skip to Main Content
photostory-feb-into

দৃশ্যভাষ্য I দাঙ্গার দিনগুলোতে প্রেম

শহুরে রাস্তায় তুমুল হাঙ্গামা। একদিকে লাখো দাঙ্গাবাজ, অন্যদিকে সশস্ত্র দাঙ্গা পুলিশ। তাদের মধ্যে সহসা ঘটে গেল মারাত্মক সংঘাত। এরই মধ্যে মাঝ রাস্তায় শুয়ে পড়ে, নির্বিঘ্নে চুম্বনরত এক যুগল! যেন জাদুবাস্তব কোনো দৃশ্য।
দিনটি ১৫ জুন ২০১১। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশের ভ্যানকুভার নগরের ডাউনটাউন কোর শহরতলিতে সেদিন সন্ধ্যায় ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ দাঙ্গা। খেলা ঘিরে। দেশটির ন্যাশনাল হকি লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি ‘স্ট্যানলি কাপ’-এর ফাইনাল শেষে। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যকার সেই দাঙ্গায় অন্তত ১৪০ জন আহত হয়েছিলেন; যাদের মধ্যে কম করে হলেও চারজন ছুরিকাঘাতের শিকার। দাঙ্গা রুখতে গিয়ে আহত ৯ পুলিশ কর্মকর্তা। গ্রেপ্তার ১০১ দাঙ্গাবাজ।
ইতিহাসে ‘২০১১ ভ্যানকুভার স্ট্যানলি কাপ রায়ট’ শিরোনামে চিহ্নিত সেই দাঙ্গা চলাকালেই এই যুগলের এমন বিরল প্রেমময় মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করেন ‘গেটি ইমেজ’-এর কানাডিয়ান ফটোগ্রাফার রিচার্ড ল্যাম। ছবিটির দিকে এক পলক তাকালে মনে হবে, গোলমালের মধ্যেই রাস্তায় শুয়ে চুমু খাচ্ছে ওই যুগল। তবে এর নেপথ্য গল্প একেবারে ভিন্ন। আর তা মোটেই রোমান্টিক নয়! বরং দাঙ্গা পুলিশের আঘাতে আহত হয়ে ওভাবে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলেন তরুণ স্কট জোনস ও তার প্রেমিকা অ্যালেক্স থমাস। তাদের সেই পড়ে গিয়ে উঠতে চাওয়ার মুহূর্তই আলোকচিত্রের নিজস্ব জাদুতে ছড়িয়েছে চুম্বনদৃশ্যের বিভ্রম।
গণমাধ্যমে ছবিটি প্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। আর এটি পরিগণিত হয় দুনিয়ার সবচেয়ে আইকনিক চুম্বন আলোকচিত্রগুলোর একটি হিসেবে। তরুণটির বাবা ব্রেট জোনস নিজের ফেসবুক পেজে বিস্ময় প্রকাশ করে লেখেন, ‘এ যেন যুদ্ধ নয়, বরং ভালোবাসা সৃষ্টির উপায় বাতলে দেওয়ার’ দৃশ্য; একই সঙ্গে নিজের ছেলেকে উইলিয়াম শেকসপিয়ারের জগদ্বিখ্যাত সৃষ্টি ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর রোমিও হিসেবে অভিহিত করেন।
শুরুতে অনেকে ছবিটিকে এভাবে, অর্থাৎ দাঙ্গার দিনগুলোতে প্রেমের নমুনা হিসেবে দেখলেও কেউ কেউ করেছেন সন্দেহ। এটি তাদের কাছে মেকি বা বানোয়াট আলোকচিত্র বলে মনে হয়েছে। এমনকি ছবিটি আসলে কী প্রকাশ করছে, তা নিয়ে দ্বিধা ছিল স্বয়ং আলোকচিত্রীরও। এরপরের শট সেই রহস্য আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। কেননা, সেখানে দেখা গিয়েছিল, অ্যালেক্স তখনো একইভাবে শায়িত থাকলেও স্কট নিজের মাথা খানিকটা ওপরে তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন; তাদের পাশে দণ্ডায়মান এক অজ্ঞাত তরুণী।
মূল, অর্থাৎ দৃশ্যত চুম্বনরত ছবিটি নিয়ে যখন তুমুল কৌতূহল ও আলোচনা, নিজেকে এ ঘটনার চাক্ষুষ দাবি করে, স্থানীয় সংবাদপত্র ‘ভ্যানকুভার সান’কে উইলিয়াম নামের এক তরুণ জানান, তিনি তখন ছিলেন একটি কারপার্কের ওপরে; সেখান থেকে তাকিয়ে ছিলেন এই আলোকচিত্রের ঘটনাস্থলে। উইলিয়াম বলেন, ‘পুলিশ যখন লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করতে তাড়া করছিল, এই যুগল তখন দুজন দুজনের কাছ থেকে আলাদা না হওয়ার চেষ্টারত। সেই অবস্থায় দুজন পুলিশ তাদের মাড়িয়ে চলে যায়। প্রথমে মেয়েটি ওই পাকা রাস্তায় থুবড়ে পড়েন; আর পরস্পর হাত ধরাধরি থাকার কারণে প্রেমিকটিও একইভাবে পড়ে যান মুহূর্তেই। তবে তিনি পড়েন মেয়েটির একদম ওপরে। মেয়েটি তখন সত্যি আঘাত পেয়েছিলেন; কাঁদছিলেন। কিন্তু দুজন পুলিশ কর্মকর্তা তাদের ধাক্কা দিয়ে আলাদা করে দেন। এ সময় দর্শকেরা ছুটে গিয়ে নিশ্চিত করেন, মেয়েটি ঠিকঠাক আছেন কি না।’
ছবির তরুণটির নাম স্কট জোনস, বয়স ২৯; তিনি মেলবোর্নের মানুষ, যিনি ছয় মাস ধরে ভ্যানকুভারে বাস করছিলেন—এই তথ্য ব্যাপকভাবে শনাক্ত করে অস্ট্রেলিয়ান গণমাধ্যম। আরও জানা যায়, তার পাশে থাকা প্রেমিকা অ্যালেক্স থমাস একজন কানাডিয়ান। অস্ট্রেলিয়ান অনলাইন গণমাধ্যম ‘নাইনএমএসএস’কে স্কটের মা মেগান জোনস বলেন, ‘ছবিটি দেখামাত্রই বুঝে গিয়েছিলাম, এটি আমার ছেলে; কেননা, বাড়তি জামাকাপড় তার নেই, আর সে সব সময় একই পোশাক পরে।’
পুরো নেপথ্য গল্প প্রকাশের আগে, নিজের ছেলেকে রাস্তার মাঝখানে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বেশ মর্মাহত হলেও অবাক হননি মেগান। বলেছিলেন, ‘আমাদের ছেলে এমন কিছু করবে, এ তো জানা কথাই! সে সব সময়ই নিজের দুনিয়ায় থাকে। এমনই একজন বিশেষ মানুষ সে। চারপাশে কী ঘটছে, তা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় না। এমন খবর পেলে আমি যেখানে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলি, সেখানে সে স্রেফ একজন রূপসী মেয়েকে চুমু খাওয়ায় মগ্ন!’
বোন হানা জানান, প্রকাশের পরপরই স্কটের ফেসবুক পেজে অসংখ্য লোক এই ছবি পোস্ট করছিল। তাতে একজন লিখেছিল, ‘খবরজুড়েই দেখি তুমি খেলা করছ! তুমি তো বিখ্যাত হয়ে গেলে।’ এর উত্তরে স্কট লিখেছিলেন, ‘ক্ল্যাসিক! এই দৃশ্য দাঙ্গা পুলিশ আমাদের মাড়িয়ে যাওয়ার ঠিক পরমুহূর্তের; আর স্বভাবতই অ্যালেক্সকে আমার তখন খানিকটা সান্ত¡না দেওয়ার ছিল।’
এদিকে ছবিটির কারিগর রিচার্ড ল্যাম বলেন, ‘আমি ছিলাম ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ২০-৩০ গজ দূরে। ওই ফাঁকা রাস্তায় পড়ে ছিলেন তারা দুজন। মুহূর্তেই আমার মনে হয়েছিল, তাদের মধ্যে কোনো একজন আহত হয়েছেন।’ প্রেম নয়, বরং দাঙ্গার ছবি তুলছেন ভেবেই ঝটপট কয়েকটি ক্লিক করেন তিনি। বলেন, ‘সেখানে প্রচণ্ড গোলমাল চলছিল। দাঙ্গাকারীরা দুটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তারপর দেখলাম, পাশের একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরের জানালা ভেঙে লুটতরাজ করছে কিছু লোক। সেই মুহূর্তেই সবাইকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। আমিও তখন পড়িমরি ছুটছিলাম। ছুটতে ছুটতেই খেয়াল করি, সামনে দাঙ্গা পুলিশ আর পেছনে আগুনের লেলিহান—মাঝখানে ফাঁকা রাস্তায় পড়ে আছে এক যুগল।’
ল্যাম আরও বলেন, ‘এমন গোলমালের মধ্যে ওই মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি আমি করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু অফিসে ফিরে ছবি বাছাইয়ের আগপর্যন্ত এর মর্মার্থ ধরতে পারিনি! আলোচ্য ছবিটি দেখে আমাদের ফটো এডিটরই প্রথমে বলেছিলেন, “আরে, এরা দুজন তো আহত নয়; বরং চুমু খাচ্ছে!”’ আর প্রকৃত সত্য প্রকাশের আগে, এভাবে প্রেমের বার্তা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এই আলোকচিত্রের বিস্তার। এমনকি ‘ভ্যানকুভার রায়ট কিসিং কাপল’ তকমা পায় ছবিটি।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
 লাইফস্টাইল ডেস্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top