কুন্তলকাহন I স্ক্যাল্প বিল্ডআপ
খুশকির জ্বালাতন, ভিন্নমাত্রায়? সারাই প্রচেষ্টার আগে জানা থাক কারণ। তারপর চলুক লড়াই, সঠিক পন্থায়
একদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরে দেখলেন, সারা দিন যে কালো স্যুট পরে ছিলেন, তা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সাদা ছোট ছোট খুশকির দানা। ব্যস! উঠেপড়ে লাগলেন শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে বিব্রতকর এ খুশকি দূর করতে। কিন্তু কিছুদিন পরই আবার আগের মতো খুশকি হাজির। এ ধরনের সমস্যা মূলত আপনার মাথার ত্বক বা স্ক্যাল্প বিল্ডআপের একটি বড় সংকেত। সঠিক পন্থায় না এগিয়ে শুধু শ্যাম্পু করেই এ সমস্যা দূর হবে না। এমনকি অনেকের স্ক্যাল্প বিল্ডআপের সমস্যা এতটাই গুরুতর, থাকে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ বা ডার্মাটোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হয়।
স্ক্যাল্প যে শুধু আমাদের মাথা সুরক্ষিত রাখে তা নয়, মাথার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে। চুলের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে প্রথমেই ঠিক রাখা চাই স্ক্যাল্প। শুরুতে জেনে নেওয়া যাক স্ক্যাল্প বিল্ডআপ কী। আমাদের স্ক্যাল্পের কোষগুলো একটি সেলুলার টার্নওভারের মধ্য দিয়ে যায়। প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়ায় স্ক্যাল্পের পুরোনো কোষগুলো মারা যায়, সে জায়গায় নতুন কোষের জন্ম হয়। মৃতকোষগুলো শেষমেশ স্ক্যাল্পের পৃষ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে। এসব মৃতকোষ অপসারণ এবং কোষের টার্নওভার ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে এক্সফোলিয়েশন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মৃতকোষগুলো পৃষ্ঠে জমা হতে দেখা যায়। স্ক্যাল্পের ওপরেই নতুন আরেকটি স্তর তৈরি করে এগুলো। একেই মূলত স্ক্যাল্প বিল্ডআপ বলে। এই বিল্ডআপ নতুন স্ক্যাল্প কোষ গঠনকে শ্লথ করে দেয়, এমনকি চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতেও দেয় বাধা।
স্ক্যাল্প বিল্ডআপের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আমাদের স্ক্যাল্পে প্রচুর সেবাসিয়াস গ্রন্থি ও হেয়ার ফলিকল থাকে। সেবাসিয়াস গ্রন্থিগুলো ক্রমাগত সিবাম নামক তরল নিঃসরণ করে। এই সিবাম মূলত একটি লুব্রিকেন্ট, যা স্ক্যাল্পের পাশাপাশি চুলের গোড়ার দিকটা কন্ডিশন্ড রাখে। তবে সিবাম নিঃসরণের মাত্রা ঠিক না থাকলে এর কার্যকারিতায়ও পরিবর্তন আসে। অপর্যাপ্ত সিবাম নিঃসরণ হলে চুল ও স্ক্যাল্পে শুষ্কতা দেখা দেয়; আবার অতিরিক্ত নিঃসরণ হলে খুশকি, জীবাণুর আক্রমণ, স্ক্যাল্প ও চুলের ফ্যাটি ম্যাটেরিয়ালের বিল্ডআপ ঘটতে পারে। ক্রমাগত সিবাম উৎপাদনের ফলে মাথার ত্বকে একটি চর্বি ও মোমযুক্ত পদার্থ তৈরি হয়। এই অবাঞ্ছিত উপাদানগুলো মাইক্রোবিয়ালের বংশবৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। স্ক্যাল্পে ছত্রাকের বৃদ্ধিই আসলে খুশকির জন্য দায়ী।
স্ক্যাল্প বিল্ডআপের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং শিল্পায়নও অনেকাংশে দায়ী। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় চুলের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব সম্পর্কে জানা গেছে। সাধারণত যারা রোজ বাইরে বের হন, তাদের চুল ও স্ক্যাল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এমনকি হাইওয়ে কিংবা ফ্রিওয়ের আশপাশে যাদের বাড়ি, তাদেরও এ সমস্যা হতে পারে। গাড়ির ধোঁয়া থেকে নির্গত কার্বন কণা স্ক্যাল্পের সিবামের সঙ্গে লেগে থাকে এবং আরও পুরু চর্বিযুক্ত পদার্থের আস্তরণ তৈরি করে। অবাক করা বিষয় হলেও সত্যি, আমরা চুলের যত্নে যেসব পণ্য ব্যবহার করি, সেগুলো থেকেও স্ক্যাল্প বিল্ডআপ হতে পারে। সারফেক্ট্যান্ট, কন্ডিশনার, তেল ইত্যাদি পণ্য অনেক দিন ধরে স্ক্যাল্পে জমা হতে হতে বিল্ডআপ তৈরি করতে পারে। এসব পণ্যের মধ্যে উপস্থিত অনেক রাসায়নিক উপাদানের অণু চুলের কিউটিকল ভেদ করতে পারে না। এই অণুগুলোই জমাট বাঁধতে থাকে বাইরের ত্বকে। আপনার যদি কখনো স্ক্যাল্প তৈলাক্ত কিংবা ভারী মনে হয়, হতে পারে তা চুলের জন্য ব্যবহৃত পণ্যেরই বিল্ডআপ।
স্ক্যাল্প বিল্ডআপ ঠেকানোর কিছু পন্থা রয়েছে। প্রথমেই বলা যায় স্ক্যাল্প ডিটক্সের কথা। স্বাস্থ্যকর চুল ও স্ক্যাল্পের জন্য ডিটক্সের জুড়ি মেলা ভার। ডিটক্স করার একাধিক উপায় রয়েছে। স্ক্যাল্পে জমে থাকা তেলের বিল্ডআপ দূর করতে ব্যবহার করা যেতে পারে ক্ল্যারিফায়িং শ্যাম্পু। এমনিতে আমরা দৈনন্দিন যে শ্যাম্পু ব্যবহার করি, তার চেয়ে ক্ল্যারিফায়িং শ্যাম্পুর বিল্ডআপ পরিষ্কারের ক্ষমতা বেশি। তবে বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের শ্যাম্পু ঘন ঘন ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন। কারণ, অন্যথায় আমাদের স্ক্যাল্পের স্বাভাবিক তেলের নিঃসরণ কমে যেতে পারে। বিল্ডআপের সমস্যা যদি গুরুতর হয়, তাহলে ক্ল্যারিফায়িং শ্যাম্পুর আগে ব্যবহার করতে পারেন ডিটক্সিফাইং স্ক্যাল্প সেরাম। এ ধরনের সেরামও স্ক্যাল্পের অতিরিক্ত তেল শোষণ করতে পারে। স্ক্যাল্প বিল্ডআপ দূর করতে স্ক্যাল্প ম্যাসাজারও হতে পারে একটি ভালো বিকল্প। স্ক্যাল্পকে এক্সফোলিয়েট করা ছাড়াও এ ধরনের পণ্য ডিপ ক্লিনিং এবং রক্তসঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে। শ্যাম্পু করার সময় আলতো করে স্ক্যাল্প মাসাজার দিয়ে সার্কুলার মোশনে মাথার তালুতে মাসাজ করতে হবে। এটি স্ক্যাল্পের শুষ্কতা রোধে বেশ সাহায্য করে।
স্ক্যাল্প বিল্ডআপ ঠেকাতে চুলের যত্নে ব্যবহৃত পণ্যের সংখ্যা কমানো বেশ কাজে দেয়। হেয়ার স্প্রে, জেল কিংবা ক্রিমের মতো হেয়ার কেয়ার পণ্য ব্যবহারে সেগুলো মাথার ত্বকে জমাট বেঁধে চুলের ফলিকল আটকে দিতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন চুল পড়া বেড়ে যায়, তেমনি চুলের গোড়া হয়ে ওঠে তেলতেলে। তাই চুলে অতিরিক্ত পণ্য ব্যবহার না করে একদম ন্যূনতম পণ্যের একটি রুটিন মেনে চলাই উত্তম। সপ্তাহে দুদিন তেল দিয়ে শ্যাম্পু করলে তা চুলের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সহায়তা করে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অ্যাপল সাইডার ভিনেগার দিয়ে চুল পরিষ্কার করলে তা স্ক্যাল্পে জমাট বাঁধা বিল্ডআপ দূর করতে পারে। অ্যাপল সাইডার ভিনেগারে উপস্থিত অ্যাসিটিক অ্যাসিড ও আলফা-হাইড্রক্সি অ্যাসিড স্ক্যাল্পের বিল্ডআপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে বলে জানা যায়। তবে মনে রাখা চাই, ত্বকে এই ভিনেগার সরাসরি ব্যবহার করা উচিত নয়। এক কাপ ঠান্ডা পানির সঙ্গে আধা টেবিল চামচ অ্যাপল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। এই সল্যুশন ব্যবহারের পর তীব্র গন্ধ এড়াতে শ্যাম্পু দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে চুল ও স্ক্যাল্প।
স্ক্যাল্প বিল্ডআপ দূর করতে ওষুধের মতো কাজ করে টি ট্রি অয়েল। মূলত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, মাইট ইত্যাদির বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য পরিচিত জীবাণুনাশক এটি। তবে যাদের ত্বক সংবেদনশীল, তারা ব্যবহারের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নেবেন। তা ছাড়া টি ট্রি অয়েল বেশ কড়া হওয়ায় জোজোবা, গ্রেপ সিড, অ্যাভোকাডো তেলের সঙ্গে মিশিয়ে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
অনেক সময় স্ক্যাল্প বিল্ডআপের পেছনে হরমোনাল কারণও থাকতে পারে। আবার অনেকের মাথার ত্বকে সোরিয়াসিসের মতো সমস্যা থাকলেও এর ফলে এই বিল্ডআপ হতে পারে। তাই কারণ চিহ্নিত না করে কখনোই ত্বক কিংবা চুলের কোনো পণ্য ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
মডেল: ইফা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল