কুন্তলকাহন I সুরভিত আভাস
অগুরু, চন্দন, কস্তুরীর দিন গেছে সেই কবে! কিন্তু কেশ সুবাসিত করার সাধ কি মিটেছে আজও? নিত্যনতুন পণ্যে আর কৌশলের যোগেই মিলছে জবাব
প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল চুল সুগন্ধি করার প্রথা। ধূপের ধোঁয়ায়। এতে করে চুল সুবাসিত থাকত দিনভর। অগুরু, চন্দন আর কস্তুরী দিয়ে তৈরি সেই ধূপে চুল শুকানোর কাজটাও সারা যেত চটজলদি। পরে বিশেষ এ রীতির চর্চা দেখা যায় ঠাকুরবাড়িতে। ধুনচিতে কাঠকয়লার আগুনে ধুনো দিয়ে তার ওপর জালের ঢাকা দেওয়া হতো। এর ওপর রেখে শুকানো হতো চুল। এতে চুল ধুনোর সুগন্ধ হতো। আরব্য সংস্কৃতিতেও চুলকে সুবাসিত করার প্রথা বেশ পুরোনো। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় বাখুর। আতরের তেল, হার্ব, ফুল, ওউদ এবং নানা ধরনের কাঠের নির্যাস থাকে এতে। তাই গরম কয়লার ওপর এটি রেখে দিলে তা সুগন্ধি ধোঁয়া তৈরি করে। আর এ দিয়েই শুকানো ও সুবাসিত করা যায় চুল। এমনকি আয়ুর্বেদেও এ প্রথা দারুণ জনপ্রিয়। শুধু চুলে সুন্দর গন্ধই হয় না, এর ফলে নার্ভ শান্ত থাকে; প্রশান্তি আসে মন ও শরীরে। কিন্তু চুলকে সুবাসিত করার এ প্রক্রিয়াগুলো খানিকটা হ্যাপারই বটে। সময়সাপেক্ষও। তাই এখন সৌন্দর্যসচেতনেরা ঝুঁকছেন আধুনিক সব কৌশলে। বাজারে মিলছে ইনসেন্স হেয়ার কম্ব আর হ্যান্ডি সব হেয়ার বাখুর ও ধূপ কিট। সেগুলো বেছে নিচ্ছেন অনেকে।
এ ছাড়া আরও হরেক রকম উপায় আছে চুল সুরভিত করে তোলার। কত দিন আগে ধোয়া হয়েছে, কোন পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে এমনকি পরিবেশের প্রভাবও টের পাওয়া যায় চুল থেকে। শুধু তার গন্ধ শুঁকে। তাই লজ্জায় পড়তে না চাইলে মেনে চলতে হবে কিছু নিয়ম। সঙ্গে হাতের কাছে থাকা চাই বিশেষ কিছু হেয়ার প্রোডাক্ট। ব্যস!
সুগন্ধি তেল মাখা যেতে পারে চুলে অথবা মাখার ত্বকে। এ ক্ষেত্রে এসেনশিয়াল অয়েল সবচেয়ে ভালো অপশন। পেপারমিন্ট, রোজমেরি, ল্যাভেন্ডার কিংবা অরেঞ্জ সেন্টেড হেয়ার অয়েলগুলো থাকতে পারে পছন্দের তালিকায়। তেলে অস্বস্তি হলে বেছে নেওয়া যেতে পারে এসেনশিয়াল অয়েল ইনফিউজড রিফ্রেশিং মিস্ট অথবা অ্যান্টি পলিউশন স্প্রেও।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য যেমন ক্ষতিকর, চুলের জন্যও। সিগারেটের গন্ধ দীর্ঘ সময় থেকে যায় চুলে। সহজেই শুষে নিতে পারে বলে এর বোঁটকা গন্ধ চুল থেকে সরানো বেশ কষ্টসাধ্য। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ সমাধান যত দ্রুত সম্ভব শ্যাম্পু আর কন্ডিশনিং সেরে নেওয়া। আর যদি হাতে সে সময়টুকু না থাকে, ড্রাই শ্যাম্পু তো আছেই।
অনেকের ধারণা, শ্যাম্পু আর কন্ডিশনার সুগন্ধি হলে চুলে সুন্দর গন্ধ থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, দুটোই ধুয়ে নেওয়া হয়। সামান্য গন্ধ রয়ে যেতে পারে, সময় পেরোলে তা-ও উবে যায়। কিন্তু হেয়ারস্টাইলিং প্রোডাক্টের গন্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। মুজ, জেল কিংবা লিভ-ইন কন্ডিশনারের ঘ্রাণ টিকে থাকে পরের বার চুল ধোয়া অব্দি। তাই দীর্ঘ সময় সুবাসিত রাখতে চাইলে সুন্দর গন্ধযুক্ত হেয়ারস্টাইলিং প্রোডাক্ট বেছে নেওয়া চাই।
ব্যবহার করা যেতে পারে হেয়ার ফ্র্যাগরেন্স। এগুলো বিশেষভাবে শুধু চুলের জন্য তৈরি। অনেকে বডি পারফিউম চুলে ব্যবহার করে থাকেন, যা মোটেই ঠিক নয়। কিছু সময়ের জন্য সুরভিত রাখলেও এর বিরূপ প্রভাব কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী। বডি পারফিউম, মিস্ট বা যেকোনো ধরনের সুগন্ধিতে অ্যালকোহলের উপস্থিতি থাকে, যা চুলকে শুষ্ক করে ফেলে। তাই চুল সুবাসিত করতে চাইলে বিশেষভাবে চুলের জন্য তৈরি এমন প্রোডাক্ট বেছে নিতে হবে। হোক তা শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, স্প্রে, মুজ, ক্রিম কিংবা হেয়ার ফ্র্যাগরেন্স। হাতের কাছে চুলের সুগন্ধি নেই? আছে কুইক ফিক্সও। যদিও তা সব সময় করা যাবে না। হেয়ার ব্রাশে সামান্য পরিমাণে পারফিউম স্প্রে করে নিয়ে তা দিয়ে চুল আঁচড়ে নিতে হবে। এ ছাড়া গলার দুই পাশে পারফিউম স্প্রে করে নেওয়া যায়। চুলের কাছাকাছি সবচেয়ে শক্তিশালী পালস পয়েন্ট এটি। পাশাপাশি ঘাড়ের দুই পাশে হেয়ার লাইন ঘেঁষে স্প্রে করে নিলেই সুবাস ছড়িয়ে পড়বে চুল অব্দি।
চুল নিয়মিত ধোয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কারও মত, খুব ঘন ঘন না ধোয়াই ভালো। এতে করে মাথার ত্বকের প্রাকৃতিক তেলের ভারসাম্য বজায় থাকে। অন্য দলের মত, প্রায়শই চুল ধোয়া জরুরি। স্ক্যাল্প বিল্ডআপ থেকে রক্ষা পেতে। তবে চুলের সুঘ্রাণ যাদের অগ্রাধিকার, তাদের জন্য নিয়মিত চুল পরিষ্কার করাকে প্রাধান্য দিতে হবে। বিশেষজ্ঞ ডার্মাটোলজিস্টদের মত, দুর্গন্ধ তখনই তৈরি হয় যখন ত্বক, স্ক্যাল্প আর চুলে ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধতে শুরু করে। সে ক্ষেত্রে নিয়মিত ধোয়া হলে চুল আর মাথার ত্বকে তেল, ময়লা আর ব্যাকটেরিয়া জমাট বাঁধতে পারে না; তৈরি হয় না বোঁটকা গন্ধ। তবে প্রতিদিন চুল ধুতে হবে। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবারই যথেষ্ট। স্বাস্থ্যও রক্ষা হবে; ছড়াবে সৌরভ।
স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে চুল আর মাথার ত্বকে দুর্গন্ধ তৈরি হচ্ছে কি না, তা-ও যাচাই করে নেওয়া চাই। সেবোরিয়াক ডার্মাটাইসিসের মত, অত্যধিক খুশকির সমস্যায় এমনটা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সবার আগে ত্বক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। গোড়া থেকে সমস্যা সারাই জরুরি। সাময়িক কুইক ফিক্স এ ক্ষেত্রে কোনো কাজের নয়; বরং হিতে বিপরীত হতে পারে।
জাহেরা শিরীন
মডেল: প্রজ্ঞা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল