টেকসহি I রশ্মির তরঙ্গে
লেজার মিক্সিং। এক সেশনেই কয়েক ধরনের লেজার ট্রিটমেন্ট। বাঁচে সময়। ফলও পাওয়া যায় দ্রুত
সৌন্দর্যচর্চার গল্প আদি লগ্নের। সভ্যতার শুরুর দিকে ভেষজ ও আয়ুর্বেদই ছিল একমাত্র উপায়। কালের বিবর্তনে এসব পন্থায়ও এসেছে পরিবর্তন। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন কৃত্রিম উপায়েও চলে সৌন্দর্যচর্চা। বর্তমানে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে একটি বড় জায়গাজুড়ে আছে কসমেটিক লেজার। বার্ধক্যের ছাপ, ক্ষতের দাগ, বলিরেখা, পিগমেন্টেশন—এ ধরনের সমস্যার সমাধানে লেজার ট্রিটমেন্টের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে।
ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন বাড়ানো, ফাইন লাইন মসৃণ করা থেকে শুরু করে হাইপারপিগমেন্টেশন এবং ত্বকের টেক্সচার টান টান করা—লেজারের মাধ্যমে ত্বকের সজীবতা সহজে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তবে কসমেটিক লেজারের সেশনগুলো বেশ সময়সাপেক্ষ। এমনকি অনেক সময় একেকটা নির্দিষ্ট ট্রিটমেন্টের জন্য দরকার হয় একের অধিক সেশন। এখনকার ব্যস্ততার মধ্যে একে তো এই সেশনের সময়সূচি মেনে চলা কঠিন হয়ে পড়ে, অন্যদিকে লেজার-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ত্বক লাল, ফ্লেকি কিংবা রুক্ষ হয়ে যাওয়ার সমস্যাও বেশ ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব কারণে এখন লেজার মিক্সিং বা লেজার লেয়ারিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একে ‘কম্বিনেশন থেরাপি’ হিসেবেও বর্ণনা করেন অনেকে। একটা সেশনে কয়েক ধরনের লেজার করার ফলে একদিকে যেমন সময় বাঁচে, অন্যদিকে ত্বকে ফলাফল বেশ দ্রুত দেখতে পাবেন।
ত্বকে লেজার করার আগে তা কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে ধারণা থাকা উচিত। আমরা সাধারণত যে আলো দেখতে পাই, তাকে বলা হয় দৃশ্যমান আলো। এই আলো আসলে একাধিক রঙের সংমিশ্রণ। দৃশ্যমান আলোর রংগুলো আলাদাভাবে দেখার জন্য প্রিজম একটি কার্যকর মাধ্যম। আলো প্রিজমের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করলে মূলত বর্ণালির প্রাথমিক রংগুলো আলাদাভাবে দেখা যায়। লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, নীল, আসমানি ও বেগুনি—বর্ণালির প্রতিটি রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা। এ তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলোর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে সাহায্য করে। লেজার থেরাপিতে এমন আলো ব্যবহার করা হয়, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি। যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি, সে আলো ত্বকের তত গভীরে প্রবেশ করতে পারে। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি হওয়ায় লেজার চিকিৎসায় সাধারণত এটিই ব্যবহৃত হয়। লেজার থেরাপিতে আলোকে এমনভাবে ম্যানিপুলেট করা হয়, যাতে তা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে গিয়ে পড়ে। লেজারের আলো ত্বকের নির্দিষ্ট জায়গায় পড়ার পর প্রথমে এটি শোষিত হয়, তারপর উত্তপ্ত। লেজার থেরাপির মূল কাজ তাপ ছড়িয়ে পড়ার আগে লক্ষ্যটিকে (এ ক্ষেত্রে দাগ বা ফাইন লাইন) বিনাশ করা।
ত্বকে বেশ কয়েক ধরনের লেজার করা হয়। ইদানীং একটা সেশনেই ক্লিয়ার অ্যান্ড ব্রিলিয়ান্ট, পিআরপি ইনজেকশন আর মাইক্রোনিডলিং লেজার করার প্রবণতা বেড়েছে। এভাবে লেজার মিক্সিংয়ের মাধ্যমে একই সঙ্গে ত্বকের কোলাজেন উৎপাদন বাড়ানো, ফাইন লাইন, পোরস কমানোর পাশাপাশি পিগমেন্টেশনও কমিয়ে আনা যায়। ত্বককে একটি হেলদি গ্লো দেয় এই ট্রিটমেন্ট। ক্লিয়ার অ্যান্ড ব্রিলিয়ান্টের মতো লেজারগুলো ত্বকে ছোট ছোট চ্যানেল তৈরি করে, যার মাধ্যমে ত্বকের গভীরে সেরাম কিংবা ময়শ্চারাইজার পৌঁছাতে পারে। এ কারণে এই লেজারের সঙ্গে পিআরপি ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। পিআরপি মূলত কোলাজেন ও ইলাস্টিন বাড়ায়। ত্বকের গভীরে পৌঁছাতে পারলে এটি আরও দ্রুত কাজ করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মাইক্রোনিডলিং। সাধারণত সব ধরনের ত্বকের জন্যই এটি নিরাপদ। মাইক্রোনিডলিং পোস্ট-ইনফ্ল্যামেটরি হাইপারপিগমেন্টেশনের ঝুঁকি কমায়; সেই সঙ্গে কোলাজেন স্টিমুলেশনেও সহায়তা করে। এই লেজারের মাত্র ৫ থেকে ৬ দিনের মধ্যেই ত্বক স্বাভাবিক হয়ে আসে।
দিন যত যাচ্ছে, আমাদের কর্মব্যস্ততা বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ঘরের বাইরে থাকার সময়টাও। বাইরে থাকার ফলে রোদে পোড়া দাগ অর্থাৎ সানবার্নের ঘটনাও বাড়ছে। রোদে পোড়া দাগ দূর করা, ঝুলে পড়া ত্বকের চামড়া আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, কোলাজেন উৎপাদন বাড়ানো—এসব কাজে বিবিএল হিরো বা বিবিএল হ্যালো লেজারের সঙ্গে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি ও মাইক্রোনিডলিং করা হয় লেয়ার হিসেবে। বিবিএল হিরো লেজারকে ইনটেন্স পালসড লাইট ট্রিটমেন্টও বলা হয়। এর মাধ্যমে ত্বকের ওপরের পৃষ্ঠে রোদে পোড়া দাগ দূর করা সম্ভব। তা ছাড়া ত্বকের অবাঞ্ছিত বাদামি কিংবা লাল দাগও দূর করা হয় এই পন্থায়। অন্যদিকে ত্বকের টেক্সচার মসৃণ এবং ব্রণের দাগ হালকা করতে কার্যকর বিবিএল হ্যালো ট্রিটমেন্ট। বিবিএল হিরো বা বিবিএল হ্যালো ট্রিটমেন্টের পর নিরাময় প্রক্রিয়া দ্রুত করতে ও প্রদাহ কমাতে ত্বকে সেরাম হিসেবে পিআরপি ইঞ্জেক্ট করা হয়। তবে যাদের ত্বক ডার্ক শেডের এবং যাদের মেলাজমা বা মেছতা রয়েছে, তাদের এই লেজার ট্রিটমেন্ট করানো উচিত নয়।
তাহলে কি যাদের ত্বকে মেলাজমা আছে, তারা লেজার ট্রিটমেন্ট করাতে পারবেন না? এমনটা নয়। মেলাজমার জন্য সাধারণত পিকোশিওর ট্রিটমেন্টের সঙ্গে পিআরপির মিশ্রণে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেহেতু তাপে মেলাজমা আরও বেশি ট্রিগার হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়, তাই এর চিকিৎসায় ইনটেন্স পালসড লাইট, ফ্র্যাক্সেল এবং ক্লিয়ার অ্যান্ড ব্রিলিয়ান্টের মতো ট্রিটমেন্ট এড়িয়ে চলা দরকার। মেলাজমার চিকিৎসায় অনুমোদিত একমাত্র লেজার হলো পিকোশিওর। এতে ত্বকে তাপ ও আলোর ক্ষতিকর প্রভাবের ঝুঁকি অন্যান্য লেজারের তুলনায় কম। তা ছাড়া মেলাজমার চিকিৎসায় মাইক্রোনিডলিং ব্যবহার করা যায় কি না, তা নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। হাইপোপিগমেন্টেশন, অর্থাৎ রোদে ত্বকের কোনো অংশ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া কিংবা শরীর থেকে ট্যাটুর দাগ দূর করার পর সেই অংশ থেকে পিগমেন্ট চলে গেলে তা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর ভূমিকা দেখিয়েছে মাইক্রোনিডলিং। এবার মেলাজমা কমাতে এটি কাজে দেয় কি না, তা নিয়েই চলছে গবেষণা।
এবার আসে লেজার ট্রিটমেন্ট করানোর সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে একটি—অ্যান্টি-এজিং। চেহারায় বয়সের ছাপ সাধারণত কেউই চায় না। আর তাই লেজার ট্রিটমেন্টগুলোর মধ্যে অ্যান্টি-এজিং বা বার্ধক্যের ছাপ কমানোর জন্য করা লেজারের সংখ্যাও বেশি। এ ক্ষেত্রে স্পেশালিস্টরা ‘ট্রাই-এল’ ট্রিটমেন্টের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ট্রাই-এল মূলত রেডিওফ্রিকোয়েন্সি স্কিন-টাইনিং ট্রিটমেন্ট, লেজার রিসারফেসিং এবং প্লাজমা থেরাপির সংমিশ্রণ। তিন ধরনের লেজারের এই মিশ্রণ আপনার ত্বকের গভীরতম স্তরগুলোতে পৌঁছাতে সক্ষম। সেই সঙ্গে ত্বকের ফাইন লাইন, বলিরেখা এবং পিগমেন্টেশন দূর করতেও সাহায্য করে এগুলো। এ প্রক্রিয়ার শেষের দিকে, যার ট্রিটমেন্ট করা হচ্ছে, তার দেহ থেকে অল্প পরিমাণে রক্ত বের করে আনা হয়। এরপর ওই ব্যক্তির পেটের ত্বকের নিচের স্তর থেকে সংগৃহীত চর্বি সেই রক্তের সঙ্গে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মিশিয়ে একটি সেরাম তৈরি করা হয়। এই সেরাম পরে ত্বকের কয়েক স্তর গভীরে প্রবেশ করানো হয়। ট্রাই-এলের কার্যক্রম কিছুটা জটিল হওয়ায় অন্যান্য লেজারের তুলনায় এতে ত্বক স্বাভাবিক হতে সময় কিছুটা বেশি লাগে। ট্রিটমেন্টের তিন মাস পর ত্বকের চামড়ায় টান টান ভাব লক্ষ করা যায়, একই সঙ্গে পিগমেন্ট ও টেক্সচারেও ভিন্নতা দেখা দেয়। তবে নিজের ত্বকে যেকোনো ধরনের লেজার করার আগে অবশ্যই চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
মডেল: বর্ণ
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল