারণা বেঁচে আছে যুগে যুগে। শুদ্ধতা যেন শুধু মাদার আর্থের দানেই প্রাপ্তি, কিন্তু সত্যিই কি তাই? ইকো ফ্রেন্ডলি বিউটি মুভমেন্টের মাধ্যমে প্রাকৃতিক উপাদানের প্রসাধনের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হয়েছে। ল্যাবে প্রস্তুত করা সিনথেটিক পণ্যের সঙ্গে প্রকৃতিপ্রদত্ত উপাদানের তুলনা করলে দ্বিতীয়টিতে ভরসা করে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি পাওয়া যাবে।
কেমিক্যাল কম্পাউন্ডে তৈরি সৌন্দর্যপণ্য ত্বকের জন্য ভালো নয়, উপকার হয় শুধু প্রাকৃতিক উপাদানে—এই প্রচলিত ধারণার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সেভাবে পাওয়া যায়নি। ত্বকের চাহিদা অনুযায়ী উপাদানে পণ্য উৎপাদন এবং ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলাই একটি প্রসাধন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হয়ে থাকে। তাই ল্যাবে তৈরি মানেই ক্ষতিকর—এমনটা না ভাবাই ভালো।
পি২ সায়েন্সের প্রধান নির্বাহী নেইল বারন্সের মতে, টেকসই প্রসাধন উপাদানের এর কোনো পুস্তকী ব্যাখ্যা নেই। এই বিষয়ে কাজ চললেও এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি বলে জানা যায় জিভডান লেবেলের সিনিয়র পারফিউমার স্টিফেন নিলসেনের ভাষ্যমতে। তিনি মনে করেন, মানুষ এখন নিজের মতো করে প্রসাধনের টেকসই তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা করে নিতে আগ্রহী। অনেকের ধারণা, পুনরায় ব্যবহার উপযোগিতা মানেই টেকসই পণ্য। আবার কারও কারও মতে, এগুলোতে পরিবেশ সুরক্ষার গুণ থাকা আবশ্যক। প্রসাধনের টেকসই তত্ত্বের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত মানুষ নিজের চাহিদা ও জ্ঞান অনুযায়ী নিয়ে থাকে বলে মত স্টিফেনের।
প্রকৃতিতে সৌন্দর্যচর্চার জন্য নানা উপাদান মেলে। কিন্তু তা মোটেই সীমাহীন নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসম্ভার সীমিত; বিশেষ করে যখন উৎপাদনের পরিমাণ বেশি হয়। তখন শুধু প্রাকৃতিক উপাদানে নির্ভরতা প্রকৃতির জন্য মোটেও সুখকর নয়। কারণ, বিপুল উৎপাদনে অনেক বেশি উপাদান প্রয়োজন হয়। সাধারণত প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত এবং এর মধ্যে অনেক উপাদান দ্রুত বর্ধনশীলও নয়। তাই উৎপাদনের তুলনায় এসব সম্পদ বেশি ব্যবহৃত হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
নেইল বারন্সের মতে, প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে সব সুগন্ধি তৈরি করা হলে অনেক জমির প্রয়োজন হবে। কিন্তু সে পরিমাণ শূন্য জমি বর্তমানে পৃথিবীতে নেই। ফলে কোনোভাবেই চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণ সুগন্ধি উৎপাদন সম্ভব হতো না। এ কারণেই সুগন্ধি উৎপাদনে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
কাস্টম হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ড ফাংশন অব বিউটির কো-ফাউন্ডার এবং সিইও জহির দোসা সরাসরি তার লেবেলের প্রসাধনের জন্য প্রাকৃতিক ও সিনথেটিক উপাদান বাছাইয়ে কাজ করেন। তার সমীক্ষা থেকে জানা যায়, এক পাউন্ড ল্যাভেন্ডার অয়েল তৈরির জন্য অন্তত ২৫০ পাউন্ড ল্যাভেন্ডার প্রয়োজন। একইভাবে ছোট একটি পুকুর সমান রোজ সুগন্ধি তৈরি করার জন্য প্রয়োজন অন্তত ১০ হাজার পাউন্ড গোলাপের পাপড়ি।
প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। এ কথা কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া চলবে না। প্রসাধনের টেকসই তত্ত্বের সংলাপে প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া কিছু প্রাকৃতিক উপকরণ আছে, যেগুলো উৎপাদন করলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। যেমন পাম অয়েল। এটি ব্যবহারের ফিডব্যাক ইতিবাচক। কোনো ক্ষতিকর দিক নেই বললেই চলে। শতভাগ পরিবেশবান্ধব ও টেকসই এই তেল। কিন্তু এর উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। হারিয়ে ফেলে নিজস্বতা। কেননা, যে জায়গাগুলো পাম অয়েলের বীজ বোনার কাজে ব্যবহৃত হয়, সেসব অঞ্চলের রেইন ফরেস্ট চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায়। ক্লিন বিউটি রিটেইলারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়া ডেভিসের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তার ভাষ্যে, পণ্য হিসেবে শতভাগ ইতিবাচক হলেও পাম অয়েল উৎপাদন সম্পন্ন হওয়ার পরে এর গাছগুলোকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পরিবেশ লম্বা সময় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
প্রাকৃতিক উপাদানের একটি অংশ রয়েছে সমুদ্রে। অ্যানিমেল বাই প্রডাক্টস ব্যবহার করেও বিভিন্ন সৌন্দর্যপণ্য তৈরি করা হয়। যেমন অ্যাম্বারগ্রিস। এটি মূলত তিমি থেকে পাওয়া যায়। তাই একসময় নীল তিমি শিকারের হার বেড়ে গিয়েছিল। পরে বিজ্ঞানীরা সিনথেটিক ব্যবহার করে এই উপাদানের একটি বিকল্প তৈরি করেন। ফলে তিমি নাশের একটি কারণ অন্তত কমে আসে।
প্রসাধন তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল প্রাকৃতিক হলে খুব কম সময়েই উপাদানটির সব অংশ প্রসাধন তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেকোনো একটি কিংবা দুটি অংশ ব্যবহৃত হয়। কখনো দরকার হয় পাতার, কখনো মূলের, কখনো ফুলের। অবশিষ্ট অংশটি আবর্জনা হয়ে পড়ে থাকে। আপসাইকেল পদ্ধতিতে এই সবুজ আবর্জনার যথাযথ ব্যবহারের বিষয়ে ভাবছেন বোদ্ধারা। পারফিউম তৈরির কাজে সংশ্লিষ্ট স্টিফেন বর্তমানে গ্রিন কেমেস্ট্রি নিয়ে কাজ করছেন। এ ধরনের উপকারী বর্জ্য ব্যবহার করে প্রসাধন তৈরির জন্যও কাজ হচ্ছে এখন। স্বল্প পরিমাণে উৎপন্ন করা হয় এসব পণ্য। অ্যাপেল অয়েল তৈরির জন্য সরাসরি আপেল ব্যবহৃত হয় না, বরং অ্যাপেল জুস বানানোর পর রয়ে যাওয়া ছিবড়ে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ বাই প্রডাক্ট ব্যবহারের মাধ্যমে তেলটি উৎপাদন করা হয়। স্টিফেন কয়েক বছর আগে কাজ করেছেন আখ নিয়ে। ফারমেন্টেশন পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে।
পরিবেশের ক্ষতি না করে স্বল্প খরচে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের পণ্য চান বেশির ভাগ মানুষ। এ ক্ষেত্রে ল্যাবে উৎপাদিত ফিউচারিস্টিক প্রসাধন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। কোনো পণ্য কেনার আগে জেনে নেওয়া যেতে পারে, এটি টেকসই তত্ত্ব মেনে তৈরি কি না। এ ধারণার বিষয়ে সচেতন ব্র্যান্ডগুলো সাধারণত তাদের প্যাকেজিংয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে থাকে। ক্রেতা নিজ তাগিদে খুঁজে নিয়ে পড়তে পারেন। আবার জেনে নেওয়া যায় ব্র্যান্ডটির রিটেইলারের কাছ থেকেও।
সাসটেইনেবল বিউটি রুটিন ব্যবহারের উদ্দেশ্য থাকলে প্রথমেই নিজের ত্বককে চিনে নিতে হবে। ত্বকের ধরন অনুযায়ী প্রসাধন নির্বাচন করতে হবে। সেই সঙ্গে মাথায় রাখা চাই, প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদানে তৈরি সৌন্দর্যপণ্য এ ক্ষেত্রে সব সময় বেস্ট অপশন না-ও হতে পারে। তার বদলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি অ্যাডভান্সড ফর্মুলার কোনো পণ্যেই মিলতে পারে পরিতুষ্টি।
সারাহ্ রুশমিতা
মডেল: জুয়েনা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: তানভীর খান