ফিচার I স্বাস্থ্যকর রান্নাঘর
রাঁধতে ভালোবাসেন। রাঁধুনি হিসেবে খ্যাতিও আছে। হোক তা পারিবারিক পরিমণ্ডলে কিংবা পেশাগত চত্বরে। আপনার রান্নাঘর স্বাস্থ্যকর তো?
খাবার স্বাস্থ্যকর হওয়ার বিকল্প নেই। অস্বাস্থ্যকর খাবারে হয়ে যেতে পারে সর্বনাশ; এমনকি প্রাণসংহারীও হতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করেই থেমে থাকা ঠিক নয়। যেখানে তৈরি করা হয় খাবার, সেই ঘরের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখাও জরুরি। অথচ কিচেনের হাইজেনের ব্যাপারটি অনেকে এড়িয়ে যান। ভেজালবিরোধী নানা অভিযান দেখে আমরা অনেক সময় রীতিমতো আঁতকে উঠি। শুধু রাস্তার ধারের জোড়াতালি দেওয়া সস্তা খাবারের দোকান নয়, নামিদামি অনেক রেস্তোরাঁ কিংবা হোটেলের কিচেন দেখেও পিলে চমকে যায় আমাদের। খাবারের সঙ্গে যেখানে অর্থ বিনিময়ের সংযোগ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে অনেকে ধরে নেন, ‘এমনটাই তো হওয়ার কথা!’ যদিও এমনটা মেনে নেওয়া কিংবা এর প্রতি ন্যূনতম মৌন সমর্থন দেওয়াও অনুচিত। অন্যদিকে, যে খাবার ভক্ষণ করবে নিজের পরিবারের সদস্যরা, সেখানে বোধ করি স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে ছাড় দিতে কেউই নারাজ। তবু অনেক বাসায় রান্নাঘর অস্বাস্থ্যকর; তা হয়তো রাঁধুনির অজান্তেই! আবার নিজের রান্নাঘরকে স্বাস্থ্যকর ভেবে নিলেও সেটির অবস্থা যে প্রকৃত অর্থে বেহাল, তা হয়তো বুঝতে পারেন না কেউ কেউ। মানেন না সঠিক স্বাস্থ্যবিধি।
কোন নিয়মগুলো মেনে চললে রান্নাঘরকে স্বাস্থ্যবান্ধব ও স্বাস্থ্যকর রাখা সম্ভব? এ প্রসঙ্গে শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক চারটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপের কথা, যেগুলো নিশ্চিত করতেই হবে:
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: নিজেকে এবং নিজের কাজের জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
আলাদাকরণ: কাঁচা মাংস এবং অন্যান্য কাঁচা প্রাণিজ পণ্য অন্য খাবার থেকে আলাদা রাখা চাই।
রান্না: সব সময় সঠিকভাবে রান্না এবং খাদ্য প্রস্তুত করা জরুরি।
শীতলকরণ: রান্নার আগে ও পরে খাদ্যকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা উচিত।
নিজের বেলায়
রান্নাঘরে পারসোনাল হাইজেনকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে হেলায় কিংবা আলসেমিতে হয়তো অনেক দিনই কাটিয়েছেন। এবার সাবধান হোন! গড়ে তুলুন কিছু জরুরি অভ্যাস:
আপনি যদি কর্মক্ষেত্রে থাকেন, তাহলে রান্নাঘরের ইউনিফর্ম প্রতিদিন পরিষ্কার করুন এবং তা শুধুই কর্মক্ষেত্রে থাকাকালে পরুন।
কাঁচা ও রান্না করা খাবার সামলানোর জন্য বাজারে ভিন্ন ভিন্ন ডিসপোজেবল গ্লাভস পাওয়া যায়; কাজভেদে সঠিক গ্লাভস ব্যবহার করুন।
ফিতা বাঁধুন, আঁটসাঁট জুতা পরুন।
চুল ভালো করে বেঁধে কিংবা ঢেকে রাখুন।
হাতের নখ ছোট ও পরিষ্কার রাখুন।
সময়ে সময়ে হাত ধুয়ে ফেলুন; বিশেষ করে ডায়রিয়ার মতো অসুখে ভুগলে তো কথাই নেই।
হাত ধোয়ার ও রান্নাঘর পরিষ্কার করার সময় হাতের আংটি খুলে রাখুন; অন্যথায় এ কাজ ঠিকমতো করতে পারবেন না।
হাত মোছার জন্য পরনের অ্যাপ্রোন ব্যবহার করবেন না।
খাদ্য প্রস্তুতকরণ এলাকায় ধূমপান করবেন না; কাউকে করতেও দেবেন না।
প্রতিবার খাদ্য পরখ করার সময় পরিষ্কার চামচ ব্যবহার করুন।
খাবার পরিবেশনের সময় যথাসম্ভব কাঠের তৈরি পাত্র বা সরঞ্জাম ব্যবহার করুন এবং খাবারকে হাত দিয়ে স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
রান্নাঘর চত্বরে
খাবারের কারণে বাসা বাঁধা বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে দূরে থাকার জন্য রান্নাঘরে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা চাই। অন্যথায় বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া আপনার রান্নাঘরের দখল নিতে পারে। তাই কিছু নিয়মে একদমই ছাড় দিতে নেই:
হাত ধোয়া: কাঁচা খাবার সামলানোর আগে ও পরে সাবান ও গরম পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিন। অন্যথায় কাঁচা খাবার থেকে আপনার হাতের সংস্পর্শে রান্না করা খাবারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ক্ষতিকর অণুজীব। ধোয়ার পর পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে নিন।
সঠিক নিয়মে রান্না: মর্জিমতো নিরীক্ষা না করে বরং যথাযোগ্য প্রক্রিয়ায় খাবার রান্নার চেষ্টা করুন। নতুবা ইশেরশিয়া কোলাই, লিস্টারিয়া, স্যালমোনেলার মতো ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো খাবারে সক্রিয় থেকে যাবে। বলা হয়ে থাকে, এ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার বিনাশ ঘটাতে উচ্চ তাপমাত্রায় (৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঊর্ধ্বে) রান্না করা শ্রেয়।
সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ: ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, কেমিক্যাল কিংবা অন্য কোনো জীবাণু যেন বাসা বাঁধতে না পারে, তাই রান্না করা খাবার সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করুন। বিশেষজ্ঞের মতে, রান্না করা সকল ধরনের আমিষ (বিভিন্ন ধরনের মাংস, ডিম প্রভৃতি) ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট কিংবা তার চেয়ে কম তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা ভালো। তাই খাওয়া শেষে অবশিষ্টাংশ কিংবা খুলে ফেলা খাবারের প্যাকেট ভালোভাবে কোনো প্লাস্টিকের পাত্রে মুখ আটকে সংরক্ষণ করুন।
মিশ্রণে মানা: কাঁচা মাংস, পোলট্রি কিংবা সি ফুড প্রভৃতিকে অবশ্যই স্যালাদ কিংবা রুটির মতো রেডি-টু-ইট ধরনের খাবারগুলো থেকে দূরে রাখা চাই। কাঁচা ও রান্না করা খাবারের ক্ষেত্রে আলাদা কাটিং বোর্ড, ছুরি, পাত্র প্রভৃতি ব্যবহার করুন।
চপিং বোর্ড পরিষ্কার: চপিং বোর্ডে সহজেই অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে। বিশেষ করে চিজ, ভেজিটেবল কিংবা ফল কাটার ক্ষেত্রে যদি একই চপিং বোর্ড ব্যবহার করেন, তাহলে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার প্রবল ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই যেকোনো একটি কাজে ব্যবহার করার পরপরই চপিং বোর্ড ভালোভাবে পরিষ্কার করে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখুন। কাঁচা ও রান্না করা খাবারের ক্ষেত্রে আলাদা চপিং বোর্ড ব্যবহার করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
ফ্রিজের যত্নে: শুধু ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার কিংবা খাদ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রোধেই নয়, এমনিতেও সপ্তাহে এক দিন ফ্রিজ পরিষ্কার করা এবং মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে নষ্ট করে ফেলা দরকার।
সিংক মাজা: প্রতিদিনই নিয়ম করে সিংক মাজুন, যেন সহজে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে না পারে। রান্নার কাজে ব্যবহারের পর বাকি সময়টা সিংক যেন শুষ্ক থাকে, তা নিশ্চিত করুন।
কাউন্টারটপ ধোয়ামোছা: রান্নার আগে ও পরে রান্নাঘরের কাউন্টারটপ ভালোভাবে ধুয়ে-মুছে নিন।
কিচেন বিন: রান্নাঘরের ঝুড়ি থেকে প্রতিবারের আবর্জনা যথাসম্ভব প্রতিবার, অন্যথায় দিনে অন্তত একবার যথাযোগ্য স্থানে ফেলে আসুন। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর, মাসে অন্তত একবার পুরোনো কিচেন বিন ফেলে দিয়ে রান্নাঘরে আনুন নতুন বিন।
চর্বিমুক্তি: চর্বিযুক্ত খাদ্য ও অন্যান্য উপাদান সহজে পরিষ্কার হতে চায় না। বিভিন্ন উপাদানে তা লেগে থাকে। তাই এগুলোকে যথাযথভাবে পরিষ্কার করুন।
কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স
চপিং বোর্ড, ডিশ ক্লোদসহ রান্নাঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্র প্রতিদিনই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা জরুরি। চলুন, জানি সহজ উপায়:
ডিশ ক্লোদ: স্যাঁতসেঁতে ক্লোদ, স্পঞ্জ ও টি-টাওয়েল যেন ব্যাকটেরিয়ার আঁতুড়ঘর! এগুলো সঠিকভাবে পরিষ্কার না করলে যে কাজেই ব্যবহার করা হবে, সেখানেই ছড়িয়ে পড়তে পারে ব্যাকটেরিয়া। তাই ওয়াশিং মেশিনে হট ওয়াশের মাধ্যমে, অথবা গরম পানিতে ১৫ মিনিট ধরে সেদ্ধ করতে পারেন ডিশ ক্লোদ। কাঁচা মাংস কিংবা ভেজিটেবল সামলানোর পর যে ডিশ ক্লোদ দিয়ে মুছবেন, সেটি তখনই সরিয়ে ফেলে পরবর্তী ব্যবহারের জন্য আরেকটি পরিষ্কার ক্লোদের দ্বারস্থ হওয়া শ্রেয়। প্রতি দুই দিনে একবার করে ডিশ ক্লোদ যথাযথভাবে পরিষ্কার করা ভালো।
চপিং বোর্ড: প্রতিবার ব্যবহারের পরই চপিং বোর্ড সঠিকভাবে ধুয়ে নেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে সাবানযুক্ত গরম পানি ব্যবহার করে এমনভাবে ঘষে ধুতে হবে, যেন সামান্যতমও খাদ্যকণা কিংবা আবর্জনা অবশিষ্ট না থাকে। প্লাস্টিকের চপিং বোর্ড পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে ডিশওয়াশারে হট ওয়াশ করাও বেশ সুফল দিতে পারে।
নিজের ও অন্যের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে রান্নাঘরে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সুনিশ্চিত করার ভার রাঁধুনি হিসেবে আপনাকে নিতেই হবে। অন্যথায় বিপদ!
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট