রসনাবিলাস I কাবাবের কারবারি গালৌতি
মূলত উত্তর ভারতীয়, পাকিস্তানি আর আফগানি তরিকার কাবাব আর কারির কারবার নিয়ে রাজধানীতে যাত্রা শুরু করেছে এক নতুন রেস্তোরাঁ। পরখ করে এসে লিখেছেন আল মারুফ রাসেল
লোকে বলে, লখনৌর নওয়াব ওয়াজিদ আলী শাহর দাঁত যখন বয়সের ভারে নড়বড়ে হয়ে চলেছে, তখনো নাকি তার মাংসপ্রীতি কমেনি। নবাবের দাঁতের পতন ঘটাবে, গোটা আওয়াধে কোন বাবুর্চির এমন বুকের পাটা? তাই গর্দান বাঁচাতে বাবুর্চিরা শাহি রসুইয়ে লেগে পড়লেন নিত্যনতুন ঘরানার কাবাব তৈরিতে। অবশ্য ইতিহাস ব্যাপারটা এমনই—গোপাল ভাঁড়, বীরবল আর এফেন্তি নাসিরের গল্প—কোনটা যে কার নামের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে, ঠাহর করা মুশকিল।
নওয়াব ওয়াজিদ আলী শাহ বিখ্যাত হয়েছিলেন শেষ আওয়াধি নওয়াব হিসেবে, কলকাতায় নির্বাসিত হওয়ার সুবাদে উত্তর ভারতীয় নানা পদের বাংলায়ন করার খাতিরে। আর তাই নানাবিধ কিসসা-কাহিনি তাকে জড়িয়ে। আদপে গালৌতি কাবাব তৈরিতে নওয়াব ওয়াজিদ আলী শাহ বা তার রকাবদারদের অবদান শূন্যের কাছাকাছি, এই কাবাবের পুরো কৃতিত্বই যায় কাবাবপ্রীতির জন্য বিখ্যাত নওয়াব আসাফ-উদ-দৌলার আংরাখার আস্তিনে। কাবাবপ্রিয় এই নবাবের বৃদ্ধকালেই তার হেঁসেলের সৈন্যদের এক অবিস্মরণীয় আবিষ্কার এই গালৌতি কাবাব। ‘গালৌতি’ শব্দের অর্থই হলো ‘যা মুখের ভেতরে গলে যায়’।
ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়ার মাজেজা এবার খোলাসা করা যাক। আওয়াধি ঘরানার গালৌতি, চাপলি, কাকোরি, তুন্ডে কাবাব এখনো লখনৌ, দিল্লি, কলকাতার রাস্তার দোকান থেকে পাঁচ তারার রেস্তোরাঁময় রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। ঢাকায় সে কাবাব চাক্ষুষ করা হয়নি, বা সেটাকে চর্ব্য, চোষ্য বা লেহ করার সুযোগটাও ঢাকার খুশখানেওলাদের নাগালের বাইরেই ছিল; কালেভদ্রে বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁর বিভিন্ন ফুড ফেস্টিভ্যালে এগুলো দর্শন দিত। তাই রেস্তোরাঁর নাম গালৌতি শুনলে অন্তত কাবাবপ্রেমীদের জিভে জল না আসাটা রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে ফেলে দেওয়া যেতে পারে! তাই দেরি না করে কাবাব চেখে দেখতে হাজির হওয়া গেল গুলশান ১ নম্বরে সদ্য গজানো রেস্তোরাঁ গালৌতিতে।
ভাদ্র মাসের অবোধ বৃষ্টি মাথায় করে এক দুপুরবেলায় হাজির হলাম গালৌতিতে। লিফট দিয়ে সোজা তেতলায়। অপারেশনস ম্যানেজার হাবিবুর রহমান সেখানে স্বাগত জানালেন। অবশ্য একটু বিচলিতও বোধ করলেন; কারণ, সেদিন রেস্টুরেন্টের বড় অংশজুড়ে ব্যক্তিগত পার্টির আয়োজন করেছিলেন এক তারকাশিল্পী। তাই রেস্তোরাঁর অন্দরসজ্জা অন্যদিনের চেয়ে একটু ভিন্ন ছিল। তবে এক পাশে নিয়মিত ভোজনরসিকদের বসার ব্যবস্থা ছিল। ম্যানেজারই জানালেন, গেল আগস্ট মাসের ১২ তারিখে যাত্রা শুরু করেছে এই কাবাব রেস্তোরাঁ।
আরামদায়ক অর্ধবৃত্তাকার সোফায় বসে রেস্তোরাঁর দিকে নজর দেওয়া গেল এরপর। সোফার পেছনে ফলস প্যাপিরাস, উইপিং ফিগ গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে। আয়নায় টাংস্টেন লাইটের প্রতিফলনে আলো-আঁধারি, সবুজ গাছ মিলে বেশ আরামদায়ক বসার আয়োজন। ম্যানেজার জানালেন, পুরো রেস্তোরাঁয় বসার আয়োজন প্রায় ৮০ জনের। লাইভ মিউজিকের ব্যবস্থাও রয়েছে। একটু পর ঢুঁ মেরে গেলেন এখানকার রসবতী সামলানোর দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানি শেফ মুহাম্মাদ আসিম খান। করাচিতে বেড়ে ওঠা এই তরুণের ঝুলিতে রয়েছে বিশ্বের নানান জায়গায় কাজ করার অভিজ্ঞতা। তিনিই জানালেন, এখানে মূলত উত্তর ভারতীয়, পাকিস্তানি আর আফগানি তরিকার কাবাব আর কারির কারবার।
কথা বলতে বলতেই টেবিলে এলো পাপড়ি চাট আর দাহি ফুচকা বা আমাদের জানাশোনা দই ফুচকা। এগুলো মূলত পরিবেশিত হয় বিকেলবেলায়, তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত—অফিস ফেরতা মানুষদের আড্ডার অনুষঙ্গ হিসেবে। আমরা অবশ্য খেলাম স্টার্টার হিসেবে। সাধারণত আমাদের এখানে যারা এগুলো পরিবেশন করেন, তারা মটরের ডাল দিয়ে অর্থাৎ চটপটির ডাল দিয়েই এগুলো করে থাকেন—সহজলভ্যতার কারণে। তবে এখানে উত্তর ভারতের সহজলভ্য কাবুলি ছোলা বা চিক পিজ আর ছোলা বা বেঙ্গল গ্রাম দিয়ে এই পদগুলো তৈরি করা হয়; ফলে স্বাদে খানিকটা ভিন্নতা চলে আসে। দুটোই খেতে বেশ ভালো—ঝাল-টক-মিষ্টির মিথস্ক্রিয়া পাকস্থলীকে খানিকটা প্রস্তুত করে তোলে পরের পর্বের জন্য।
মেইন কোর্স হিসেবে নেওয়া হলো হরিয়ালি কাবাব, ডাল মাখানি আর নান। হরিয়াল শব্দটা সংস্কৃত, যার অর্থ সবুজ। মূলত পুদিনা আর ধনেপাতার সবুজে সাজে মুরগির টুকরো, তাই এই নাম। অবশ্য এর স্বাদ বৃদ্ধিতে অন্য হার্বস, মসলার অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। পরিমিত ঝাল, দইয়ের মোলায়েম স্বাদ, পুদিনার শীতলতা মিলিয়ে হরিয়ালি কাবাব বেশ। কাবাবের সঙ্গে এসেছিল এক টুকরো করে আলু, আনারস আর টমেটো; খানিক লবণে জারিত পেঁয়াজকুচি; আর তেঁতুলের টক ও রসুন দেওয়া মেয়োনিজ। আনারস আর টমেটো আগুনে ঝলসে এলেও, আলুটা ভেজে বেক করা ছিল; গার্লিক মেয়ো লাগিয়ে খেতে মন্দ লাগেনি। কাবাবের সঙ্গে বাল্টি (বালতি বললে কৌলীন্যহানি হতে পারে, তাই ব্রিটিশ ঘরানার বাল্টিই বলি বরং) ভরা ডাল মাখানি ছিল। মজার ব্যাপার হলো, এই ডাল মাখানির ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। দেশভাগে দিল্লিতে এসে মোতি মহল নামের রেস্তোরাঁ খোলা কুন্দন লাল গুজরালের আবিষ্কার এই ডাল মাখানি, বাটার চিকেনের সঙ্গেই। উরাদ বা মাষকলাইয়ের ডাল দিয়ে মাখন-টমেটোর সঙ্গে রান্না হয় এই ডাল। খেতে মন্দ নয়, যদি সঙ্গী থাকে নরম তুলতুলে নান। রসুন, ধনেপাতা আর গাজর ছড়ানো নান দিয়ে পদগুলো যেকোনো মাপকাঠিতেই খেতে ‘উম্দা’। তবে যে বা যার আশায় গিয়েছিলাম, সেই গালৌতি কাবাব সেদিন রেস্তোরাঁয় দ্যুতি ছড়ায়নি; মানে সেদিন ছিল না। তাই খানাদানার মূল পর্বের সমাপ্তি এখানেই।
খানিক জিরিয়ে, কোমল পানীয়তে গলা ভিজিয়ে অপেক্ষা করার কিছুক্ষণ পরই হাজির হলো শেষপাতের মিষ্টিমুখ করার উপকরণ। কেসারি কুলফি আর শাহি টুকরা। সত্যি বলতে, এক হরিয়ালি কাবাব বা স্ট্রিট ফুড গোত্রের পাপড়ি চাট, দই ফুচকা খেয়ে তো শেফের মহিমা বোঝা দায়, সেই মহিমাটা মূলত পেলাম শাহি টুকরার ভেতর দিয়ে। দিল্লি-সিক্স বা জামা মসজিদে শাহি টুকরা খাওয়ার স্মৃতি একবার উঁকি দিয়ে গেল চামচে করে খানিকটা জিভে লাগার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই—সেই ঘ্রাণ, তবে স্বাদে আরও সূক্ষ্মতার ছোঁয়া। দিল্লিতে খাওয়া শাহি টুকরাকে যদি মিয়া কি তোড়ির আলাপ বলি, তবে এখানকারটাকে তুলনা দিতে হবে তিলক কামোদ রাগের আলাপের সঙ্গে। (একটু রাগসঙ্গীতের জ্ঞানও ঝেড়ে নিলাম আরকি! সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, মিয়া কি তোড়ির আলাপ শুরু হলে দুঃখবোধ ও দুশ্চিন্তা বাড়তে শুরু করে আর তিলক কামোদের আলাপ শুরু হলে মানসিক প্রশান্তি ও খুশিতে মন ভরে উঠতে থাকে)। কেসারি অর্থাৎ জাফরান কুলফিও ভালো ছিল, উত্তর ভারতীয় ঘরানার-স্বাদের।
গালৌতি থেকে বেরোলাম ঠিকই, তবে আরেকবার ঢুঁ মারার ইচ্ছে নিয়ে। গালৌতি কাবাবটাই যে অধরা রয়ে গেল এইবারে!
ঠিকানা: বাড়ি ৬০/এ, সড়ক ১৩১, গুলশান ১, ঢাকা ১২১২। ফোন: ০১৭৫৫-৬২১০৭৭।
ছবি: লেখক