skip to Main Content

যাপনচিত্র I নান্দনিক নন্দিতা

সানজিদা মাহমুদ নন্দিতা। প্রতিশ্রুতিশীল কণ্ঠশিল্পী। কেমন তার একান্ত জীবন?

২০১৩ সালে বাংলাদেশ আইডল দিয়ে যাত্রা শুরু। এরপর থেকেই কণ্ঠজাদুতে শ্রোতাদের বুঁদ করে রাখছেন। লাইভ শো, সিনেমা থেকে কোক স্টুডিও—সর্বত্রই দারুণ পদচারণ। এখন পর্যন্ত কোক স্টুডিওর দুই সিজনে মূল গায়িকা হিসেবে দুটি গান গাওয়া একমাত্র নারী কণ্ঠশিল্পীও তিনি। প্রথম সিজনে ঋতুরাজের সঙ্গে ‘বুলবুলি’ এবং দ্বিতীয় সিজনে ইশানের সঙ্গে ‘দাঁড়ালে দুয়ারে’ নজরুলগীতি দুটি এখন মানুষের মুখে মুখে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের ট্রেন্ডিং লিস্টেও এই দুই গানের জয়জয়কার। পাশাপাশি নান্দনিক জীবনযাপন ও ব্যতিক্রমী ফ্যাশন সেন্স তাকে আর দশজনের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে। মিষ্টি হাসির অধিকারী এই গায়িকাকে কেউ ‘সুচিষ্মিতা’ বলে ডাকতেই পারেন! বলছি সানজিদা মাহমুদ নন্দিতার কথা।
ছাত্রজীবন কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে কাটালেও সংগীতজীবনে প্রবেশের পর সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে তার। রাতে কাজ থাকা এবং দেরি করে বাসায় ফেরার কারণে ঘুম ভাঙতে ১১-১২টা বেজে যায়। উঠেই ফোনে চোখ বোলান কিছুক্ষণ। বারান্দায় গিয়ে আলো-ছায়ার খেলা উপভোগ করেন। সেই সঙ্গে কিছুটা সময় বাইরে তাকিয়ে আপন মনে দেখেন সবুজের সতেজতা। পোষা বিড়াল মিনি, ব্রাউনি ও তেনজিংকে সময় দেন নিয়ম করেই। এসব কাজ শেষে কিচেনে ঢোকেন ব্রেকফাস্ট প্রস্তুত করতে। মেনুতে থাকে ওমলেট, টোস্ট। পছন্দ করেন কফি অথবা অরেঞ্জ জুসের মতো পানীয়। দিনের প্রথম আহার সারতেই বেজে যায় বেলা ১টা-২টা!
মধ্যাহ্নভোজ সারতেও একটু দেরি হয় তার। মেনুতে থাকে লাল চালের ভাত, সবজি, মাছ, ডাল। স্টেজ পারফরম্যান্স কিংবা গানের রেকর্ডিং থাকলে বিকেল ৫টা থেকে শুরু করেন প্রস্তুতি। বন্ধুবান্ধব প্রসঙ্গে বলেন, ‘মানুষ হিসেবে আমি কিছুটা অসামাজিক! মনমানসিকতা যাদের সঙ্গে মেলে, তাদের মধ্য থেকেই কারও কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাই আমার জীবনে বন্ধুর সংখ্যা হাতে গোনা। ওদের সঙ্গে সাধারণত বাসাতেই আড্ডাবাজি করি।’
নন্দিতা আয়োজন করে রান্না করতে ভালোবাসেন। নিজে যতটা খেতে ভালোবাসেন, তার চেয়ে অন্যদের দাওয়াত করে খাওয়াতে বেশি ভালো লাগে তার। এই রান্নাপ্রীতি মূলত লকডাউন সময়কালে শুরু। সে সময় ইউটিউবে রান্নার নানা রকম ভিডিও দেখে শুরু করেছিলেন; এমনকি শিখে নিয়েছেন পিৎজা বানানোও। নানা পদের রান্না করলেও তার হাতের পোলাও, রোস্ট, ক্রিম অব মাশরুম স্যুপের রয়েছে বিশেষ সুনাম। তা ছাড়া আলাদা করে বলতেই হবে দই বড়ার কথা।
নিজের বাসা মনমতো সাজিয়েছেন এই গায়িকা। হলুদাভ ওয়ার্ম লাইট তার পছন্দ। ঘরের ছিমছাম পরিপাটি আবহে দেখা মেলে ভিনটেজ ও ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের ফার্নিচারের। তিনি একজন মেমোরিজ কালেক্টরও। হয়তো সে জন্যই তার বাসায় রয়েছে ব্রিটিশ আমলের ফার্নিচার।
নন্দিতাকে শাড়িতে দারুণ নান্দনিক, আত্মবিশ্বাসী ও মার্জিত দেখায়, এ কথা মোটামুটি সর্বস্বীকৃত। বললেন, ‘আমি শাড়ি পরতে ও সংগ্রহ করতে অসম্ভব পছন্দ করি। তবে আবহাওয়া গরম থাকলে কমফোর্টকেই প্রাধান্য দিই। সে ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা টি-শার্ট ও প্যান্ট পরেই হয়তো চলে যাই নানা জায়গায়। তবে হ্যাঁ, বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে শাড়িতেই আমার আস্থা। আর পছন্দের রং হলুদ।’
অ্যান্টিক ছোট ঝুমকা, আংটি, অক্সিডাইজড জুয়েলারি, কাচের চুড়িতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন। ফ্যাশনে ট্যাটু দিয়েছে তাকে ভিন্নমাত্রা। জানালেন, তার জীবনে একজন গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল ছিলেন, যিনি ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সংসারজীবন—যেকোনো ঝামেলায় দিতেন নানা পরামর্শ; সব সময় বলতেন, ‘ফিগার ইট আউট’। সেখান থেকে প্রাণিত হয়েই নিজের ডান হাতে থাকা ট্যাটুতে ‘ফিগার ইট আউট’ কথাটি লিখে রেখেছেন নন্দিতা। ওই গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল অন্য কেউ নন, ২০১৯ সালে অকালপ্রয়াত গায়ক ও সংগীত পরিচালক পৃথ্বীরাজ।
স্টাইলিংয়ে লম্বা চুলের জুড়ি মেলা ভার—এমনটা মনে করা নন্দিতাকে আজকাল সাধারণত লং বব হেয়ার কাটেই দেখা যায়! আর তা স্বস্তির জন্যই। কৃত্রিমতা এড়াতে এবং নিজের স্কিন টোন যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে মেকআপ নিজে করেন। সবকিছুর পরে চাই পারফিউম। এ ক্ষেত্রে পছন্দের ব্র্যান্ড শ্যানেল, লো ফ্লরেন্ট, গুচি।
ভ্রমণ করতে ভীষণ ভালোবাসেন নন্দিতা। চষে বেড়িয়েছেন দেশ ও দেশের বাইরের নানা প্রান্তে। পাহাড় বেশি টানে তাকে। সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন ‘হ্যাভেন অন আর্থ’খ্যাত কাশ্মীরে। সেখানকার সবুজ পাহাড়, উচ্ছল নদী, ঢেউ খেলে যাওয়া উপত্যকার প্রান্তে পাইন বনের সারি, সোনালি সূর্যোদয়, ঘন নিবিড় মেঘের দল, ঝমঝম বৃষ্টি তাকে প্রকৃতির প্রতি ঋণী করে তুলেছে আরও একবার। ভ্রমণে দেশে সাজেক এবং বিদেশের মধ্যে ‘সিটি অব জয়’খ্যাত কলকাতা ও কাশ্মীর তার সবচেয়ে পছন্দের স্পট।
ছোটবেলায় বই পড়ার দারুণ অভ্যাস ছিল। ছুটে যাওয়া সেই অভ্যাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। পছন্দের লেখক সমরেশ মজুমদার ও বুদ্ধদেব বসু। গানের মানুষ নন্দিতা সময় পেলেই গান শুনতে পছন্দ করেন, তা সহজেই অনুমেয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তার কাছে পূজনীয়, আরাধনা করার মতো আইকনিক গায়িকা। এ ছাড়া হৈমন্তী শুক্লা, শিপ্রা বসু, শাকিলা জাফর, হরিহরণ, আচার্য জয়ন্ত বোসের গান বেশ ভালো লাগে। তাদের মধ্যে শাকিলা জাফরকে শুধু পছন্দের গায়িকাই নয়, স্টাইল আইকন হিসেবেও মানেন।
অবসরে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সিনেমা ও টিভি সিরিজ দেখতে ভালো লাগে নন্দিতার। পর্দায় ‘ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ড’ বিষয়ক কনটেন্টও পছন্দ। তার পছন্দের শীর্ষে জাপানিজ মাস্টার অ্যানিমেটর ও ফিল্মমেকার হায়াও মিয়াজাকির যেকোনো কাজ। আর্ট হাউস থেকে শুরু করে কমার্শিয়াল—সব ধরনের সিনেমাই দেখেন। অপর্ণা সেন তার অন্যতম পছন্দের ফিল্মমেকার। সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, মাইকেল গন্ড্রির ‘এটারনাল সানশাইন অব দ্য স্পটলেস মাইন্ড’, পিটার ওয়্যারের ‘দ্য ট্রুমেন শো’, পিটার জ্যাকসনের ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ পছন্দের সিনেমা। পছন্দের টিভি সিরিজ ‘এন্ড অব দ্য ফাকিং ওয়ার্ল্ড’, ‘ব্রেকিং বেড’, ‘আর্কেন’, ‘অ্যাভাটার: দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার,’ ‘লিজেন্ড অব কররা’ প্রভৃতি। তার সেলিব্রিটি ক্রাশ শার্লক হোমস ও ডক্টর স্ট্রেঞ্জখ্যাত অভিনেতা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ।
রাতে কাজ না থাকলে ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে নৈশভোজ সারার চেষ্টা থাকে নন্দিতার। কাজ থাকলে যথারীতি একটু দেরিতে খাওয়া হয়। রাতের পাতের মেনু অনেকটা মধ্যাহ্নভোজের মতোই। এই গায়িকার সবচেয়ে প্রিয় খাবার সুশি।
জীবনদর্শন সম্পর্কে নন্দিতা বলেন, ‘চারপাশের সবকিছুর প্রতি সমব্যথী হওয়া চাই আমাদের। সকল সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে এবং সহানুভূতিশীল হতে পারলে সমাজ অনেক সুন্দর হবে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মতের ভিন্নতা থাকবেই; এই ভিন্নতাই সুন্দর। মত বা আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও কাউকেই জাজমেন্ট করা ঠিক নয়।’

 ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top