ছুটিরঘণ্টা I সিন সিটি সিনারিও
লাস ভেগাস। কেউ কেউ বলে ‘পাপের শহর’! পরতে পরতে জীবন উপভোগের রূপ-রস-গন্ধ ছড়ানো। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
স্টেশনে বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, এ শহরে রাতে বাস ছাড়ার শেষ সময় কয়টা? ড্রাইভার বিশালদেহী কৃষ্ণাঙ্গ। প্রশ্ন শুনে বেশ বিরক্ত। নির্লিপ্তভাবে বললেন, ‘এ শহরে শেষ সময় বলে কিছু নেই। দিন-রাত সব সময়ই বাস চলে।’ আমেরিকার যত শহরে ঘুরেছি, সবখানেই রাতের একটা সময়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ হয়ে যায়। এ শহর ব্যতিক্রম। ভাইকে ফোন করে জানালাম কথাটা। ভাই বলল, ‘হবে না? সারা রাত ক্যাসিনো খেলে বাড়িতে বা হোটেলে ফিরতে হয় তো ওই শহরের মানুষদের।’ শহরের নাম লাস ভেগাস। এখানে আসছি জেনে আমেরিকায় বসবাস করা ভাইবোনেরা খুব খুশি। ভেবেছিল, এবার বুঝি পাহাড়-জঙ্গল ছেড়ে ‘ভদ্রলোকের’ জায়গায় গিয়ে কিছুটা শহুরে আদবকেতা শিখব। টাকাপয়সার হিসাব বুঝব। আমি মনে মনে হাসি, এদের ধারণা একদম ভুল!
আমার হোটেলটা অনলাইনে খুঁজে ডাউনটাউন থেকে একটু দূরে নিয়েছি। সারা দিন স্ট্রিট কিংবা স্টেজ শো হয় না এ শহরে; সন্ধ্যে থেকে জমে ওঠে আসর। এখানে বাস করা মানুষগুলো কেমন? এই ভেবে উত্তর লাস ভেগাসে হোটেল নিয়েছি। বাস থেকে নামলাম হোটেলের সামনেই। কিন্তু হোটেল কোথায়, এ তো মরুভূমি! বিশাল হাইওয়ে, একটা সুপারশপ আর একটা গ্যাস স্টেশন ছাড়া কিছুই নজরে আসছে না। এমন ধোঁকাও হয় মানুষের সঙ্গে? আশপাশে কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করব।
একটু এগিয়ে দেখি, রাস্তার অপর পাশে এক কোনায় হোটেলের বোর্ড। হোটেলটা নেহাত ছোট নয়; কিন্তু হাইওয়ে এতই প্রশস্ত, অন্য কিছু চোখে পড়ে না। এখন দুপুর হতে চলল। হোটেলের লবিতে কেউ নেই। বেল বাজিয়ে রিসেপশনিস্টকে ডেকে আনলাম। রুমের কার্ড বুঝে নেওয়ার পর মনে হলো, এই হোটেলে আমি ছাড়া কেউ নেই; সুনসান সব। বাইরের তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভেতরে অবশ্য বোঝার উপায় নেই। আশপাশে কোনো রেস্তোরাঁ বা টেক অ্যাওয়ে নেই যে খাবার খাব। হোটেলেও রুম সার্ভিসের আশা নেই। যে ভুতুড়ে হোটেল, কে জানে আগামী কয়েক দিন কারও দেখা পাব কি না! অগত্যা সুপারশপই ভরসা। বাইরে বেরোতেই গায়ে লু হাওয়ার হলকা লাগল। সুপারশপে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পুড়ে যাবার জোগাড়। বোস্টন শহর থেকে এসেছি, সেখানে এখন গ্রীষ্মকাল হলেও মাঝে মাঝেই হালকা জ্যাকেট বা সোয়েটার পরতে হয়।
এই ধু ধু মরুভূমিতে এক বিশাল সুপারশপ আর তার ভেতরে ক্রেতার সমাগম দেখে অবাক হলাম। ভেবেছিলাম, এ শহরে কেউ থাকে না। থাকে অবশ্যই, গরমের কারণে বের হতে পারে না। এরা তো আর আমাদের মতো হেঁটে বাজারে যায় না। প্রায় সবার গাড়ি আছে। প্রত্যেক সুপারশপের সামনে বিশাল পার্কিং ব্যবস্থা। এসব সুপারশপের যা আমার ভালো লাগে, তা হলো বিভিন্ন ধরনের ফ্রোজেন ফুড এবং স্যালাড পাওয়া যায়। আশপাশে রেস্তোরাঁ না থাকলেও চিন্তা নেই। হোটেল রুমে গিয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে গরম করে খেলে পেট নামক বস্তুটি আর বিরক্ত করবে না!
লাস ভেগাসকে বলা হয় ‘সিন সিটি’ বা পাপের শহর। জুয়া খেলা, বিভিন্ন স্টেজ শো উপভোগ করা, নানান পানীয়ের স্বাদে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়া বা আরও বেশি কিছু। লাস ভেগাসে মানুষ শুধু ক্যাসিনো খেলতে বা বিশেষ সঙ্গী-সান্নিধ্য নিতে আসে না। বিনোদনের উদ্দেশ্যে আমেরিকায় নির্মিত অন্যান্য শহরের মতো এখানকার হোটেলগুলোতেও ব্যাপক মাত্রায় রয়েছে বিনোদন ব্যবস্থা। তবে আমি আজ রাস্তায় ঘুরব। বেলা পড়ে আসবে ভাবি; কিন্তু গ্রীষ্মকালে এসব শহরে সূয্যি মামা ডোবে নয়টার দিকে। তাই রাত শুরু হয় দেরিতে, আর রাতের জোয়ার বয় পরদিন সূয্যি মামা জাগা অবধি। লাস ভেগাসে এ এক অমোঘ নীতি।
বিকেল পাঁচটায় হোটেল থেকে বেরিয়েও দেখি সূর্য গনগন করছে। বাস ধরে চলে এলাম ফ্রিমন্ট স্ট্রিটের কাছের বাস স্টপেজে। দুনিয়ার অন্যতম বড় ও আধুনিক হোটেলগুলো জায়গা করে নিয়েছে বোধ করি এ শহরে। বাসে আসতে আসতে এক হোটেলের সামনে দেখি লেখা, ‘এলভিস প্রিসলি এখানে থেকেছেন’। বাস থেকে নেমে কয়েকটা ব্লক পার হলে গির্জা। তার সামনে বিয়ে-শাদির বন্দনা করে চয়ন লেখা। বাহ্, বিয়ে করার জন্যও এখানে গির্জা থেকে তোষামোদ করা হয়! খানিক হাঁটার পর দেখি ডিভোর্স উকিলের বিশাল অফিস। একটা-দুটো নয়, সারি সারি। নিউইয়র্কের ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্টের ব্যাংক বা ফিন্যান্স অফিসের মতো এখানে ডিভোর্স উকিলের সুউচ্চ দালান। আমার তো মজাই লাগছে। প্রথমে আদর করে ডেকে নিয়ে বিয়ে করাবে, তারপর আরও তোয়াজ করে নিয়ে ডিভোর্স করাবে। হায় মগের মুল্লুক! এ লাস ভেগাসেই সম্ভব। এখানে আসলে ডিভোর্স পাওয়া আমেরিকার অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে সহজ। সর্বনিম্ন দশ দিনের মধ্যে নাকি ডিভোর্স পাওয়া যায়। তাই লাস ভেগাসে বিবাহ-বিবাহ খেলা যায় অতি সহজেই! অনেকে বাইরের রাজ্য থেকে এসেও ক্যাসিনোর মতো এই খেলা খেলেন।
সিন সিটি এখনো পুরোটাই দেখা বাকি। এখানকার ডাউনটাউন আলিশান বড় বড়, উঁচু হোটেলে ঠাসা। হোটেলগুলো আলোয় মোড়া। আলো জ্বালবে সন্ধ্যের সময়। তবু একটু একটু চোখে পড়ছে। ফ্রিমন্ট স্ট্রিটের যতই কাছে যাচ্ছি, ততই বড় বড় হোটেলের ক্যাসিনোগুলো নিকটতম হচ্ছে। ভেতরে লাল-নীল-সোনালি বাতি জ্বলে ঝলমল করছে। ফ্রিমন্ট স্ট্রিট আসলে একটি রাস্তা, যেখানে এক মাথা থেকে আরেক মাথা অবধি ছাদ করে দেওয়া আছে। সেই গোলাকার ছাদে রাত-দিন লম্বা একটি স্ক্রিনে রঙিন সব আলো ও নকশা খেলা করছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। আলোয়, বাজনায় মাতামাতি করছে সব। এই স্ট্রিটের দুপাশে ক্যাসিনোর অবারিত খোলা দ্বার, একটু বাদেই ভিড় বাড়বে। ফ্রিমন্ট স্ট্রিটও অবশ্য ধীরে ধীরে জনাকীর্ণ হচ্ছে। সাধারণ দর্শক, ক্যাসিনোপ্রেমী, মদ্যপ্রেমীর পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের জন্য জনসাধারণের মনোরঞ্জন করতে আসা বিভিন্ন নারী-পুরুষ এতক্ষণে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। জোড়ায় জোড়ায় রূপসীরা অনাবৃত বদনে শুধু উঁচু হিলের জুতো আর মাথায় প্রমাণ আকারের পালকের মুকুট পরে আগতদের আকর্ষণ করছেন তাদের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য। সুদর্শন পুরুষেরাও স্বল্প পোশাকে একই কাজ করছেন। ছবি তুললেই ডলার দিতে হবে এদের। খোলা রাস্তায় বিনোদন এটুকুই।
আজ শনিবার, তাই ভিড় অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি। দর্শনার্থীদের জন্য ফ্রিমন্ট স্ট্রিটের কোনায় কোনায় স্টেজ করা। সেখানে গান গাইছেন এ যুগের এলভিস প্রিসলি। খানিক দূরে অন্য স্টেজে গান গাইতে গাইতে লাফাচ্ছে কয়েকটি ছেলেমেয়ে। তাদের সঙ্গে তালে তালে নাচছে এই উন্মুক্ত শো দেখতে আসা ছেলেমেয়েরা। এখন আরও ভিড় বেড়েছে। এত গানবাজনা, পথে পথে এত আমুদে পরিবেশ অন্য কোথাও আর নেই। নাচগানের সঙ্গে সঙ্গে আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে ফ্রিমন্ট স্ট্রিট। আরও রঙিন, আরও মোহময় আলো ছড়াচ্ছে ছাদের চাঁদোয়া।
এই স্ট্রিটের দুপাশে সারি সারি সব ক্যাসিনোতে জমে উঠেছে খেলা। যে কেউ ইচ্ছে করলেই ঢুঁ মারতে পারে। গোল্ডেন নাগেট নামের বিখ্যাত ক্যাসিনোর ভেতরের সুন্দরী, স্বল্পবসনা ওয়েটার আমায় তখন হাতছানি দিচ্ছেন, বসতে বলছেন পছন্দসই কোনো এক গেমের টেবিলে, মদিরা সাধছেন। কিন্তু আফসোস! না আমি ক্যাসিনো খেলি কিংবা খেলতে জানি, না মদিরায় আসক্ত। আমি তো শুধু দেখতে এসেছি এখানে কীভাবে ক্যাসিনোতে খেলা হয়। জনপ্রিয় কিছু গেম হলো—ব্ল্যাকজ্যাক, স্লট মেশিন, রোলেট, ক্র্যাপস, পোকার ইত্যাদি। কোনোটা বিশাল লম্বা স্ক্রিনের সামনে বসে খেলতে হয়, কোনোটা তাস খেলার মতো পার্টনার সঙ্গে নিয়ে, কোনোটা-বা টেবিলের ওপর চাকা ঘুরিয়ে হারজিত নির্ধারণ করে। ক্যাসিনোর ভেতরে ভিড় বাড়ছে। সারা রাত খেলা চলবে। তারপর কেউ জিতে, কেউ হেরে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরবেন। আবার খেলা জমে উঠবে পরদিন বিকেল থেকে। সকালে বা দুপুরে ফ্রিমন্ট স্ট্রিটে থাকে সুনসান নীরবতা।
লাস ভেগাসের আরেক আকর্ষণ স্ট্রিপ নামের একটি এলাকা, যেখানে রয়েছে বিখ্যাত সব হোটেল। এসব হোটেলের লবি কিংবা ক্যাসিনোতে ঢুকতে অনুমতির প্রয়োজন পড়ে না। একেক হোটেলের একেক নাম ও থিম। পরদিন দুপুরের পর আমি স্ট্রিপে ঘোরাঘুরি করার ঘোষণা দিলাম নিজেই নিজেকে। কারণ, যেখানে থাকি, সে এক ভুতুড়ে হোটেল! কেউ নেই। পাশে আরেকটা ছোটখাটো সুপারশপ আবিষ্কার করলাম, যেখানে অল্পস্বল্প রেডিমেইড খাবার, যেমন পিৎজা, স্যান্ডউইচ পাওয়া যায়। সুপারশপে ঢুকেই দেখি ক্যাসিনো মেশিন। মানে, বাজার করার আগে ভাগ্যের সঙ্গে খেলে পয়সা লুটাও বা জুটাও! একটুও অবাক হইনি। এখানকার এয়ারপোর্টে পা রেখেই ক্যাসিনো মেশিনের মুখ দর্শন করেছিলাম প্রথম। তখন অবশ্য তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম। প্লেন সফরের পরই জুয়া খেলার আসরে বসে যাও! এ হলো লাস ভেগাস। এমনই তো হবার কথা।
খাবার কেনায় মনোযোগ দিলাম আমি। বিলের কাউন্টারে আমার আগে পরে সবাই ছিলেন স্থানীয় এবং বেশ বন্ধুবৎসল। আমার ক্যাসিনো খেলার অজ্ঞতা নিয়ে কিছুটা হাসিঠাট্টা করলেন; এই অজ্ঞতা নিয়ে আমারও আনন্দের শেষ নেই! বোধ করি এ শহরের ছেলেবুড়ো সবাই ক্যাসিনো খেলে। বিকেলের আগেভাগেই চলে গেলাম স্ট্রিপে। সারি সারি পাঁচ তারকা হোটেল। একেক হোটেলে নামের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে থিম। এই যেমন, মিসরের পিরামিডের আকারে নির্মিত হোটেলের নাম লুক্সর, ভেনিস শহরের আদলে গড়া হোটেলের নাম ভেনিশিয়ান। সেন্ট্রাল থেকে স্ট্রিপে যাওয়ার বাসগুলো প্রতিটি বড় হোটেলের সামনে থামে। স্ট্রিপের প্রথমেই ট্রেজার আইল্যান্ড হোটেল। হোটেলের বাইরে জলদস্যুর জাহাজেরআদলে গড়া প্রমাণ আকারের ভাস্কর্য, সে জাহাজে দস্যুরা দাঁড়িয়ে, আশপাশে জল উছলে পড়ছে।
একেকটা হোটেল এত বড়, ভেতরে না ঢুকে বাইরে হাঁটলেই অনেকখানি দেখা যায়, আর অনেকটা পথ হাঁটতে হয় ভেতরে। কোনো হোটেলেরই লবি, রেস্তোরাঁ, ক্যাসিনো, শপিং মলে ঢুকে ঘুরে বেড়াতে নেই মানা। পরের হোটেলের নাম মারাজ বা মিরেজ। এর সামনের জলাধার থেকে লবি অবধি যেতেই দশ মিনিট লেগে যায়। ক্যাসিনোর জন্য এর বেশ নামডাক। এখানকার ক্যাসিনোতে এহেন খেলা নেই, যা খেলা হয় না। আমি ক্যাসিনোর ব্যাপারে অজ্ঞতা ঢাকার জন্য জলাধারের আশপাশে ঘুরঘুর করছি। এই নীল জলাধার আসল জলাধারকেও যেন হার মানায়। এক কোনা দিয়ে পাহাড়ের মতো তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ঝরনার জল গড়িয়ে পড়ছে নিচের সারি সারি জলাধারে। এ এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। জলাধারের কোনা দিয়ে পাম গাছ দিচ্ছে হাওয়া। এই হোটেলের শপিং মল বিরাট; সুইমিংপুল এলাকাও বিশাল। কোনোটা রেস্তোরাঁর ধারে, কোনোটা আবার শুধুই হোটেলে থাকতে আসা অতিথিদের জন্য। আর রাতে এদের অডিটরিয়ামে বিভিন্ন জাদুবিদ্যা, সার্কাস ইত্যাদির শো হয়। জলাধারে হয় ভলকানো শো। এই শো কারোর মিস করতে নেই। নাইটক্লাবও অতিকায় এদের। বাইরের যে কেউ এসে এখানে উপভোগ করতে পারেন। এত কিছু দেখে আমার হাঁপিয়ে ওঠার জোগাড়। মাত্র দুটো হোটেল দেখেই এই দশা!
পাশের হোটেল বেলাজিও। এর কথা অনেকের মুখে শুনেছি। এই হোটেলের শপিং মল এতই বিশাল, দোকানগুলোর শেষে যে লবি আছে, তা ভুলে যেতে হয়! আর দোকানগুলোও আমেরিকার বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের। লবিও দেখার মতো বিশালাকৃতির। ক্রিস্টালের বিরাট ঝাড়বাতি ঝুলছে মাঝখানে। সেখান থেকে ক্যাসিনো, তা পার হলে লম্বা করিডরে হাঁটতে থাকা, তারপর রেস্তোরাঁ আর শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর গ্যালারি। লাস ভেগাস যে শুধু জুয়া খেলা, মদিরা আর বিশেষ সঙ্গীসঙ্গের শহর নয়, তা এতক্ষণে বোঝা হয়ে গেছে। এদের রুচি ও শিল্পবোধ এমনভাবে ঢেলে দিয়েছে হোটেলগুলোতে, যা অন্য কোনো শহরে আমি দেখিনি। সেখান থেকে বের হওয়া যায় সুইমিংপুল পার হয়ে। এই হোটেলে সুইমিংপুলই আছে ছয়টি। আকার চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এখানকার মূল আকর্ষণ কনজারভেটরি। খোদা মালুম আর কত হাঁটতে হবে! একেকটা হোটেল দেখতে গেলে দিন পার হয়ে যাবে যেন।
কনজারভেটরিতে আছে বিশাল ফুলের বাগান, যা চব্বিশ ঘণ্টা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। নানা রঙের ফুল হাসছে নানান আকারের ইতালীয় স্থাপনার মাঝখান দিয়ে। ইতালির শহর বেলাজিওর নামে এই হোটেলের নামকরণ। সে শহর বিখ্যাত জলাধার আর ফুলবাগানের জন্য। কিছু চিহ্ন থাকবেই হোটেলে সে স্থানের স্মৃতিতে। আর বাইরে রাস্তার ধারে হোটেল মারাজের মতো লেক। এদের লেকে পানির ফোয়ারা। প্রতি ঘণ্টায় জলকেলির শো হয়; ফোয়ারা তখন হয়ে যায় কখনো জাদু, কখনো খিলখিল করে হেসে ওঠা কিশোরী! জলের খেলা চলে বিভিন্ন কায়দায় রাতেও; সঙ্গে থাকে আলোর ঝরনাধারা। জলের ফোয়ারার খেলা দেখতে গিয়ে রাস্তার অপর পাশে দেখি আইফেল টাওয়ার। যেন প্যারিস খোদ এখানে উড়ে নেমে এসেছে। সেখানে যাওয়ার আগে পাশের হোটেলে যাওয়া বাধ্যতামূলক। কারণ, তা হোটেল বলে মোটেই মনে হচ্ছে না। এ যেন প্রাচীন রোম নগরী ও তার ঐশ্বর্য। সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নগরী। হোটেলের নাম তাই সিজারস প্যালেস। পুরো পথজুড়ে রোমান পুরাণের নানান ভাস্কর্য ছড়িয়ে রয়েছে। এসব দেখে আমার কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে রোমে চলে এসেছি। শপিং মল দেখে আনন্দে আত্মহারা হবার জোগাড়। সেই প্রাচীন রোম, সেই ট্রেভি ফাউন্টেন এখানে আমার সামনে; একই আকার, একই সবকিছু। এই জলাধারের ভবনটিকে হোটেল কর্তৃপক্ষ শপিং মল বানিয়েছে। ভবনের ভেতরে আরও বিস্ময়, জাদুঘরের মতো সব দোকান। যেন সম্রাট জুলিয়াস সিজার এইমাত্র ঘুরে গেলেন!
সুইমিংপুলের চারপাশে কোরেন্থিয়ান ধাঁচের স্তম্ভ। জায়গায় জায়গায় রোমান দেব-দেবীর সাদা ধবধবে ভাস্কর্য আধেক ডুবে আছে জলে। কোনো একটা কক্ষ বা পরিবেশ দেখে মনে হবে না লাস ভেগাসে আছি। পিয়েতা, ডেভিড, অ্যাপোলো, মোজেস—কোন ভাস্কর্য নেই এই উদ্যানে! এ স্বর্গের মতো সুন্দর নগরী; মার্জিত, সুরুচিপূর্ণ। রেস্তোরাঁ দেখে আমি ঘোরে চলে গেলাম। পঙ্খিরাজ, দেব-দেবীর মাঝখানে পাথরের ব্লকের তৈরি পথ, যেন এক্ষুনি উড়ে যাবে পঙ্খিরাজ দেবীকে নিয়ে আর তা দেখব রাতের খাবার খেতে খেতে!
সিজারস প্যালেসের অডিটরিয়াম এখানকার সব হোটেলের মাঝে বড়। আর নামীদামি শিল্পী যেমন সেলিন ডিওন, শিনায়া এখানে শো করেছেন। এই অডিটরিয়ামের নাম কলোসিয়াম। বসার ব্যবস্থা রোমান কলোসিয়ামের মতো গোলাকার। মূল হোটেল প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে হোটেলের চ্যাপেল, যেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়; এ যেন আড়ম্বরপূর্ণ রোমান নগরীর আরেক হীরকখণ্ড। বিশাল ছায়াঘন বাগানের মাঝে নানা দেব-দেবীর ভাস্কর্য আর সামনে চ্যাপেল বা রোমান স্থাপত্যশিল্পে নির্মিত ছোট আকারের গির্জা। সিজারস প্যালেসের এই জায়গা আমার সবচেয়ে বেশি মনে ধরেছে। এত শুভ্র, সৌম্য যে বাইরের সবকিছু হার মানে।
এখন আমাকে যেতে হবে প্যারিস স্ট্রিট পার হয়ে। পথে-ঘাটেও ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে ভিন্ন মানুষ। কেউ মিকি মাউস, কেউবা এসকর্টের পোশাকে জনসাধারণকে আকৃষ্ট করছেন তাদের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য। আইফেল টাওয়ার ধরে লবির দিকের পুরো পথটাই প্যারিসের বিভিন্ন স্থাপনা দিয়ে সাজানো। এক পাশে আর্ক দি ট্রাম্প আর সোজা লবিতে এক অপার সৌন্দর্য। লবির ছাদে আকাশ বাস করে; মানে পুরো ছাদটাই আকাশের মতো নীল আর সাদা মেঘে ঢাকা, সে রকম রং করা। শপিং মল, ক্যাসিনো আর রেস্তোরাঁর দিকের পথগুলো প্যারিসের অলিগলির মতো; সারি সারি পাথরের ব্লকের বাড়ি, বাড়ির সামনে ফুলের গাছ, পথের মাঝে দিকনির্দেশক চিহ্ন, সবকিছু ফরাসি ভাষায় লেখা। বোঝার উপায় নেই কোথায় আছি। ভেতরকার আসবাব প্রাসাদের মতো রাজকীয়।
প্যারিসের অসীম রাজত্ব দেখে হাঁটতে থাকলাম ভেনিশিয়ান হোটেলের দিকে। হোটেল মারাজ কিংবা বেলাজিওর মতোই এর সামনে জলাধার; তবে ভেনিস শহরের আদলে গড়া। সেখানে ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানেলের মতো করে নির্মিত নীল জলের ওপর গন্ডোলা বা নৌকা চালিয়ে ইতালিয়ান ভাষার গান গাইছেন মাঝি। ক্যানেলের এক পাশে সারি সারি দোকান, পেছনে প্রাসাদসম কারুকার্য খচিত হোটেল। হোটেলের লবিতে ক্যাসিনো; তবে তার চেয়েও আকর্ষণীয় হলো লবির ছাদের চিত্রকর্ম। রেনেসাঁর উল্লেখযোগ্য সব চিত্রকর্ম ছাদজুড়ে ছড়িয়ে আছে, আর প্রতিটি চিত্রকর্মকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সোনালি কারুকাজের ফ্রেম। এ এক চমক আর জমকালো ব্যাপার। এটি লাস ভেগাসের সবচেয়ে বড় ও জমকালো হোটেল। ভেতরে নাইটক্লাব, রেস্তোরাঁ, পানশালার সঙ্গে স্থানীয় মাদাম তুসো মিউজিয়ামও আছে।
দোতলার বারান্দা থেকে অপর পাশে হোটেল মারাজের জলাধার দেখা যায়। এই হোটেলেও জৌলুশের কমতি নেই। যেদিকে চোখ যায়, কারুকাজ আর কারুকাজ। অবশ্য আমাকে এখন যেতে হবে মারাজের ভলকানো শো দেখতে। দোতলা থেকে দেখতে পাচ্ছি, হোটেলের সামনের জলাধারের ভেতর থেকে আগুনের হলকা বের হচ্ছে। আর বেলাজিও তো সন্ধ্যে হলেই ফাউন্টেন থেকে আলোর আতশবাজি ছোটায়। এরপর সিজারস প্যালেসে হবে কনসার্ট। এসব না দেখলে জীবন বৃথা!
লাস ভেগাস জেগে ওঠে রাতে। রাত যত বাড়ে, এর রূপ ততই খোলে। এ রকম নানান রঙের দিন আর রাত দেখার জন্য এই শহরের তুলনা নেই।
ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট