দৃশ্যভাষ্য I চাহনি অথবা চাবুক
১ সেপ্টেম্বর ২০২১। ইতালির সিসিলির একটি মার্কিন ঘাঁটিতে পরিবারের সঙ্গে অল্পবয়সী একজন আফগান বালিকা, যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াগামী বিমানে ওঠার অপেক্ষায়। মেয়েটির বয়স ৯ বছরের মতো। আগস্টে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ তালেবানরা নেওয়ার পর কাবুল থেকে মিত্রবাহিনী যে এক লাখের বেশি মানুষকে সরিয়ে এনেছিল, সে তাদেরই একজন।
তার এই অপেক্ষারত মুহূর্তের ছবি ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার জন্য তুললেন ইতালিয়ান আলোকচিত্র-সাংবাদিক আলেসসিও মামো। সেই ছবি ছাপা হলো পত্রিকাটির যুক্তরাজ্য মুদ্রণ সংস্করণের প্রথম পৃষ্ঠায়। আর তা মুহূর্তে বহু পাঠককে মনে করিয়ে দিল আমেরিকান ফটোগ্রাফার স্টিভ ম্যাককারির তোলা বিখ্যাত আলোকচিত্র ‘আফগান গার্ল’-এর কথা। ম্যাককারির তোলা, শারবাত গুলা নামের এক পাস্তুন বালিকার সেই ছবি ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ ম্যাগাজিনের জুন ১৯৮৫ সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপা হওয়ার পর রাতারাতি শুধু আফগানিস্তানেরই নয়, সারা দুনিয়ার বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের একটি প্রতীকচিত্রে পরিণত হয়েছিল।
প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ছবি দুটির মধ্যে পার্থক্য অনেক; তবু দুই সময়ের এই দুই আফগান বালিকার মধ্যে কিছু বিস্ময়কর রকমের মিলও রয়েছে। আর তা দৈহিক ও ইতিহাসগত—উভয় বিবেচনায়। দুই বালিকারই চোখের রং গাঢ় সবুজ; দুজনের মাথা লাল ওড়নায় ঘোমটা দেওয়া। সবচেয়ে বড় কথা, সময়কালের মধ্যে ৩৫ বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও উভয় আলোকচিত্রেরই বিষয়বস্তু হলো শরণার্থী।
দুটি ছবিকে একসঙ্গে দেখলে অনুভব করা যায়, বিদেশি শক্তিগুলো বারবার আফগানিস্তানের দখল নিলেও ওই অঞ্চলের জীবনযাত্রার অস্থিরতা নিরসনে হরদম ব্যর্থই হয়েছে। ২০২১ সালের তোলা ছবিটি দেখে, গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যাককারি বলেন, ‘হ্যাঁ, এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে অনেক মিল। আফগানরা এখনো নিজেদের সেই একই দুর্দশার ভেতর খুঁজে পাচ্ছেন, যেমনটা তারা ছিলেন আশির দশকে। তারা নিরাপত্তা চাচ্ছেন, বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, খুঁজছেন আশ্রয়।’
বলে রাখি, নতুন ছবিটি নয়, আমাদের এবারের ‘দৃশ্যভাষ্য’-এর আলোচ্য আলোকচিত্র মূলটি; মানে, আশির দশকের মধ্যভাগে স্টিভ ম্যাককারির তোলা সেই আতঙ্কমাখা সবুজ চোখে তাকানো বালিকার ছবি। শারবাত গুলার সঙ্গে স্টিভ ম্যাককারির প্রথম দেখা হয়েছিল আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদারির সময়কালে, পাকিস্তানের নাসিরবাগ শরণার্থীশিবিরে। সোভিয়েত দখলদার শক্তি ও আফগান মুজাহিদীনের মধ্যকার সংঘাতের কারণে তখন লাখ লাখ আফগান নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। নিজ গ্রাম পূর্ব নানগারহারে সোভিয়েত বাহিনী বোমাবর্ষণ করলে তিন বোন, ভাই, দাদিসহ পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে, দুর্গম পার্বত্য রাস্তাগুলো হেঁটে পাড়ি দিয়ে, পাকিস্তানের একটি শরণার্থীশিবিরে পৌঁছেছিল সেদিনের সেই বালিকা শারবাত গুলা।
ম্যাককারি তখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে বিচরণ করে ওই সংঘাতের ওপর নজর রাখছিলেন আর ছবি তুলছিলেন। এই পরিস্থিতিতেই গুলার সঙ্গে প্রথম দেখা, তাতে সন্দেহ নেই ম্যাককারির। পরবর্তীকালে গণমাধ্যমে তিনি বলেছেন, ‘ওকে দেখামাত্রই বুঝে গেলাম, আমি আসলে একমাত্র এই ছবিটাই তুলতে চেয়েছিলাম।’
নাসিরবাগ শরণার্থীশিবিরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ে ছবিটি তুলেছিলেন ম্যাককারি। সেখানে তখন ক্লাস চলছিল। ক্লাসে ছিল ১৫ জন বালিকা। এদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যার চোখ জ্বলজ্বলে সবুজ। সে-ই গুলা। ওই চোখে থাকা আতঙ্কমিশ্রিত তীক্ষè দৃষ্টি হকচকিত করেছিল ম্যাককারিকে। নিরাপত্তার বেড়াজালে যারা জীবন কাটান, শরণার্থীর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি এ যেন ছিল চাবুকের তীব্র প্রহার! তা অনুধাবন করে, মুহূর্তেই ক্লিক করেছিলেন ম্যাককারি। কিন্তু বালিকা শারবাত গুলা তখন ওড়না দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলেছিল। তা দেখে তার শিক্ষক তাকে বলেছিলেন মুখ থেকে ওড়না আর হাত সরিয়ে নিতে; যেন তার কাহিনি সারা দুনিয়া জানতে পারে। শিক্ষকের পরামর্শ মেনে নিয়েছিল গুলা। আর তাতেই এই বহুল আলোচিত আলোকচিত্র ধরা পড়ে যায় ম্যাককারির ক্যামেরায়।
ছবিটি রাতারাতি প্রসিদ্ধ হলেও গুলার পরিচয় অবশ্য দীর্ঘকাল রহস্যই রয়ে যায়। অবশেষে, ২০০২ সালের জানুয়ারিতে ম্যাককারি ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক যৌথভাবে এক অভিযানের ব্যবস্থা করে এই তথ্য জানার জন্য যে, ছবির সেই বালিকা এখনো বেঁচে রয়েছে কি না। মাসের পর মাস অনুসন্ধান শেষে দেখা মেলে গুলার। তার ছবি আবারও তোলেন ম্যাককারি। আর জানতে পারেন, নিজ দেশে এই বালিকা ‘অসম্মতির প্রতীকে’ পরিণত হয়েছিল, তাকে হরদমই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’র সঙ্গে তুলনা টানা হতো; তবে জীবন তার জন্য সহজ ছিল না মোটেই। তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। এরপর কেটেছে তুমুল অনিশ্চয়তার ভেতর। বারবার বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে আসা-যাওয়ার মধ্যে।
এর মধ্যে জাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করে পাকিস্তানে অবৈধভাবে বসবাসের দায়ে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার হন গুলা। বলে রাখা ভালো, আইনি বিধানের বাইরে ওই দেশে বসবাসকারী আফগান বহু শরণার্থীর ক্ষেত্রে এটি নৈমিত্তিক ঘটনা। ব্যক্তিজীবনে গুলা পাঁচ সন্তানের জননী, যাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটেছে জন্মের পরপরই। তার স্বামী হেপাটাইটিস-সি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনিও ভুগেছেন এই অসুখে।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর, ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ হাজার ডলার জরিমানার মুখে পড়েন গুলা। অবশ্য দুই সপ্তাহ পর ছাড়া পান। আর সন্তানসহ তাকে ফেরত পাঠানো হয় তার জন্মভূমিতে। পাকিস্তান ছাড়ার আগে ‘এএফপি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই আফগান গার্ল বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তান শুধুই আমার জন্মস্থান, বরং পাকিস্তানই আমার দেশ। এ দেশকে সব সময়ই নিজের দেশ হিসেবে বিবেচনা করেছি। কিন্তু আমি হতাশ। কেননা, এ দেশ থেকে চলে যাওয়া ছাড়া আমার কাছে কোনো অপশন নেই।’ বলে রাখি, পাকিস্তান থেকে শুধু ২০১৬ সালেই ৩ লাখ ৭০ হাজার নিবন্ধনভুক্ত শরণার্থী আফগানিস্তানে ফিরে গেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বহু আফগান শরণার্থীকে ইরান ও ইউরোপ থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আর তা হরদমই জোর করে। অন্যদিকে গুলার মতো আরও বিপুলসংখ্যক অনিবন্ধিত শরণার্থী যে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন, সে কথা বলা বাহুল্য।
গুলার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অবশ্য বেশ ঘটা করেই হয়েছিল। তৎকালীন আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি নিজে তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন নতুন অ্যাপার্টমেন্টের চাবি। কথা দিয়েছিলেন, তার সন্তানদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবার ব্যবস্থা করবেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত এক ছোট্ট অনুষ্ঠানে গনি বলেছিলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, আবারও বলতে চাই, আমরা যত দিন আমাদের শরণার্থীদের সবাইকে ফিরিয়ে আনতে না পারব, আমাদের দেশ তত দিন অপূর্ণাঙ্গ রয়ে যাবে।’ কিন্তু কিছুদিন না যেতেই গুলার এক নিকটাত্মীয় আফগান গণমাধ্যমে অভিযোগ তোলেন, সরকার থেকে প্রতিশ্রুত সহযোগিতা তারা পাচ্ছেন না। আর, এখন, পরিবর্তিত শাসনব্যবস্থায় এই আফগান গার্লের জীবন কেমন চলছে, তা শুধুই অনুমানযোগ্য।
অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে, ১৯৮৫-এর আফগান গার্ল থেকে ২০২১-এর আফগান গার্লের দিকে তাকিয়ে, দুটি ছবির দুই বালিকার মধ্যে মূল যে পার্থক্য খুঁজে পান ম্যাককারি, তা হলো ওদের নিয়তি। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে যাচ্ছে যে বালিকা, পড়াশোনার প্রশ্নে সে তুলনামূলক বেশি সুযোগ পাবে বলে ধরে নেওয়া যায়।’ অন্যদিকে, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, আফগানিস্তানে বসবাসকারী শারবাত গুলার জীবন তালেবান শাসনের অধীনে অনেক বেশি অনিশ্চিত। এ নিয়ে খুব একটা কথা বলতে নারাজ ম্যাককারি। বললেন, ‘গুলাকে নিয়ে খুব বেশি আলাপ না করাই ভালো, ওর নিরাপত্তার স্বার্থে।’
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও পাবলিক ডেলিভারি ম্যাগাজিন
লাইফস্টাইল ডেস্ক