দেহযতন I ওয়েডিং ওয়ার্কআউট
বিয়ে আসন্ন, কিন্তু শরীর ফিট তো? রয়েছে বিশেষ দেহচর্চা। চেষ্টা করে দেখতে পারেন
বিয়ের দিন আপনার হয়তো স্যুটজাতীয় পোশাক পরার ইচ্ছা আছে, অথচ শরীরের মাঝখানে একটু টাইট হওয়ার বেধে গেল গোলমাল! হয়তো এদিন নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন, তাতে পড়ে গেল কিঞ্চিৎ গুড়েবালি! অথবা এরই মধ্যে গাউন কিনে রেখেছেন, অথচ বিয়ের দিন এতে নিজেকে কেমন লাগবে—তা নিয়ে উৎকণ্ঠার শেষ নেই। আপনার করা চাই ওয়েডিং ওয়ার্কআউট। তবে তা হেলায় নয়; যথাযোগ্য পরিকল্পনায়। দৈহিকভাবে শুধু ফিট দেখানোর জন্য নয়, দাম্পত্য জীবনেও রয়েছে এর গুরুত্ব।
এ বিষয়ে সার্বিক গাইডলাইন দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সার্টিফাইড ফিটনেস ট্রেইনার সাদিয়া শীলা। তার মতে, এই বিশেষ দিনে দুর্দান্ত দেখাতে ক্র্যাশ ডায়েট গ্রহণ কিংবা জিমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করার দরকার নেই; বরং বিয়ের কয়েক মাস থেকে শুরু করে আগের দিন পর্যন্ত ফিটনেস রুটিন সম্পর্কে হওয়া চাই কৌশলী।
প্রশ্ন আসতেই পারে, বিয়ের কত দিন আগে থেকে ওয়ার্কআউট শুরু করা উচিত। শীলার মতে, ৩ থেকে ৬ মাস আগে ফিটনেস রুটিন সম্পর্কে এ ভাবনা শুরু হোক। এই সময়সীমা ধরতে পারলে শরীরের ওপর যেমন বেশি চাপ পড়বে না, তেমনি একটি অর্থবহ পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা বাড়বে। তা ছাড়া ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ইট’স নেভার টু লেট টু স্টার্ট ওয়ার্কআউট। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, ‘এমনকি সামান্য ওজন কমলেও বড় ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। শরীরের বাড়তি ওজনের ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমাতে পারলে রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও রক্তে শর্করার মাত্রা তুলনামূলক নিয়ন্ত্রণে থাকে।’
এদিকে, পোশাকের সঙ্গে শরীরের সামঞ্জস্য রাখতে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা শুরুর প্রতি গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। শীলার মতে, বিয়ের সময় যতই বাকি থাকুক, আপনি যখন করিডরে হাঁটবেন, নিজের সেরাটা অনুভব করা চাই। সর্বোত্তম উপায় হলো জীবনধারায় টেকসই পরিবর্তন আনা। তার অর্থ স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা। শুধু শরীর বা চেহারা নয়, সম্পূর্ণভাবে নিজের ওপর ফোকাস করাও গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত ঘুম, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানোর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া চাই। আর শরীরের যত্নে?
বিয়ের আগের সপ্তাহগুলোতে শরীরকে প্রস্তুত করতে স্লিম ডাউন ও টোনআপ করার সর্বোত্তম উপায় হলো শারীরিক কসরত। এটি আপনার মেজাজের উন্নতি ঘটাতে এবং বিবাহ পরিকল্পনা চলাকালীন মাথা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করবে। সিডিসির মতে, প্রাপ্তবয়স্করা প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিট মাঝারি-তীব্রতার অ্যারোবিক অ্যাকটিভিটি (যেমন দ্রুত হাঁটা) অথবা ৭৫ মিনিট তীব্র অ্যারোবিক অ্যাকটিভিটি (যেমন দৌড়) করলে সুফল পাবেন। প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেন্থ ট্রেনিং করতে পারেন। এতে সুফল মেলার হার বেশ। এই ওয়ার্কআউট প্ল্যান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য।
প্রথম চার সপ্তাহ
ওয়েডিং ওয়ার্কআউট ধীরে ধীরে শুরু করা এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্রতা বাড়ানো চাই। লক্ষ্য থাকা উচিত, প্রতি সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট ধরে এই দেহচর্চায় রত থাকা।
প্রতি সপ্তাহ (দুই দিন স্ট্রেন্থ ট্রেনিং এবং দুই দিন কার্ডিও): প্রথম দিন ৩০ মিনিট কার্ডিও (ট্রেডমিল, এলিপটিক্যাল, সুইমিং); দ্বিতীয় দিন লোয়ার বডি ওয়ার্কআউট (স্কোয়াট, লাঞ্জ, ডেডলিফট এবং গ্লুট ব্রিজ, ১০-১২টি করে, ২-৩ সেট); তৃতীয় দিন ৩০ মিনিট কার্ডিও; চতুর্থ দিন আপার বডি ওয়ার্কআউট (পুশআপ, ওভারহেড প্রেস এবং ট্রাইশেপ ডিপ ১০-১২ বার করে, ২-৩ সেট)।
দ্বিতীয় মাস
এ সময় ওয়ার্কআউটের মৌলিক বিষয়গুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করা এবং শারীরিক কসরতের তীব্রতা বাড়ানোর চেষ্টা চালানো জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রগ্রেসিভ ওভারলোডের নীতি প্রয়োগ করুন; অর্থাৎ নিজে শক্তিশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরকে নতুন উপায়ে চ্যালেঞ্জ জানানো দরকার। এর অর্থ লিফটে ওজন যোগ করা, আরও রিপিটেশন করা এবং কার্ডিওর সময়কাল ও তীব্রতা বাড়ানো।
ওপরের ওয়ার্কআউটের ওপর ভিত্তি করে দিনে ৩০ মিনিটের পরিবর্তে ৪৫ মিনিটের কার্ডিও করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অথবা আপনার স্ট্রেন্থ ট্রেনিংয়ের জন্য ১২-১৫ বার করে ৩ সেট অনুশীলন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে এমন একটি ওজন নির্বাচন করুন, যা চ্যালেঞ্জিং মনে হবে; পাশাপাশি তা যেন উত্তোলন করার মতো হয়ে থাকে।
আপনি যদি উচ্চাভিলাষী বোধ করেন, তাহলে অনুশীলনের সময়সূচিতে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করে নিন। তবে অবশ্যই নিজের শরীর বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া চাই।
তৃতীয় মাস
বিয়ের আগে শেষ মাসে প্রবেশ করা মানে আপনার দক্ষতা ও ফর্ম নিখুঁতের ওপর ফোকাস করার সময় চলে এসেছে। এটি আঘাত এড়াতে এবং সর্বাধিক সুফল পেতে সাহায্য করবে। যদি এখন পর্যন্ত ওয়ার্কআউট প্ল্যানটি অনুসরণ করে থাকেন, তাহলে এত দিনে আপনার শরীর একটি ভালো শেপে চলে আসার কথা। এই মুহূর্তে, আপনি একজন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষকের সঙ্গে কাজ করা কিংবা নিজেকে আরও এগিয়ে নিতে গ্রুপ ফিটনেস ক্লাসে যোগ দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। ৪৫ থেকে ৬০ মিনিট সময়ব্যাপ্তি ধরে সপ্তাহে ৪ থেকে ৫ দিন ওয়ার্কআউট করা চাই। এর মধ্যে স্ট্রেন্থ ট্রেনিং, কার্ডিও এবং এইচআইআইটির (হাই ইন্টেনসিটি ইন্টারভাল ট্রেনিংস) অন্তর্ভুক্তি দরকার। এইচআইআইটি হলো ক্যালরি বার্ন করা এবং কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর এক দারুণ উপায়। একটি সময়কালের পর বিকল্প উপায়ে এটি করা যেতে পারে। যেমন ধরুন, আপনি ৩০ সেকেন্ড দ্রুতগতিতে দৌড়ানোর পর ৬০ সেকেন্ড হাঁটতে পারেন। এই চক্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে পুনরাবৃত্তি করুন।
বিয়ের দিন সন্নিকটে বলে ক্রমবর্ধমান ব্যস্ত সময়সূচিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ওয়ার্কআউটের মাধ্যমে নিজেকে ফিট করার মতো পর্যাপ্ত সময় আপনার হাতে না-ও থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব, ততটুকু করাই শ্রেয়। এ নিয়ে মানসিক চাপে ভোগার দরকার নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিজেকে সক্রিয় রাখা এবং ফিটনেসকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
পুষ্টির নিশ্চয়তা
ব্যায়াম হলো স্বাস্থ্যকর জীবনধারার একটি অংশমাত্র। তাই আপনি কী খাচ্ছেন, সে বিষয়েও ফোকাস রাখা চাই। পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেলে ওয়ার্কআউটের সময় প্রয়োজনীয় শক্তি পাওয়া যাবে। এর অর্থ এই নয় যে আপনাকে ক্র্যাশ ডায়েট করতে হবে কিংবা নিজেকে খাবার থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক পন্থায় ডায়েট না করলে উল্টো ওজন বেড়ে যেতে পারে। বরং সম্পূর্ণ অপ্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণের দিকে মনোনিবেশ করুন, যা আপনার শরীরকে পুষ্টি দেবে এবং আপনাকে দেবে সেরা একটি অনুভূতি। প্রয়োজনে নিন কোনো পুষ্টিবিদের পরামর্শ।
ঘুমে প্রাধান্য
বিয়ে যখন আসন্ন, স্বাভাবিকের চেয়ে অবসর সময় কম মেলে। কাজ, ওয়ার্কআউট, বিয়ের পরিকল্পনা এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর ফলে রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের সুযোগ পাওয়া ভার। অথচ ঘুম কম হলে শরীরচর্চা করার শক্তি কম থাকে। ফিটনেসে ঘাটতি এলে অস্বাস্থ্যকর খাবার পছন্দ করার প্রবণতা বাড়ে। তা ছাড়া এ সময়ে মানসিক চাপ বাড়ার কারণেও ঘুম ব্যাহত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বানিয়ে নিতে পারেন বিশেষ রুটিন, যেন প্রতি রাতে পর্যাপ্ত সময় ধরে ঘুমানোর নিশ্চয়তা থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘুমের আগে বই পড়া, গোসল কিংবা স্ট্রেচিং করা ভালো ফল এনে দিতে পারে।
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
এ সময়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন বোধ করা স্বাভাবিক। তবে স্ট্রেস যদি আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তাহলে বিপদ! তাই নিজেকে চাপমুক্ত ও শিথিল রাখার উপায় খুঁজে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানসমর্থিত তিনটি কৌশল জানিয়েছেন সাদিয়া শীলা। চলুন, জানি:
যোগব্যায়াম: এটি স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলসহ স্ট্রেসের প্যারামিটার কমাতে সাহায্য করে। বিগিনার লেভেলের যোগব্যায়াম ভঙ্গি শরীরে নমনীয়তা ও শক্তি বাড়াতে কাজে দেয়। এর জন্য কোনো সরঞ্জামের দরকার পড়ে না।
ধ্যান: উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা ও ব্যথা কমাতে এটি সাহায্য করে। আপনি যদি ধ্যানে নতুন হয়ে থাকেন, তাহলে একটি নির্দেশিত মেডিটেশন অ্যাপের সাহায্য নিয়ে শুরু করতে পারেন। যদি বসে বেশিক্ষণ স্থির থাকতে না পারেন, দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কেননা, মাত্র কয়েক মিনিটের ধ্যানও বেশ উপকারী।
গভীর নিশ্বাস গ্রহণ: গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করার একটি সহজ অথচ কার্যকর উপায়। এভাবে চেষ্টা করুন: ১ থেকে ৪ গণনা পর্যন্ত শ্বাস নিন, ১ থেকে ৭ গণনা পর্যন্ত শ্বাস ধরে রাখুন এবং ১ থেকে ৮ গণনা পর্যন্ত শ্বাস ছাড়ুন। এই চক্র ৫-১০ মিনিট পুনরাবৃত্তি করুন।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট