যাপনচিত্র I যুগল জীবন
সৌমিক আহমেদ ও ফাতেমা তুজ্ জোহ্রা। জনপ্রিয় ইউটিউবার ও ইনফ্লুয়েন্সার দম্পতি। দুজনই করপোরেট কর্মক্ষেত্রের বাসিন্দা। কাজের সূত্রেই পরিচয়। তারপর প্রেম, সংসার। এই যুগলের দাম্পত্য জীবনে দেওয়া যাক উঁকি
দুজনের অফিস টাইম ভিন্ন হওয়া জোহ্রা আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে যান। সকালের প্রথম অ্যালার্ম সেট করা থাকে তার জন্যই। তবে ঘুম থেকে ওঠানোর গুরুদায়িত্বটা পালন করতে হয় সৌমিককে। স্বামী-স্ত্রী সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যেই বিছানা ছাড়েন। ঘুম থেকে উঠে সৌমিক মেইল চেক করেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুঁ মারেন আর টিভি দেখে সময় পার করেন। জোহ্রা অফিসের উদ্দেশে বাসা ছাড়েন সাড়ে দশটায়। সকালে ব্রেকফাস্ট সৌমিক সাধারণত এড়িয়েই চলেন। জোহ্রার ব্রেকফাস্ট মেনুতে থাকে রুটি, ভাজি আর ডিম। দুপুরে দুজনেরই লাঞ্চ সারা হয় অফিসে। জোহ্রার মেনুতে থাকে স্যান্ডউইচ। সন্ধ্যায় জিমে যান বলে সৌমিকের দুপুরে খাবারের মেনু একটু হেভি। তার পছন্দ তেহারি।
অফিস শেষে সৌমিক নিয়মিতই ওয়ার্কআউট করেন, জিমে। একসময় দুজনের একসঙ্গে জিমে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও জোহ্রা ইদানীং কালেভদ্রে যান। সৌমিক কার্ডিও খানিকটা কম করেন। বেশি গুরুত্ব দেন ওয়েট লিফটিংয়ে। মাসল গেইন করার ঝোঁক নেই; বরং চেষ্টা করেন নিজের বর্তমান ওজন ধরে রাখার। এ ছাড়া সপ্তাহে দু-তিনবার ফুটবল খেলেন। ফুটবলে তিনি জার্মানির ফ্যান; জোহ্রা আর্জেন্টিনার। সৌমিকের পছন্দের ফুটবলার ডেভিড বেকহাম ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। পরিবারে পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে দুজনই যার যার বাবার কথাই বললেন।
সামাজিকতায়, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় জোহ্রা একটু এগিয়ে, এমনটাই দাবি সৌমিকের। নিজেও বন্ধুদের সঙ্গে সুযোগ পেলে প্রাণ খুলে আড্ডা দেন; তবে বাইরের মানুষের সঙ্গে ওপেন আপ একটু কমই হন। সাপ্তাহিক ছুটির আগে প্ল্যান করে প্রায় প্রতি বৃহস্পতিবার আড্ডায় মাতেন। বন্ধু সার্কেলকে তিনি আশীর্বাদ হিসেবেই দেখেন।
সৌমিক ও জোহ্রা—সময় পেলে দুজনেরই আছে সিনেমা ও টিভি সিরিজ দেখার অভ্যাস। জোহ্রা সাধারণত বৃহস্পতিবার রাতে টিভিতে চোখ রাখেন। সম্প্রতি দেখেছেন নোহোয়েয়ার, দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার, দ্য হন্টিং অব হিল হাউস। পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রী কারিনা কাপুর, শাহরুখ খান, রণবীর সিং ও জনি ড্যাপ। অন্যদিকে, সৌমিকের বেশি দেখা হয় টিভি সিরিজ। পছন্দের জনরা অ্যানিমে। সম্প্রতি দেখছেন নারিউকি অ্যাবে পরিচালিত ব্লিচ, হারুও সতোজাকির ডেমোন স্লেয়ার: কিমেতসু নো ইয়াইবা, অ্যাটাক অন টাইটান। অ্যানিমে দেখতে দেখতেই জাপানি সংস্কৃতির প্রতি একটা টান অনুভব করেন তিনি। জাপানের সামুরাই দর্শন, ডিসিপ্লিন, নমনীয়তা মুগ্ধ করে তাকে। বিভিন্ন জাপানিজ ব্লগেও ঢুঁ মারেন। তার পছন্দের নির্মাতা আদনান আল রাজীব। পছন্দের অভিনেত্রী পেনেলোপে ক্রুজ, অভিনেতা টম ক্রুজ।
এই যুগল বেশ ভ্রমণপিয়াসি। একসঙ্গে দেশের নানা প্রান্তের পাশাপাশি ঘুরেছেন নেপাল, তুরস্ক ও থাইল্যান্ডে। নিকট ভবিষ্যতে ভ্রমণের বাকেট লিস্টে রেখেছেন আরব আমিরাতের দুবাই। এ ছাড়া আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংককে গিয়ে কোল্ডপ্লের কনসার্ট উপভোগের পরিকল্পনা আছে। মিউজিক প্রসঙ্গে সৌমিক জানালেন, নাইনটিজ কিডস হওয়ায় তার ভালো লাগার সবটা জুড়ে রয়েছে কিছুটা পুরোনো অথচ এভারগ্রিন আর্টিস্টদের গান। মাইলস, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, ওয়ারফেজ ভীষণ প্রিয়। জিমেও এদেরই গানই শোনেন। অন্যদিকে, জোহ্রা গান শোনেন নিজের মেজাজ বুঝে, অনেকটা যখন যেমন ইচ্ছে। বর্তমানে পছন্দের গানের তালিকায় আছে টেইলর সুইফটের লাভার। ভ্রমণের স্মরণীয় স্মৃতি হিসেবে রয়েছে নেপাল ট্যুরে বানজি জাম্পিং। সৌমিক জোহ্রাকে অনেকটা শর্ত দিয়েছিলেন, পোখারাতে দুজনের একসঙ্গে বানজি জাম্পিং করতে হবে। সৌমিকের মেজাজেই রয়েছে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের তাড়না। নয়তো হাইট ফোবিয়া থাকার পরও কেই-বা বানজি জাম্পিংয়ের ঝুঁকি নেয়! এ ছাড়া করেছিলেন স্কাই ডাইভিং। বন্ড সাইন করা থেকে শুরু করে অ্যাডভেঞ্চার সমাপনীর আগ পর্যন্ত পুরো বিষয়টি পরিবারের কাছে চেপে গিয়েছিলেন তারা। সবকিছু শেষ করে পাঠিয়েছিলেন ভিডিও।
বাসায় রুম ডেকোরেশনের সব দায়িত্ব সামলান জোহ্রা। ছোট রুম পছন্দ তার। মনে করেন, ছোট রুমে মিনিমাম জিনিস থাকলেই হয়ে যায়, যা একটা সুবিধা। রুমে রেখেছেন আলমারি, ওয়্যারড্রোব, বেডসাইড টেবিল ও বেড। হালকা কালারের আধিক্য সবকিছুতে। আয়না পছন্দ করেন বলে তা-ও রেখেছেন রুমে।
ড্রেসআপের ব্যাপারেও সৌমিক অ্যাডভেঞ্চারাস। এমনকি কোনো কোরিয়ান সিরিজ দেখলে সেখান থেকেও ইন্সপায়ার হন। কালার ও ডিজাইন নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। তিনি বলেন, ‘আই ফিল গুড, হোয়েন আই লুক গুড। ট্রেন্ডের সঙ্গে মিলতে হবে, এমন কোনো কথা নেই; বরং অনেক সময় আমি উল্টোটা করি। স্ট্রাইকিং কালার আমার পছন্দ।’ জোহ্রা বলেন, ‘আমি ট্রেন্ড ফলো করি না। কালার টোন প্যাস্টেল, লাইট কালারেই থাকে। সফিস্টিকেটেড অ্যাটায়ারই পছন্দ। শাড়ি ভালো লাগে; তবে তা পরা বেশ ঝামেলার মনে হয়। তাই খুব একটা পরি না। তবে শাড়ি সংগ্রহের নেশা আছে।’
পছন্দের অ্যাকসেসরিজ প্রসঙ্গে জোহ্রা জোর দিলেন কানের দুলের ওপর। বাইরে দাওয়াতে গেলে চেষ্টা করেন তা পরার। তার কথার মাঝেই সৌমিক যোগ করলেন, জোহ্রাকে প্রথম দেখেই তার ভালো লাগার একটি বড় কারণ হলো, তাকে খুব মিনিমাল লেগেছিল। খুব একটা জুয়েলারি, মেকআপ, ফ্যান্সি ড্রেসআপের প্রবণতা চোখে পড়েনি। এককথায় অনেক মিনিমাল, ডিফরেন্ট আর অথেনটিক। বললেন, ‘আমার পছন্দের অ্যাকসেসরিজ ঘড়ি ও জুতা। ঘড়ির ক্ষেত্রে পছন্দের ব্র্যান্ড সিকো। জুতার ক্ষেত্রে নাইকি।’ তাদের দুজনেরই আছে পারফিউম সংগ্রহ ও ব্যবহারের শখ। সৌমিকের পছন্দের পারফিউম ব্র্যান্ড ইসে মিয়াকে, ডিওর, শ্যানেল ব্লু ও ভারসাচি। জোহ্রার পছন্দ নার্সিসো।
সৌমিক ও জোহ্রা—দুজনেরই আছে রান্নার শখ। সৌমিক এই শখ অনুধাবন করেন কোভিডের সময় থেকে, আর জোহ্রার ক্ষেত্রে তা আরও আগে। তবে ব্যস্ততার কারণে ইদানীং রান্না করার সময় পান কম। অবশ্য বাসায় অতিথি এলে নিজের একটা স্পেশাল ডিশ করার চেষ্টা থাকে। জোহ্রার রান্না করা কোন খাবার সবচেয়ে মজার, এমন প্রশ্নের জবাবে সৌমিক বলেন, ‘ও একধরনের খাসির মাংসের ডিশ করে, যাতে মসলা থাকে না বললেই চলে। সামান্য গরমমসলা, টমেটো, আদা, দম দিয়ে ২-৩ ঘণ্টা ধরে বানানো এই খাবার বাসার সবারই বেশ পছন্দ।’ অন্যদিকে জোহ্রার কাছে সৌমিকের রান্না করা সবচেয়ে পছন্দের খাবার ডরি ফিশ।
রাতে বোরিং মেনু পছন্দ নয় জোহ্রার। মজা করে ভাত, ভর্তা, মাছ, নানা পদের সবজি দিয়ে খেতে ভালোবাসেন। সৌমিক রাতের খাবারে কার্ব এড়িয়ে চলেন। প্রোটিন ও সবজি থাকে মেনুতে। রাত সাড়ে নয়টা থেকে দশটার মধ্যেই ভোজনপর্ব শেষ হয় এই দম্পতির।
পার্টনারশিপে কোন ব্যাপারগুলো গুরুত্বপূর্ণ, এমন প্রশ্নের জবাবে জোহ্রা জোর দিলেন পরস্পরের প্রতি আস্থা ও সম্মানের ওপর। সৌমিকের জোর সামঞ্জস্য ও বন্ধুত্বে। জোহ্রার চোখে সৌমিকের সেরা দিক হলো, ‘হি ইজ ভেরি অ্যাটেনটিভ অ্যাজ আ পার্টনার।’ একই প্রসঙ্গে সৌমিকের জবাব, ‘জোহ্রা ইজ ভেরি সিম্পল অ্যান্ড রিয়েল’।
জীবনদর্শন প্রসঙ্গে জোহ্রা বলেন, ‘লিভ, অ্যান্ড লেট লিভ।’ আর সৌমিক বলেন, ‘স্টে টু দ্য বেসিকস। আমরা যত মডার্ন হই না কেন, দিন শেষে শিকড়ে ফিরে যেতে হবেই। যেকোনো বেসিক সেটা পরিবার থেকে শুরু করে প্রকৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, পড়াশোনা—যেকোনো কিছু হতে পারে।’
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন