বহুরূপী I আলু আলোকপাত
খুবই চেনা সবজি। নিত্য ব্যবহারের। একে ছাড়া যেন বাঙালির চলেই না! কন্দজাতীয় এই সবজি জন্মায় মাটির নিচে। বলছি আলুর কথা। এটি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম খাদ্যশস্য; ভুট্টা, গম ও চালের ঠিক পরপরই অবস্থান।
আলুরও রয়েছে নানান প্রকার। সবার আগে বলা যাক সাধারণ আলু বা গোল আলুর কথা। ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেনীয় অনুসন্ধানকারীরা প্রথম পেরু থেকে স্পেনে এই আলু নিয়ে আসেন। সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর আমেরিকায় আলু পৌঁছায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের হাত ধরে, সেই শতাব্দীতেই। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি আয়ারল্যান্ডে প্রধান খাদ্যশস্যের স্বীকৃতি পায়। মিষ্টি আলু থেকে আলাদা করার জন্য এই আলুকে সেখানে নামকরণ করা হয় ‘আইরিশ আলু’। বিশ শতকে মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশেষত জার্মানিতে আলু আর্থসামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৮৪৭ সালে ‘দ্য গার্ডিয়ান মান্থলি’ ম্যাগাজিনে উপমহাদেশে এই আলু চাষের প্রথম রেকর্ড পাওয়া যায়। কলকাতার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এর ব্যাপক উৎপাদন হয়। তবে এই উপমহাদেশে প্রথম আলুর চাষ চেরাপুঞ্জিতে হয়েছিল বলে জানা যায়। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ থেকে ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত ওই অঞ্চলে তৎকালীন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ছিলেন। তার উদ্যোগেই মুম্বাইসহ ভারতের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে গোল আলু।
আলু একটি তৃণজাতীয়, বর্ষজীবী ফসল। সাধারণত দুই থেকে তিনটি চোখবিশিষ্ট কন্দের খণ্ডাংশ রোপণের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। বীজ থেকে একই জাতের হুবহু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ মেলে না। কা- সোজা বা ভূশায়ী, লিকলিকে, কাক্ষিক-শাখাযুক্ত অথবা শাখাবিহীন হয়ে থাকে। জাতের ওপর নির্ভর করে কা- হয় গোলাকার অথবা কৌণিক, লোমযুক্ত অথবা মসৃণ, সবুজ কিংবা ঈষৎ রক্তবর্ণযুক্ত।
জাম আলু পাওয়া যায় আমাদের দেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলে। জামের মতো আকৃতি ও রঙের কারণে এমন নামকরণ। অন্যদিকে, শাখ আলু মূলজাতীয় সবজি। এটি চিরহরিৎ লতাজাতীয় লিগিউম উদ্ভিদ, যা লম্বায় ৬ মিটার। এর মূলের খোসা সাদাটে বাদামি, ভেতরটা সাদা, শালগম আকৃতির। একটি গাছে দুই বা ততোধিক আলু ফলে; আকৃতি ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার। এই আলু বেশ রসাল ও মিষ্টি। খোসা ছাড়িয়ে কাঁচা খাওয়া যায়। রান্নার প্রক্রিয়াও সহজ। শাখ আলুতে স্টার্চ ও আমিষ থাকে ৯ শতাংশ। এর পাতায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আমিষ থাকে। এই পাতা খাওয়া যায়। এর আদি নিবাস লাতিন আমেরিকা। বিশেষ করে আমাজন অঞ্চলে এর চাষাবাদ হয়ে থাকে। একটু স্যাঁতসেঁতে বেলে এবং বেলে-দোআঁশ মাটি এই আলু চাষের জন্য উপযুক্ত। ছায়া ও তুষার সহ্য করতে পারে না বলে এর চাষে একটু উঁচু বেড তৈরি করে নেওয়ার দরকার পড়ে।
আমাদের দেশে মিষ্টি আলুর বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। এই আলুতে গোল আলুর সব গুণ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও উপকারী তন্তু। সুস্থ থাকতে, ক্যানসার মোকাবিলায়, বহুমূত্র রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং মূত্রথলির নানা জটিলতা রোধে প্রাকৃতিক পথ্য হিসেবে মিষ্টি আলুর কদর রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হৃৎপিণ্ডের সুস্থতা, ত্বকের সৌন্দর্য, এমনকি চোখ ভালো রাখতেও উপকারী।
মেটে আলুর আদি নিবাস এশিয়ার ক্রান্তীয় অঞ্চল। একবার ফলন দেওয়ার পরই এর গাছ মারা যায়। পরের বছর মূল থেকে চারা গজায়। এর কাণ্ডের গায়ে ছোট ছোট কালচে বেগুনি রঙের আলু ফলে। মাটির নিচে বড় আকারের বাদামি রঙের আলু হয়। নিচের আলু প্রতিবছর একটু একটু করে বড় হয়। এই আলু দীর্ঘকাল ধরে বড় হতে পারে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এটি প্রধান খাদ্য। মেটে আলু ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের দারুণ উৎস। প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম আর সোডিয়ামও রয়েছে এতে।
এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য জাতের মধ্যে পেস্তা আলু, শিমুল আলুও আমাদের দেশে বেশ প্রচলিত।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট