ত্বকতত্ত্ব I পিএইচ ৫.৫?
ত্বকের সুরক্ষায় পিএইচ ভারসাম্য সঠিক থাকা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। হেলা করলেই বিপদ
ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স ঠিক আছে, নাকি নেই? পিএইচ হচ্ছে দ্রবীভূত হাইড্রোজেন আয়নের সক্রিয়তার পরিমাপ। আরও সহজ করে বললে ত্বকের অ্যাসিড আর ক্ষারের মাপকাঠি। আমাদের ত্বক কতটা সতেজ ও স্বাস্থ্যকর থাকবে, তা অনেকটা নির্ভর করে পিএইচের সঠিক ভারসাম্যের ওপর। গরমিল হলেই সমস্যা। ত্বকে সঠিক পিএইচ ব্যালান্স ধরা হয় ৫.৫ কে। এই ভারসাম্য বজায় রাখার অর্থ হলো ত্বকের উপরিভাগে অ্যাসিড ও ক্ষারের সঠিক মাত্রা বজায় রাখা। এই স্তর ঠিকঠাক থাকলে ত্বক মসৃণ, ভাঁজহীন, তারুণ্যে ভরপুর থাকে। আর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে ত্বকসংক্রান্ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হওয়া। ত্বকে অকালবার্ধক্য দেখা দেওয়ার শঙ্কা। এককথায়, ত্বক অকালে বুড়িয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ ধরা হয় এই পিএইচ মাত্রার ভারসাম্যহীনতাকে।
ভাবছেন, পিএইচ মাত্রা নিয়ে কেন আলোচনা করছি? কারণ, ১৩০টির বেশি ক্লিনিক্যাল স্টাডির রিপোর্ট অনুসারে, নিখুঁত পিএইচ অর্জনই সুন্দর ত্বকের গোপন রহস্য। ব্রিটিশ জার্নাল অব ডার্মাটোলজিতে গ্রেগ হিলেব্র্যান্ড প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানা যায়, যেসব রোগীর ত্বক অতিমাত্রায় খসখসে বা সমস্যায় আক্রান্ত মনে হয়েছে, তাদের পিএইচ ব্যালান্স সঠিক ছিল না। ত্বকে বলিরেখা, বয়সের ছাপ এবং র্যাশ দেখা যাওয়ার কারণ ছিল সেটাই; অন্য কিছু নয়। একমাত্র পিএইচ ভারসাম্যপূর্ণ ত্বকই কখনো মসৃণতা হারায় না। নিউইয়র্ক সিটিভিত্তিক বোর্ড প্রত্যয়িত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ মার্নি নুসবাউম এ নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। তার মতে, আদর্শ পিএইচ ৫.৫ কে বলা যেতে পারে একটি ম্যাজিক নাম্বার, যা সারা জীবন সুখী ত্বকের নিশ্চয়তা দেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ত্বক পিএইচ ভারসাম্য হারাচ্ছে বা হারিয়ে ফেলেছে, এটা বোঝার উপায় কী? ডা. নুসবাউমের মতে, ত্বক স্বাভাবিক আচরণ না করলেই বুঝে নিতে হবে, কোনো সমস্যা আছে। একজিমা, লালচে ভাব, শুষ্ক ছোপ, ব্রণ, তৈলাক্ততা, সোরিয়াসিস, অকালবার্ধক্যের লক্ষণ ইত্যাদি ইঙ্গিত ত্বকের পিএইচ ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত দেয়। এর মানে, ত্বকের স্বাভাবিক যাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর তা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সমস্যা। নুসবাউম আরও জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে ত্বকের এই ভারসাম্য হারানোর কারণ হিসেবে বলা যায়, আপনি এর প্রতি খুব রূঢ় আচরণ করেছেন। সম্ভবত, খুব আক্রমণাত্মকভাবে স্ক্র্যাবিং করছেন, বেশি গরম পানি কিংবা হার্শ ক্লিনজার ব্যবহার করছেন। কিংবা যে কাপড় মুখ পরিষ্কার করা বা পানি শুকানোর কাজে ব্যবহার করেছেন, অর্থাৎ ওয়াশক্লথগুলোও সমস্যার কারণ হতে পারে। সাধারণভাবে ব্যবহৃত বেশির ভাগ ওয়াশক্লথই ত্বকের সেনসেটিভিটি বজায় রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এগুলো খসখসে ও কর্কশ হয়ে থাকে। রঙিন হলে তো কথাই নেই। কাপড়ের রং থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ত্বক। তাই ত্বক মেকআপমুক্ত পোস্ট-ক্লিনজিং নিশ্চিত করতে সাদা ওয়াশক্লথ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সবচেয়ে ভালো সেটি যদি সূক্ষ্ম কাপড়ের হয়, যা পিএইচ ব্যালান্স ব্যাহত না করে ত্বকের যত্ন নেবে।
আবার অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম আবহাওয়া থেকেও ব্যাহত হয় পিএইচ ব্যালান্স। অতিমাত্রায় দুচিন্তা, মানসিক চাপ, ত্বক পরিষ্কারে অনেক প্রেশার দেওয়া, প্রচুর রাসায়নিক প্রডাক্ট ব্যবহার করা ইত্যাদির জন্য হতে পারে। কী কারণে হয়েছে, তা খুঁজে বের করে নজর দিতে হবে এর প্রতিকারে। যেমন ত্বক পরিষ্কারে গরম পানির ব্যবহার না করাই শ্রেয়। এটি ত্বকের প্রতিরক্ষামূলক স্তর ছিঁড়ে ফেলে। ত্বকে আর্দ্রতার মাত্রা কমায়। পাশাপাশি যে ক্লিনজার বা সাবান ব্যবহার করছেন, তা যদি ক্ষার ও সারফ্যাকট্যান্টমুক্ত না হয়, তাহলে ত্বকের অ্যাসিড ম্যান্টেল ছিনিয়ে নিচ্ছেন বলা যায়। ফলে পিএইচ মাত্রা বেশি বেড়ে যায়।
ভারসাম্যহীন ত্বককে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ হলো কঠোর উপাদানগুলো থেকে দূরে থাকা এবং বিভিন্ন সুষম পণ্যে সুইচ করে ত্বককে সুস্থ করতে সাহায্য করা। কয়েক সপ্তাহের জন্য মৌলিক বিষয়গুলোতে ফিরে যাওয়া। যার মানে, প্রাকৃতিক উপায়ে ত্বকের যত্ন নেওয়া, হারবাল সাবান বা লোশন ব্যবহার করা। যে পানি ব্যবহার করছেন তা ক্ষারমুক্ত কি না, পরীক্ষা করাও জরুরি। এগুলো প্রাথমিকভাবে ত্বকের নানা সমস্যাকে প্রশমিত করতে পারে এবং আরও পরবর্তী ধাপের চিকিৎসার জন্য ত্বককে প্রস্তুত করতে পারে। যদি ক্ষতির মাত্রা বেশি হয়, তবে এর ফলে ত্বক সুষম হয়ে উঠতে শুরু করবে। প্রশ্ন হলো, সুষম ত্বক থেকে কী আশা করতে পারেন? ডা. নুসবাউম বলেছেন, ত্বক সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যকর দেখাবে। নিজেই বুঝতে পারবেন, ত্বক সুস্থ হতে শুরু করেছে। আর্দ্রতা আর দীপ্তিও ফিরে পাবে। ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা হলে স্কিন কেয়ার পণ্যগুলো ত্বকের ওপর আরও ভালো কাজ করবে।
ত্বক সঠিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ না হলে স্কিন কেয়ার উপাদান যতই শক্তিশালী হোক, তা ত্বকের ভেতরের স্তরে প্রবেশ করার সুযোগ পায় না। ক্ষেত্রবিশেষে এগুলো এমনকি ভেঙে যাওয়া ত্বকের বাধার কারণে বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে। সাধারণ ময়শ্চারাইজার সঠিকভাবে ত্বকে কাজ করার জন্যও ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স ঠিক থাকা চাই, যাতে এগুলো ত্বকের যত্ন নেওয়ার সুযোগ পায়।
এবার বোঝা যাচ্ছে, পিএইচ ব্যালান্স ত্বকের জন্য কতটা জরুরি? উন্নত স্কিন কেয়ার প্রডাক্ট ব্যবহার করেও যখন ফল পাওয়া যাচ্ছে না, তখন জানার চেষ্টা করুন ত্বকের ব্যালান্সের কী অবস্থা? সেখানে গরমিল থাকলে পরিবর্তন আনুন লাইফস্টাইলে। রাসায়নিকে ভরা প্রডাক্টের বদলে বেছে নিন প্রাকৃতিক ত্বক পরিচর্যার উপাদান। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন। রোদ এড়িয়ে চলুন। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে ইউভি রশ্মি ত্বকে লাগলে এর গঠন অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, ভেতরের কোলাজেন ও ইলাস্টিন ফাইবার ভেঙে যায়। তাই সঠিক মাত্রার সানস্ক্রিন ব্যবহার খুবই জরুরি।
মোটকথা, ত্বককে ভালোবাসতে শুরু করুন, তার যত্নে সময় দিন। যাতে সুস্থ থেকে বজায় রাখতে পারে পিএইচ ভারসাম্য।
রত্না রহিমা
মডেল: রিচি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল