পাতে পরিমিতি I স্ট্রোক প্রতিরোধী আহার
২৯ অক্টোবর। ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক ডে। স্ট্রোক প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ। খাবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কীভাবে স্ট্রোক রোখার সম্ভাবনা বাড়ে? জানা যাক পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির কাছ থেকে
সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে ফুড হেবিট ও লাইফস্টাইলেও পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। সবটাই যে ইতিবাচক, তা নয়; ক্ষেত্রবিশেষে নেতিবাচকের দাপট প্রবল। উচ্চ রক্তচাপ ও ডিজলিপিডেমিয়ার কথা আজকাল হরদম শোনা যায়। এর নেপথ্যে বড় ধরনের কলকাঠি নাড়ে ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড। অথচ আমাদের অনেকের কাছেই হ্যাং আউট বা আড্ডাবাজি মানেই এ ধরনের খাদ্যের সমারোহ। বিশেষত শহুরে জায়গাগুলোতে দালানকোঠার ভিড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে, একইভাবে বিলীন হচ্ছে দেশীয় খাবারের অনেক প্রথাও। সেই সঙ্গে বিবিধ রোগের পরিবর্তনেরও মিলছে দেখা।
রক্তে চর্বির উপস্থিতি উচ্চ মাত্রায় থাকলে শরীরে নানা সমস্যা হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে হার্ট ও মস্তিষ্কের ধমনিগুলো। এতে হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বাড়ে দ্বিগুণ।
স্ট্রোক এমনই একটি বিষয়, যাতে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে ধমনিগুলোতে চাপ তৈরি হওয়ার ফলে ধমনি ছিঁড়ে যায় কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে রোগীর প্যারালাইসিস, মুখের কোনো নির্দিষ্ট অংশ বাঁকা হয়ে যাওয়া, কাউকে চিনতে না পারা ইত্যাদি নানা সমস্যা হয়ে থাকে। স্ট্রোকের সাধারণত কোনো পূর্ব লক্ষণ থাকে না; তবে অস্বাভাবিক রক্তচাপ দীর্ঘদিন থাকলে এর ঝুঁকি বাড়ে। তাই রক্তচাপ যেন স্বাভাবিক থাকে, তা সব সময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখা চাই। এ ক্ষেত্রে খাবারদাবার নিয়ন্ত্রণ ও লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনা জরুরি।
পথ্য-বাহার
স্ট্রোক প্রতিরোধে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন-
গ্রিন অ্যাপেল: বলা হয় প্রতিদিন একটি আপেল গ্রহণ আপনাকে ডাক্তারের কাছ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে। সত্যি তাই। যারা নিয়মিত আপেল খান, তাদের পক্ষে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা তুলনামূলক সহজ হয়; কোলেস্টেরল হ্রাস পায়। তা ছাড়া এই ফলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহ চাঙা রাখতে সাহায্য করে।
চিয়া সিড: ওমেগা থ্রি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ চিয়া সিড দেহের ওজন কমাতে ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। তাই চিয়া সিড গ্রহণ করতে পারেন রাতে ঘুমানোর আগে অথবা সকালে।
ডার্ক চকলেট: স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে ওজন হওয়া চাই সুনিয়ন্ত্রিত। যাদের চকলেট খুবই ফেভারিট, অথচ ওজন বাড়ার ভয়ে তা থেকে দূরে থাকেন, তারা খাদ্যতালিকায় বেছে নিতে পারেন ডার্ক চকলেট। এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, আয়রন, জিংক ও ম্যাগনেশিয়াম। স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালনের পাশাপাশি ব্রেন ফাংশন ঠিক রাখতে সপ্তাহে দু-এক দিন পরখ করে নিতে পারেন ডার্ক চকলেটের স্বাদ।
স্পিনাচ: পালংশাক বা স্পিনাচ বিশ্বের প্রায় সবখানেই জনপ্রিয়। পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-সি যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় এ শাকে, যা স্ট্রোক প্রতিরোধে বেশ সহায়ক।
সাধু সাবধান!
রক্তচাপ যাদের অনিয়ন্ত্রিত, সুস্থ থাকার জন্য তাদের ক্ষেত্রে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিক খাবার রান্না করার জন্য হলেও প্রতিদিনই আমাদের লবণ ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। তা ছাড়া প্রায়শই খাদ্যতালিকায় কিছু হিডেন সল্টি ফুড জায়গা করে নেয়, হয়তো অজান্তেই। আমরা সবাই যেহেতু কমবেশি জানি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বাড়তি লবণ গ্রহণ অনুচিত; তবু খাবার প্লেটে লবণ না হলে যাদের চলেই না, তাদের কেউ কেউ মনে করেন, এটি ভেজে কিংবা রোদে শুকিয়ে গ্রহণ করলে কোনো অসুবিধা হয় না। অথচ এই ধারণা পুরোদস্তুর মিথ! মনে রাখা চাই, লবণ হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড, যা তাপে নষ্ট হয় না। তাই যাদের ব্লাড প্রেশার সব সময় হাই, তাদের যেকোনো লবণই পরিমাণ অনুযায়ী গ্রহণ করা দরকার। দিনে সাধারণত দুই থেকে পাঁচ গ্রাম লবণ খাওয়া যেতে পারে। তবে বিভিন্ন ধরনের খাবার গ্রহণ করার ফলে এই লিমিটেশন সব সময় সমন্বয় করা সম্ভব হয় না। লবণাক্ত খাবার গ্রহণ বন্ধ করা না গেলে সকল প্রচেষ্টাই বিফলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে খাদ্যতালিকা থেকে কিছু খাবার সরিয়ে ফেলা একান্ত জরুরি; যেমন-
শুঁটকি: তাজা মাছ ও শুঁটকির মধ্যে পুষ্টি উপাদানের নানা তারতম্য রয়েছে। শুধু লবণের পরিমাণ আমলে নিলেই দেখা যায়, অতিরিক্ত লবণ ছাড়া শুঁটকির প্রক্রিয়াজাত সম্পন্ন হয় না। তাই আপনি যদি শুঁটকি খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে থাকেন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে চাইলে খাদ্যতালিকা থেকে এ খাবার সরিয়ে ফেলা উত্তম।
চিপস: রাত জাগলেই অনেকের অভ্যাস থাকে চিপস গ্রহণ করার। অথচ চিপস যত সুস্বাদু হোক, এটি লবণাক্ত খাবারের একটি বিশেষ উদাহরণ। চিপসের প্যাকেটের পুষ্টি উপাদানে নজরদারি করলেই বুঝতে পারবেন, এ থেকে কতটুকু লবণ আমাদের শরীরে গ্রহণ করে ফেলছি। তাই রাত জেগে কাজ করা কিংবা বিনোদনমূলক সময় উপভোগÑ উপলক্ষ যা-ই হোক, চিপস গ্রহণ হতে পারে আপনার অসুস্থতার অন্যতম কারণ।
প্যাকেটজাত স্যুপ: স্যুপ বেশ হেলদি ও টেস্টি। তবে অনেকে হয়তো জানেন না, প্যাকেটজাত স্যুপে অতিরিক্ত লবণ কিংবা মসলা অলরেডি অ্যাডজাস্ট করে দেওয়া থাকে। সে ক্ষেত্রে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে প্যাকেটজাত স্যুপ গ্রহণ না করে, বাসায় হেলদি ওয়েতে তা রান্না করাই শ্রেয়।
নুডলসের মসলা: নুডলস খুবই সুস্বাদু একটি স্ন্যাকস বা মিল। নুডলসের স্বাদ বাড়ানোর জন্য প্যাকেটে বাড়তি মসলা আলাদাভাবে দেওয়া থাকে। কিন্তু যাদের রক্তচাপ বেশি, তারা নুডলসে সেই বাড়তি মসলা যোগ করলে এতে থাকা লবণের কারণে বিপদে পড়তে পারেন। তাই বাড়তি মসলাগুলো বাদ দিয়েই নুডলস রান্না করা স্বাস্থ্যসম্মত। এতে থাকা টেস্টিং সল্ট শরীরের জন্য হ্যাজার্ড। তা ছাড়া প্রসেসড ও রেডি টু ইট খাবারগুলোতেও অতিরিক্ত লবণের ব্যবহার রয়েছে। তাই খাদ্যতালিকায় এ ধরনের খাবার পারতপক্ষে না রাখা মঙ্গল।
থাকুক খেয়াল
মনে রাখা চাই, শারীরিক ওজন বাড়তি হলেও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। কেননা, অতিরিক্ত ওজন রক্তে চর্বির মাত্রা বাড়িয়ে আমাদের আনহেলদি করে তোলে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ডিজলিপিডেমিয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অন্যান্য সমস্যাও কম হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সে ক্ষেত্রে খেতে পারেন ব্রাউন রাইস, মিক্সড ফ্রুট স্যালাদ, রায়তা ইত্যাদি।
যারা ওজন সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রোক নিয়ে ভীষণ চিন্তিত, তারা হরদমই যথাযোগ্য রেসিপি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। দুশ্চিন্তা কমিয়ে, হেলদি ব্রেকফাস্ট হিসেবে রাখতে পারেন এই ধরনের রেসিপি-
মিক্সড নাটস উইদ ইয়োগার্ট ওটমিল:
উপকরণ: ওটস; ইয়োগার্ট; মিক্সড নাটস- আমন্ড, কাজুবাদাম, ওয়াল নাট, সানফ্লাওয়ার সিড, চিয়া সিড।
প্রণালি: সকল উপকরণ সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। তারপর সকালে দ্রুত মিক্স করে নিলেই খাওয়ার জন্য রেডি।
একটু সচেতনতাই আমাদের সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। পাশ্চাত্য খাবারগুলোকে হেলদি প্রসেসে গ্রহণ করা হলে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয় না। রান্নায় ব্যবহৃত তেলের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখা চাই, সেটি কতটা স্বাস্থ্যবান্ধব। অনেকে রান্নার সময় তেল বাড়তি হয়ে গেলে তা রেখে দিয়ে পুনরায় ব্যবহারের চেষ্টা করেন। এটি বিপজ্জনক অভ্যাস। কেননা, এর ফলে ওই তেলে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়ে যায়। তাই খেয়াল রাখা চাই, অতিরিক্ত তেল ব্যবহার না করে, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু দিয়ে রান্নার চেষ্টা করতে হবে। কী ধরনের তেল ব্যবহার করবেন, তা অবশ্য অনেকটাই নির্ভর করছে আপনার আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর। তবে রান্না যেন স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে হয় এবং রান্নার পরও যেন খাবারে তেল ভেসে না থাকে, তা খেয়াল রাখা জরুরি। পরিমাণ ঠিক রেখে খাবার গ্রহণ করলে স্ট্রোকের মতো মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট