যাপনচিত্র I ট্রেন্ডে নারাজ
সোহিনী আলম। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ গায়িকা। ‘ক্ষ’, ‘লক্ষ্মীটেরা’ ও ‘গার্ল’—তিনটি ব্যান্ডের ভোকাল। ঢাকায় বসে শোনা যাক তার একান্ত জীবনের গল্প
জন্ম লন্ডনে। গানের হাতেখড়ি মা হীরন আলমের কাছে, যিনি ছিলেন ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন। মাত্র ৯ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন সোহিনী। তারপর চলে আসেন বাংলাদেশে। বেড়ে ওঠেন খালাদের সংস্পর্শে। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি, স্প্যানিশ, হিন্দি, উর্দু, তামিল, রোমা, তাগালোগ, আজারবাইজানি ও ফ্রেঞ্চ ভাষায় গান করেছেন।
তার খালা জান্নাত আরা ও ফেরদৌস আরা নজরুলসংগীতের প্রখ্যাত শিল্পী। তাদের কাছে নিয়েছেন সংগীতের পাঠ। ছোটবেলায় তাদের সঙ্গে নজরুল ইনস্টিটিউটে যেতেন। সেই সূত্রে সোহরাব হোসেন, সুধীন দাশের কাছে গান শিখেছেন। বাংলাদেশ থেকে ও-লেভেল আর এ-লেভেল সম্পন্ন করে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে, উচ্চশিক্ষা নিতে। বিবিএ (ম্যানেজমেন্ট ও মার্কেটিং) শেষে মাস্টার্স করেন কমিউনিকেশন বিষয়ে। করেছেন চাকরিও। সব মিলিয়ে আমেরিকায় থেকেছেন ৮ বছর।
সোহিনী মূলত লন্ডনেই থাকেন। সময় পেলে চলে আসেন ঢাকায়। শ্বশুরবাড়ি উত্তরায়; নিজের বাড়ি বনানীতে। দুই বাসাতেই থাকা হয় পালা করে। সকালে তার ঘুম থেকে ওঠা নির্ভর করে প্রাত্যহিক রুটিনের ওপর। উঠেই চা পান করা চাই। ব্রেকফাস্টে নির্দিষ্ট মেনু নেই। অনেকটা মন-মর্জির ওপর। কোনো দিন হয়তো টোস্ট ও অ্যাভোকাডো; কোনো দিন পিৎজা। অন্যদিকে ওয়ার্কআউট, ইয়োগা, মেডিটেশনের মতো কসরতগুলোর পরিকল্পনা থাকলেও খুব একটা বাস্তবায়ন করা হয়নি তার! তবে কোনো গন্তব্য খুব দূরের না হলে সেই পথ হেঁটেই পাড়ি দেন। এই যেমন বন্ধু ও ‘ক্ষ’ সদস্য অলিভারের বাসার দূরত্ব ৪০ মিনিটের পথটুকু। দুপুরে সাধারণত আহার সারেন দেড়টায়। এ বেলায়ও নেই নির্দিষ্ট মেনু। তবে ক্ষুধা সামলে কাজ করা তার পক্ষে মুশকিল। এমনও হয়েছে, অলিভারের প্র্যাকটিস প্যাডে ব্যাপারটি বুঝতে পেরে প্র্যাকটিস থামিয়ে দিয়েছেন লাঞ্চ করার জন্য।
পারিবারিক জীবন স্বামী ও সন্তান ঘিরে। স্বামী ‘আরবোভাইরাস’ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও গিটারিস্ট আসিফ আসগর রঞ্জন। মেয়ে আরোহীর জন্ম ২০২০ সালে, করোনা অতিমারির দিনে। ঘরবন্দি থাকায় সন্তানকে তখন পর্যাপ্ত সময় দিতে পেরেছেন, যা ইতিবাচক তার কাছে। পৃথিবীতে সন্তানের আগমনের পর তার চিন্তাধারা, জীবনধারায়ও এসেছে বেশ পরিবর্তন। নিয়মিত সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস এরপর থেকেই। স্বামী সৃজনশীল এবং একই পেশার হওয়ায় পারস্পরিক বোঝাপড়া পেয়েছে দারুণ মাত্রা। সোহিনীর পরিচিতদের সংখ্যা বিপুল হলেও মন খুলে কথা বলেন গুটিকয় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। বেশির ভাগ সময়ে আড্ডা জমে সাধারণত ঘুরেফিরে বন্ধুদের বাসায়। আর্জেন্টিনা ও আর্সেনাল-সমর্থক স্বামীর সঙ্গে ফুটবল খেলা দেখতে ভালোবাসেন। সোহিনী অবশ্য ইতালি ও ইংল্যান্ডের সাপোর্টার।
এই গায়িকার শিল্পরুচির পরিচয় মেলে তার বাসার ইন্টেরিয়রে চোখ রাখলেই। জানালেন, লন্ডনের বাসার দেয়ালজুড়ে কনকচাঁপা চাকমা, আবদুস শাকুর শাহ, রফিকুন নবী, কালিদাস কর্মকারসহ আরও অনেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর শিল্পকর্ম রয়েছে। তার মতে, ‘আর্টের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এটি মানুষের সৃষ্ট এবং মানুষের জন্যই।’
ফ্যাশন, পোশাক, স্টাইল, মিউজিক—কোনো কিছুতেই ট্রেন্ডে গা ভাসাতে নারাজ সোহিনী। তার কাছে এগুলো এইজলেস। পোশাক নির্বাচনে ব্যতিক্রমী ও আরামকে দেন গুরুত্ব। শাড়ির সঙ্গে জিনস ও বিভিন্ন ধরনের প্যান্ট, ট্রেইনার শুজ পরে নেন কমফোর্ট ও প্র্যাকটিক্যাল বিষয় বিবেচনায় রেখে। পাতলা চামড়ার মিলিটারি স্টাইল বুট, ব্ল্যাক লেদার বুট, কনভার্স পরেন মন-মর্জি ও স্বস্তিমতো। ‘গার্ল-এর সঙ্গে পারফর্ম করতে গিয়েই ধুতি স্টাইলে শাড়ি পরা শুরু করেন। এই স্টাইলে শাড়ি পরে স্টেজে মুভ করা তার কাছে সহজ ও সাবলীল মনে হয়। বাঙালি নারীদের পছন্দের পরিধেয় শাড়ি নিয়ে আছে তার ব্যান্ড ‘ক্ষ’-এর গান ‘শাড়ি বন্দনা’। সেটির নিরীক্ষাধর্মী মিউজিক ভিডিও বেশ আলোচিত। জানালেন, শিগগির আসছে ‘লুঙ্গি বন্দনা’রও মিউজিক ভিডিও।
সোহিনীর প্রিয় অ্যাকসেসরিজ নাক ও কানের দুল। এর পাশাপাশি অ্যানগেজমেন্ট ও ওয়েডিং রিংও সব সময় পরেন। এ ছাড়া শাড়ির সঙ্গে চুড়ি ও টিপ বেছে নিতে দেখা যায় তাকে। সিনথেটিক পারফিউম এড়িয়ে চলেন। পছন্দ ক্লিন ও অর্গানিক পারফিউম। মেকআপের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ফোকাসড হওয়ার চেয়ে স্কিন টোন বা নিজের সঙ্গে কোনটা ভালো মানায়, তা বিবেচনায় রাখেন। পছন্দ করেন কালারড আইলাইনার। ন্যাচারাল অর্গানিক প্রোডাক্টে আস্থা তার। ফাউন্ডেশন ব্যবহার থেকে শুরু করে যেকোনো হেভি মেকআপ এড়িয়ে চলেন।
রান্না করতে বেশ ভালো লাগে তার। সময় পেলেই স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে, পৃথিবীর নানা রকমের খাবার নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের মতে, তার রান্না সেরা খাবার স্যালমন বিরিয়ানি। সোহিনীর অবশ্য সবচেয়ে পছন্দের খাবার ভাত, ডাল ও সবজি। তিনি বলেন, ‘আমি যদি কখনো কোনো আইল্যান্ডে আটকা পড়ি এবং আমাকে কোনো খাবার বেছে নিতে বলা হয়, এগুলোকেই নেব।’
ভ্রমণপিয়াসি সোহিনী লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকা বাদে বাকি সব মহাদেশের বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন। ইচ্ছে আছে বাকি থাকা মহাদেশ দুটিতেও ঘুরতে যাওয়ার। মিউজিয়াম তাকে ভীষণ টানে। ইতিহাসের সঙ্গে আলাপচারিতা ও মিউজিয়ামের ঘ্রাণ নেওয়ার দিকটি একদম অনন্য অভিজ্ঞতা তার কাছে। লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরের বিখ্যাত সব মিউজিয়াম ঘুরে দেখেছেন। তবে ফ্লোরেন্সের অ্যাকাডেমিয়া গ্যালারিতে থাকা মিকেলাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’ ভাস্কর্যটি তাকে মুগ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশি। সোহিনী বলেন, ‘ওই ভাস্কর্যকে এতই জীবন্ত মনে হচ্ছিল, কোনো মানুষের পক্ষে এমন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব, ভাবতে পারিনি! মনে হচ্ছিল জ্যান্ত মানুষের মাংসপেশি, যা ধরা যাবে অথবা কথা বলার জন্য হয়তো যেকোনো সময় বেদি থেকে নেমে আসবে কাছে।’ অন্যদিকে তার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় ট্রাভেল এক্সপেরিয়েন্স বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ড্যান্সার ও কোরিওগ্রাফার আকরাম খানের সঙ্গে ‘আনটিল দ্য লায়ন্স’ ট্যুর। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল থেকে শো শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে যেতে হয়েছিল সেবার। সেখানকার টাইম ডিফারেন্সের কারণে দেখা যায়, তারা যেদিন যে সময়ে রওনা দিয়েছিলেন, পৌঁছেছেন তারও আগের সময়ে! ব্যাপারটি তার কাছে একধরনের টাইম ট্রাভেল মনে হয়েছিল। এ ছাড়া ‘লক্ষ্মীটেরা’র সঙ্গে নরওয়ের উত্তরাঞ্চলে পারফর্ম করতে গিয়ে রাতের দেখা পাননি; টানা পাঁচ দিনই ছিল সূর্যের আলো। ‘নিশীথ সূর্যের দেশ’ হিসেবে পরিচিত ওই ভূখণ্ডে গিয়ে তাই পড়ে গিয়েছিলেন ঘুমের বিড়ম্বনায়। এর প্রতিক্রিয়ায় লন্ডনে ফেরার পর দেড় সপ্তাহের মতো ঘুমাতে পারেননি তিনি ও তার ব্যান্ডমেটরা।
অবসরে গান শুনতে, বই পড়তে ও সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন সোহিনী। ছোটবেলা থেকেই বই তার নিত্যসঙ্গী। সবচেয়ে পছন্দের বই মিখাইল বুলগাকভের ‘দ্য মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিতা’। গানে তাকে প্রেরণা জুগিয়েছেন বেগম আক্তার, শচীনদেব বর্মন, নুসরাত ফতেহ আলী খান প্রমুখ। লাইসা আহমেদ লিসা, বেবি আক্তারের গানও ভালো লাগে। পছন্দের রক ব্যান্ড ‘লেড জেপলিন’।
নিজেকে রিয়েল লাইফে রাখতেই পছন্দ সোহিনীর। ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড খুব একটা টানে না। এমনকি তার কোনো ইউটিউব চ্যানেল নেই। ফেসবুক ব্যবহার করেন সীমিত। ইনস্টাগ্রাম খুলেছেন অন্যের পরামর্শে, অনেকটা বাধ্য হয়ে। দর্শকদের সামনাসামনি গান শোনাতেই তৃপ্তি পান বেশি। বর্তমানে বিশেষ ব্যস্ততা শরণার্থী ও শিশুদের নিয়ে কর্মশালায়। পাশাপাশি গান গেয়েছেন এবং যৌথভাবে সংগীত পরিচালনা করেছেন ‘বাড়ীর নাম শাহানা’ সিনেমায়। চলতি জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি দেখানোর কথা রয়েছে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন