ফিচার I একান্ত একা
মি টাইম। নিজেকেই নিজে একান্ত সময় দেওয়া। এই ধারণার সঙ্গে অনেক নারীই পরিচিত নন। অনেকে পরিচিত হলেও অভ্যস্ত নন। আবার অভ্যস্ত হলেও মেলাতে পারেন না সময়। অথচ এ ভীষণ দরকারি
শুরুতেই দুটি উদাহরণে নজর দেওয়া যাক। নামগুলো ছদ্ম হলেও ঘটনা কাল্পনিক নয়। প্রথমে রয়েছেন জাহান আরা। ষাটের কোঠা পেরিয়েছেন বেশ আগে। ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। অবসরের পর থেকে সময় যেন কাটতেই চায় না তার। সন্তানেরা যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে বই পড়ে আর ছাদবাগান দেখাশোনা করেই কাটে সময়। ‘চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে তো কোনো অবকাশই পাইনি। অফিস আর ঘর সামলে নিজের জন্য সময় বাঁচত না। আর এখন এই অফুরন্ত সময় যেন কাটতেই চায় না,’ বলছিলেন তিনি।
এবার বলছি দিবার কথা। ঢাকার একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়েন; পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরিও করছেন। ব্যস্ত এ জীবনে নিজের সঙ্গে কাটানোর মতো সময় তার নেই। বলেন, ‘আমি আসলে ছোটবেলা থেকেই একদম রুটিন মেনে চলি। একটা সময় ছবি আঁকতাম, বই পড়তাম। এখন ব্যস্ততা, সঙ্গে ঢাকার এই যানজটে ভরা জীবনে আলাদা করে নিজের জন্য সময় মেলা দায়।’
শত কর্মব্যস্ততার ভিড়েও একজন নারীর যে নিজের জন্য একান্ত কিছু সময় প্রয়োজন, সেদিকে আসলে নজর দেওয়া হয় খুব কম। এমনকি নারীর এই একান্ত সময় কিংবা ‘মি টাইম’ নিয়ে প্রচার, গবেষণাও নেই তেমন। অথচ মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো বয়সের একজন নারীরই নিজের সঙ্গে একলা কিছু সময় কাটানো উচিত। এমনকি তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, পুরুষের তুলনায় নারীর মধ্যে বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তার মতো মানসিক রোগের প্রবণতা বেশি। এমনকি নারীরা পুরুষদের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা কিছু মানসিক রোগে ভুগে থাকেন। প্রসব–পূর্ববর্তী বিষণ্নতা, প্রিমেন্সট্রুয়াল ডিসফোরিক ডিজঅর্ডার, পেরিমেনোপজ–সম্পর্কিত সমস্যা ইত্যাদি। তা ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা অনুসারে, নারীর মধ্যে পিটিএসডি (পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) হওয়ার আশঙ্কা পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ। বেঙ্গালুরুর ফোর্টিস হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির কনসালট্যান্ট আকাঙ্ক্ষা পান্ডে বলেন, ‘নারীদের দেহে পুরুষদের তুলনায় কম পরিমাণে সেরোটোনিন নিঃসরণ হয়, ফলে তাদের বিষণ্নতার হার বেশি। তা ছাড়া জেনেটিকভাবে একজন নারী মানসিক রোগের শিকার হতে পারেন [সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস]।’ সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রচলিত নানা মানসিকতার কারণেও নারীদের মনোরোগ বেশি হওয়ার প্রবণতা থাকে। তিনি বলেন, ‘এখনো নারীদেরকে শিশুদের প্রাইমারি কেয়ারগিভার হিসেবে ধরা হয়। তা ছাড়া বাড়িতে কোনো অসুস্থ রোগী থাকলে তার সেবা–শুশ্রূষার প্রায় ৮০ শতাংশ করেন পরিবারের নারী সদস্য। ফলে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ থেকে নিস্তার মেলে না তাদের।’
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিজের সান্নিধ্য উপভোগ করেন, তাদের পক্ষে সুখী জীবন কাটানোর সম্ভাবনা বেশি। তা ছাড়া মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও হতাশাজনক চিন্তাভাবনা কমাতেও সাহায্য করে এই অভ্যাস। একা সময় কাটানোর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ছাড়াও এককথায় আপনি নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন। একান্তে সময় কাটালে তা মন পরিষ্কার করতে এবং ফোকাস ধরে রাখতে বেশ কাজে দেয়। এতে শুধু মন নয়, শরীরও পুনরুজ্জীবিত হয়। তা ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার এ যুগে দিন দিন মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার সময়, অর্থাৎ অ্যাটেনশন স্প্যান কমে আসছে। একান্তে নিজেকে সময় দিলে তা আপনাকে স্থির হতে সাহায্য করবে, যা থেকে মনোযোগ ধরে রাখার অভ্যাসও গড়ে উঠবে। আর সেই সঙ্গে গড়ে উঠবে উৎপাদনশীলতা, সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি। নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততা ভুলে ভিন্ন কিছু করলে তা মস্তিষ্ককে সচল রাখার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। তা ছাড়া মি টাইম কাটানোর মাধ্যমে একজন নারী নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারেন। হতে পারে এমন কোনো কাজ, যা তিনি ছোটবেলায় করতে ভালোবাসতেন, কিন্তু মাঝ বয়সে এসে কাজের চাপে আর সামলে উঠতে পারেননি। এসব ছোট ছোট কাজই নিজেকে বুঝতে আর আবিষ্কার করতে সহায়তা করে। গভীরভাবে চিন্তা করা, নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতেও সাহায্য করে এ সময়টুকু। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, একলা সময় কাটালে আপনি নিজের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ অনুভব করতে পারবেন, আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন। নিজের সঙ্গে সম্পর্ক যত ভালো হবে, অন্যের সঙ্গেও ততই উন্নত হবে—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নিজ সঙ্গ কাটানোর অনেক উপায় রয়েছে। হতে পারে তা নিজের জন্য এক কাপ কফি বানানোর মতো ছোট্ট কোনো কাজ, কিংবা বই পড়ার মতো সময়সাপেক্ষ কিছু। তবে নিজের সঙ্গে সময় কাটানোকে কোনো রুটিনমাফিক কাজ মনে না করে, যা ভালোবাসেন সেটিই করা ভালো। ছোটবেলায় দেয়ালে আঁকিবুঁকি করে মায়ের বকুনি খায়নি, এমন মানুষ কমই মিলবে। আপনিও যদি তাদের একজন হয়ে থাকেন, তাহলে মি টাইমে ছেলেবেলার এ কাজ আবারও করলে কেমন হয়? আয়না, ঘরের এক কোণের দেয়াল, মাটির টব কিংবা পুরোনো কোনো বোতল—ক্যানভাস হিসেবে বেছে নিতে পারেন যেকোনো কিছু। এর মাধ্যমে যে আপনার সময় বাঁচবে, তা নয়; বরং সৃজনশীলতার প্রকাশও ঘটে ছবি আঁকার মাধ্যমে। এর পাশাপাশি নারীরা সাধারণত আরও যে দুটি কাজ করে কাটাতে পারেন মি টাইম, তা হলো—গান শোনা আর বই পড়া। তবে এ ক্ষেত্রেও আনতে পারেন নতুনত্ব। যেমন ধরুন, ছোটবেলা থেকে ক্ল্যাসিক্যাল গান শুনেই বড় হয়েছেন, এই গানেই খুঁজে পান শান্তি। কিন্তু গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা তো দোষের কিছু নয়। বলা হয়ে থাকে, গান মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে। নতুন নতুন ঘরানার গান শুনলে আপনিও নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারবেন।
একই কথা খাটে বইয়ের বেলায়ও। সব সময় যে ধরনের বই পড়েছেন, এবার তার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন ধরনের পড়ে দেখুন, হয়তো জীবনকে দেখতে পাবেন নতুন আঙ্গিকে। বইপত্র পড়া বা গান শোনা বাদেও, নিজের একলা সময়টায় জার্নাল লিখতে কিংবা স্ক্র্যাপবুক বানাতে পারেন। এ ধরনের কাজ মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। তা ছাড়া জার্নাল লেখার মাধ্যমে আপনি নিজ লক্ষ্য নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতাও কাটিয়ে উঠতে পারবেন। বয়স যা–ই হোক, নারীদের সময় কাটানোর একটি জনপ্রিয় মাধ্যম বাগানের গাছের পরিচর্যা করা। সহজ এই কর্ম আসলেই কাজে দেয় মেডিটেশনের মতো। দিনের একটা সময় নিজের জন্য রেখে গাছগুলোর যত্ন নিলে একই সঙ্গে যত্ন নেওয়া হবে মনেরও। নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর আরেকটি উপকারী এবং সহজ উপায় মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করা। দিনে অন্তত ১০ মিনিট হালকা যোগব্যায়াম কিংবা মেডিটেশন করলে তা আপনার পুরো দিনের ক্লান্তি অনেকটাই কমিয়ে আনবে। তা ছাড়া মেডিটেশন আপনার অ্যাটেনশন স্প্যান বাড়াতেও বেশ কাজে দেবে।
আচ্ছা, মি টাইম কাটানোর জন্য কি কোনো না কোনো কাজ করতেই হবে? অবশ্যই না। আপনি কিছু না করেও নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেন। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে, নিজেকে একটু শান্ত করতে ঘরে বসেই নিতে পারেন শাওয়ার স্পা, কিংবা হট বাথ। শরীরের নার্ভ রিল্যাক্সের মতো আরও বেশ কিছু উপকারিতা আছে এর। এ কাজগুলোও যদি না করতে চান, তাহলে দিনের কিছুটা সময় একলা বসে নিজের সঙ্গে কথা বলেও পার করে দিতে পারেন। নিজেকে সাহস দেওয়া, নিজের কাজের প্রশংসা করা, নিজেকে প্রেরণা দেওয়া আপনার চেয়ে ভালো আর কেই–বা করতে পারবে!
সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট