ফিচার I ভাপে ভালো
তাপের চেয়ে ভাপে ভালো শীতের সবজি। পুষ্টিগুণ থাকে অটুট, বাঁচে সময় ও জ্বালানি। তবে সেদ্ধ করা চাই পরিমিত। অন্যথায় সব পুষ্টি ভেসে যাবে পানিতে। লিখেছেন আহমেদ সজিব
টাটকা সবজির পসরা নিয়ে আসে শীত। শুরুতে দাম বেশি থাকলেও শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমতে থাকে ঋতুভিত্তিক এসব সবজির। পৌষ-মাঘে তাজা সবজি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই এ ঋতুকে পুষ্টির ঋতু বললেও খুব ভুল বলা হবে না। তবে পুষ্টির বিনাশ হয়ে যেতে পারে রান্নার দোষে। অতি তাপে কিংবা বাড়তি মসলায় রান্না করলে সবজির পুষ্টি শরীরে কাজে না-ও লাগতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় সবজিগুলো পরিমিতভাবে সেদ্ধ করে খেলে। এতে তেল-মসলা যোগে রান্না করা পদের চেয়ে বেশি পুষ্টি অটুট থাকবে। হবে স্বাস্থ্যবান্ধবও।
শীতের বেশ কিছু সবজি ভাপে সেদ্ধ করে খাওয়া যেতে পারে। তার আগে জেনে নেওয়া যাক ভাপে সেদ্ধ করে খাওয়ার উপকারিতা। সবজিতে সাধারণত ফাইবার, ভিটামিন ও অন্যান্য খনিজ থাকে। এসব উপাদান ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, এমনকি ক্যানসার থেকেও সুরক্ষিত রাখতে পারে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়ায়। সামান্য লবণযোগে সেদ্ধ করলে এসব সবজির পদ বেশ সুস্বাদু হয়। লবণে বারণ থাকলে তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। সেদ্ধ করলে সবজি থেকে বিভিন্ন মাইক্রো অর্গানিজম বেরোয়। ফলে খাবারটি নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর হয়। সেদ্ধ সবজি অন্যান্য মসলার সঙ্গে না মেশার কারণে পুষ্টি অনেকটা অবিকৃতই থাকে। তা শরীরে সরাসরি পুষ্টি জোগাতে সক্ষম হয়। সেদ্ধ সবজি নিয়মিত খেলে হৃদরোগ, ক্যানসার, স্থূলতা ইত্যাদিসহ বিভিন্ন জটিলতা প্রতিরোধ হয়। তা ছাড়া ছোট ছোট রোগ দূরে থাকে। এতে শরীর চনমনে থাকায় কাজের আগ্রহ বাড়ে। জীবন উপভোগ্য হয়। সুস্থ শরীরের জন্য প্রয়োজন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তা মিলতে পারে সেদ্ধ সবজি থেকে।
ভাপে সবজির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বাড়ে, যা মানুষের শরীরে ঢুকে অক্সিডেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষতিকর অণুগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। এতে শরীর হয়ে ওঠে ভেতর থেকে সুস্থ। তা ছাড়া শরীরের প্রতিটি কোষ বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার উপযোগী হয়ে ওঠে। তখন আর খুব সহজে মানুষ রোগাক্রান্ত হয় না। রান্না করার চেয়ে ভাপে সেদ্ধ সবজিতে স্বাস্থ্যোপকারিতা বেশি, এটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও স্বীকৃত। সেদ্ধ সবজির সবচেয়ে বড় উপকারিতা হচ্ছে, এটি সহজপাচ্য। হজম হয় খুব সহজে। তাই স্থূল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সবজি খেতে খুব একটা বাধা থাকে না। অনেক সময় এটিই হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র ও নিয়মিত খাবার। তা ছাড়া যাদের মুখের সমস্যা, কিংবা বৃদ্ধ বয়সে দাঁত পড়ে গেলেও নিশ্চিন্তে খাওয়া যেতে পারে সবজি। শুধু সেদ্ধ করেও অনেক ধরনের স্যুপ তৈরি করা যায় বলে রোগীদের জন্য সেদ্ধ সবজি বেশ উপাদেয় খাবার হতে পারে। শিশুদের জন্যও একই কথা।তরুণেরা যদি তারুণ্যের শুরু থেকেই ভাপে সেদ্ধ সবজি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন, তবে সুস্থতার সঙ্গে দীর্ঘায়ু লাভের সম্ভাবনা বাড়বে। তা ছাড়া অসুখে পড়ার আশঙ্কা কমবে। এতে কর্মস্পৃহা ও উৎপাদনক্ষমতা বাড়বে, যা একটি উন্নত জাতি গঠনে অত্যাবশ্যক।
অনেকের ধারণা, সেদ্ধ সবজি মানেই স্বাদহীন। এ কথা একদম ঠিক নয়। আমরা যে চাটনি খাচ্ছি, তা কিন্তু সেদ্ধ টমেটোই। শিঙাড়ার ভেতরেও থাকে সেদ্ধ আলু। সেদ্ধ সবজি খাওয়ার আরেকটি উপকারিতা হলো, সময় বাঁচে। ঘড়ির কাঁটায় মুখ গুঁজে চলা নগরজীবনে সময়ের খুব অভাব। তাই অনেকেই ঝুঁকে পড়েন বাইরের খাবারে, কিংবা অর্ডার করে খাদ্য আনিয়ে খান। এ দুটির একটিও স্বাস্থ্যবান্ধব নয়। বরং ঘরে কিছু সবজি সেদ্ধ করে খেলে নিরাপদ খাবারের পাশাপাশি সময়ও বাঁচবে। এ ধরনের রান্না জ্বালানি সাশ্রয়ীও। তরকারি রান্না করতে যে পরিমাণ গ্যাস বা বিদ্যুৎ প্রয়োজন, সেদ্ধ সবজি তৈরিতে তার চেয়ে অনেক কম জ্বালানি লাগে। সবাই এ ধরনের খাবারে অভ্যস্ত হলে জাতীয় পর্যায়ে জ্বালানি অনেকটাই সাশ্রয় হবে। তা ছাড়া সেদ্ধ করতে তৈজসও লাগে কম। পাতিল ও পানি হলেই হয়। ফলে বেশি তৈজস এঁটো হয় না। পরে সেগুলো মাজতেও খুব বেশি সময় খরচ হয় না।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সমস্যা হলো স্থূলতা। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য—সব দেশেই এ সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। চর্বি এমন এক আপদ, যা অন্যান্য রোগ ডেকে আনে। তাই মেদ থেকে বাঁচতে সেদ্ধ সবজির বিকল্প খুব একটা নেই।
যাহোক, সেদ্ধ সবজি খাওয়ার মোক্ষম ঋতু হলো শীত। এ ঋতুতে হাতের কাছেই মিলবে তাজা ব্রকলি। এটি শীতের সুপারফুড। ভিটামিন সি, কে, আয়রন ও পটাশিয়ামের আধার। মেলে পর্যাপ্ত প্রোটিনও। ক্যানসাররোধী হিসেবেও এর কদর আছে। স্নায়ুর রোগ উপশমে তা খাওয়া যেতে পারে। হাড়ের সমস্যায় ভোগা রোগীরা নিয়মিত ব্রকলি খেলে উপকার পাবেন। কেননা এতে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম থাকে। বাজার থেকে ব্রকলি এনে ভালো করে ধুয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। কিছুটা বড় মাপের করে কাটলে পুষ্টি বজায় থাকবে। লবণযোগে সেদ্ধ করলে ব্যাকটেরিয়া দূর হবে দ্রুত। ফুটন্ত পানিতে ৩ থেকে ৫ মিনিট সেদ্ধ করতে বলে থাকেন অনেকে। প্রয়োজনে কিছুটা সময় বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে অতি সেদ্ধ করলে হিতে বিপরীত! সব পুষ্টি তখন চলে যাবে পানিতে।
শীতের আরেকটি মজাদার খাবার মটরশুঁটি। শিশুরা এটি খুব পছন্দ করে। লবণপানিতে সেদ্ধ করলে মটরশুঁটি খুব সুস্বাদু লাগে। তা ছাড়া সেদ্ধ মটরশুঁটি স্যালাড, তরকারি কিংবা পোলাওয়ে দিলে বাড়তি স্বাদ মেলে। পানিতে কমপক্ষে ছয় মিনিট সেদ্ধ করার পর মটরশুঁটি খাওয়ার উপযোগী হয়। ডায়াবেটিস রোগীরাও এটি খেতে পারেন।
ব্রকলির মতোই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু আরেকটি শীতের সবজি ফুলকপি। রান্নার চেয়ে ভাপে খেলেই এটি থেকে বেশি পুষ্টি মেলে। এটি হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে। অবশ্য এ সময়ের সবচেয়ে বেশি উপকারী সবজিটি হলো বাঁধাকপি। যারা ডায়েট করেন, তাদের জন্য এটি বেশ উপাদেয়। বিশেষ করে সেদ্ধ বাঁধাকপি দিয়ে তৈরি স্যুপ তাদের বেশ পছন্দের। যেকোনো ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধে এটি বিশেষ কার্যকর। খেয়াল রাখতে হবে, বাঁধাকপি যেন বেশি কুচি করা না হয়। বেশি সেদ্ধও করা যাবে না। অন্যথায় এটি থেকে কোনো পুষ্টিই মিলবে না।
শীতের আরেকটি পুষ্টিকর সবজি গাজর। কাঁচা খাওয়া যায়; তবে সেদ্ধ করে খাওয়া ভালো। সামান্য লবণ ও মরিচ মিশিয়ে খেলে এর স্বাদ আরও খুলবে। চোখের রোগ, মানসিক সমস্যা এমনকিই ক্যানসার নিরাময়ের দাওয়াই রয়েছে গাজরে।
ছবি: ইন্টারনেট