টেকসহি I ব্যবহার বলয়
নভেম্বরের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার। ওয়ার্ল্ড ইউজাবিলিটি ডে। কী এর উদ্দেশ্য-বিধেয়?
ধরা যাক, একদিন বেশ রাত করে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ টের পেলেন, অচেনা কেউ আপনার পিছু নিয়েছে। সুনসান রাস্তা; জনমানবের দেখা নেই। উপায়ান্তর না দেখে ফোন করলেন ৯৯৯ নম্বরে। কিন্তু নম্বরটিতে ফোন করেই কি নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারবেন? নম্বরটি আপনার কতটুকু কাজে আসছে, তা এককথায় বোঝানোর জন্য আমরা এর ব্যবহারযোগ্যতা বা ইউজাবিলিটি নিয়ে আলোচনা করতে পারি। মজার বিষয় হলো, কোনো পণ্য কিংবা পরিষেবার ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে একটি বিশেষ দিবসও। বলছিলাম ওয়ার্ল্ড ইউজাবিলিটি ডের কথা।
প্রতিবছরের নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় ওয়ার্ল্ড ইউজাবিলিটি ডে। একে ‘মেক থিংস ইজিয়ার ডে’ও বলে। জাতিসংঘের ক্যালেন্ডারে তালিকাভুক্ত এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য পৃথিবীতে সহজভাবে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে কাজ করতে বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষকে একত্র করা। প্রতিবছরই ইউজাবিলিটি ডের জন্য একটি প্রতিপাদ্য বেছে নেওয়া হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমাদের স্বাস্থ্য’। ভার্চ্যুয়াল স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক ইলেকট্রনিক রেকর্ড এবং অন্যান্য ডিজিটাল স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত প্রযুক্তির ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা চলবে এবার। বর্তমান সময়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা, যেমন চিকিৎসার সহজলভ্যতা, চিকিৎসা ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরবেন বিশেষজ্ঞরা। এবারের ইউজাবিলিটি ডে পালিত হচ্ছে ১০ নভেম্বর।
ইউজাবিলিটি বা ব্যবহারযোগ্যতা আসলে কী? একজন ব্যক্তি কতটা দক্ষতার সঙ্গে এবং কার্যকরভাবে কোনো পণ্য কিংবা পরিষেবা ব্যবহার করতে পারেন, এবং ব্যবহারের পর সে প্রক্রিয়ার প্রতি কতটা সন্তুষ্ট—সবকিছু মিলিয়েই নির্ধারিত হয় পণ্য কিংবা পরিষেবার ব্যবহারযোগ্যতা। এবার আসুন, ফিরে যাই এ লেখার শুরুর ঘটনায়। দেশে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করা সবার অভিজ্ঞতা কিন্তু এক নয়। অনেকেই নম্বরটিতে ফোন করে উপকৃত হয়েছেন, আবার এমনও অনেকে আছেন, যাদের ফোন রিসিভ করা হয়নি। ইউজাবিলিটি ডে মূলত কাজ করে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা ঠিক কীভাবে উন্নত করা যায় তা নিয়ে।
২০০৫ সালে ইউজার এক্সপেরিয়েন্স প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশনের হাত ধরে যাত্রা শুরু দিবসটির। ১৯৯১ সালে ৫০ জন সদস্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এই অ্যাসোসিয়েশন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা বিষয়ে ধারণার প্রচার চালাচ্ছে তারা। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে একত্রে নিয়ে আসার জন্যও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন, জার্নাল অব ইউজাবিলিটি স্টাডিজ (জেইউএস), ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ম্যাগাজিন এবং ৩০টি দেশে ৫৯টি স্থানীয় অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম চালায় এই অ্যাসোসিয়েশন।
প্রশ্ন জাগতে পারে, এমন একটি দিবসের গোড়াপত্তন হলো কীভাবে? ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা নিয়ে সেই প্রাচীন গ্রিসের লোকেরাও ছিল তৎপর। এমনও প্রমাণ রয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর গোড়ার দিকে গ্রিকরা তাদের যন্ত্র এবং কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে ‘এরগনোমিক’ (আরামদায়কভাবে কাজ করা যায় এমন) ডিজাইন ব্যবহার করত। ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা বা ইউজার এক্সপেরিয়েন্সকে প্রথম একটি ডকুমেন্টেড ফর্ম দেন আমেরিকান শিল্প প্রকৌশলী হেনরি ড্রেফুস। ১৯৯৫ সালে তিনি ‘ডিজাইনিং ফর পিপল’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন। বইটিতে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতার নকশাকে সংক্ষেপে তুলে ধরেন হেনরি।
তবে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতার বিকাশে যে কেবল প্রকৌশলীরাই অবদান রেখেছেন, এমন নয়। ১৯৯৬ সালে ইউজার এক্সপেরিয়েন্সের প্রথম ডিজাইনারদের একজন হিসেবে সমাদৃত হন ওয়াল্ট ডিজনি। অবশ্য আধুনিক ইউজার এক্সপেরিয়েন্সের পথিকৃৎ বলা যায় ডোনাল্ড নরম্যানকে। পেশায় কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট ডোনাল্ড নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে অ্যাপলে যোগ দেন ইউজার এক্সপেরিয়েন্স আর্কিটেক্ট হিসেবে। তিনিই বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি, যার পেশায় ইউজার এক্সপেরিয়েন্স (সংক্ষেপে ইউএক্স) পদবি যুক্ত হয়। ‘ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ডিজাইন’ শব্দযুগলের প্রবর্তনও করেন ডোনাল্ড। ১৯৮৮ সালে তিনি ‘দ্য সাইকোলজি অব এভরিডে থিংস’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন, যা পরে ‘দ্য ডিজাইন অব এভরিডে থিংস’ নামে প্রকাশ পায়। ডিজাইনের অনেক ব্যবহারিক দিক, যেমন অ্যাফরডেন্স, সিগনিফায়ার, ফিডব্যাক ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে তার বইয়ে।
এ কথা সত্যি, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে উত্থান ঘটেছিল, তার বর্তমান রূপ আমাদের জীবনকে অনেকাংশে সহজ করেছে। সকালে ঘড়ির অ্যালার্মে ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা সর্বদাই কোনো না কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। কিন্তু এটিও সত্যি, প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, ততই তা ব্যবহারের জন্য জটিল হয়ে পড়ছে। বর্তমানে এমন কিছু প্রযুক্তিও বাজারে রয়েছে, যা সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে তা হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী! তাহলে ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ডিজাইনের জন্য কী কী বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে? চলুন, জেনে নেওয়া যাক ডোনাল্ড নরম্যানের কাছেই। ‘দ্য ডিজাইন অব এভরিডে থিংস’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘একটি ভালো মানের ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ডিজাইন তৈরির জন্য প্রথমে বুঝতে হবে মনোবিজ্ঞান। ভালো ডিজাইনের জন্য ভালো যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষ করে মেশিন ও ব্যবহারকারীর মধ্যকার যোগাযোগ প্রয়োজন। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি কোনো কিছু সহজে ব্যবহার করতে পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার ইউএক্স ডিজাইনের প্রয়োজন নেই। এই ডিজাইন মূলত প্রয়োজন হয় যখন আপনি কোনো কিছু ব্যবহারে অসুবিধার মুখোমুখি হবেন, তখনই। সমস্যা দেখা দিলেই প্রয়োজন হয় ইউএক্স ডিজাইনের।’
এ পর্যন্ত পড়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, এক দিনে কতটুকুই-বা তা করা সম্ভব! মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যে একটি দিনই যথেষ্ট, তার যথার্থ উদাহরণ হলো ১৯৭০ সালের আর্থ ডে বা ধরিত্রী দিবস। সে বছরই প্রথমবারের মতো একদল মানুষ পৃথিবী নামক এ গ্রহ যে পরিবেশগত সমস্যায় জর্জরিত, তা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে মাঠে নামে। সে সময় তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কিছু সংগঠন; যেমন দূষণকারী ও বিষাক্ত পদার্থ অপসারণকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে কাজ করা পরিবেশবাদী এবং বন্য প্রাণীর বিলুপ্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা দলগুলো। বেশ কিছু প্রতিকূলতা ও রাজনৈতিক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে ওই বছরের এপ্রিলে একত্র হয় দলগুলো। তাদের সে প্রচেষ্টা যে বিফলে যায়নি, তার প্রমাণ মেলে নব্বইয়ের দশকেই। ১৯৯০ সাল নাগাদ ১৪১টি দেশের ২০০ মিলিয়ন মানুষের এক বিশাল জনবল নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইভেন্টে পরিণত হয় ধরিত্রী দিবস। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে হওয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানা অধিবেশনও আদতে ধরিত্রী দিবসেরই এক যুগোপযোগী সংস্করণ। মাত্র এক দিনের একটি পদক্ষেপ বদলে দিয়েছে পরিবেশ নিয়ে মানুষের পুরো ধারণা।
এবারের ইউজাবিলিটি ডের বিষয়বস্তু যেহেতু স্বাস্থ্যসেবা, তাই আলোচনা হওয়া উচিত কীভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে এ সেবা পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিয়ে। তা ছাড়া স্বাস্থ্যসেবার মূল ব্যবহারকারী হলেন রোগী। অথচ এখনকার চিকিৎসাবিজ্ঞানের বেশির ভাগ সরঞ্জাম শুধু চিকিৎসকের কথা মাথায় রেখেই বানানো। এ ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ বলা যায় স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক রেকর্ডের ব্যবস্থা করা, যেখানে প্রত্যেক রোগীর চিকিৎসার ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকবে। যাতে করে তার চিকিৎসক উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি রোগীও নিজের স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকতে পারেন।
ইউজাবিলিটি ডে সফলভাবে পালনের জন্য তৃণমূল স্তরের মানুষকে সম্পৃক্তকারী ইভেন্টের পরিকল্পনা করা জরুরি। ব্যবহারযোগ্যতা শুধু সফটওয়্যার বা গেজেটের জটিল কোনো সমস্যা নয়; বরং এ গ্রহে বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার এটি। আপনি কত সহজে বাংলাদেশে বসে নিউইয়র্কে থাকা বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে পারছেন, এটিও প্রযুক্তির ব্যবহারযোগ্যতা নির্দেশ করে। ওয়ার্ল্ড ইউজাবিলিটি ডে পণ্যের বা সেবার ব্যবহারযোগ্যতা সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারা পরিবর্তনে সহায়তা করে। দিবসটি আমাদের এটা বুঝতে সাহায্য করে—কোনো একটি প্রযুক্তি আমাদেরকে যেভাবে দেওয়া হবে, সেটি যে ওই অবস্থায় ওই রূপেই ব্যবহার করতে হবে, এমনটি নয়। ওয়ার্ল্ড ইউজাবিলিটি ডে আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্য ও পরিষেবাগুলোকে এমনভাবে বিকাশের সুযোগ দেয়, যাতে সেগুলো আসলেই জীবনকে সহজ করার কাজে আসে।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট