skip to Main Content

আমি বাদী, আমি বিবাদী I শহুরে সংসার

সম্পর্ক ভাঙার শব্দ চারদিকে। উচ্চাকাক্সক্ষা, যান্ত্রিক আর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চাপ কি বইতে পারছে না এই শহুরে সংসার? লিখেছেন সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন

সম্পর্ক অনেকটা পাশাপাশি থাকা কাচের চুড়ির মতো। একসঙ্গে যখন থাকে, টুংটাং বাজতে থাকে, সেই শব্দে মন ভালো হয়ে যায়। হাত থেকে পড়লেই ভেঙে চুরচুর। সমস্যা হচ্ছে, আজকাল একটু বেশিই পড়ে যাচ্ছে। চারদিকে শুধু সম্পর্ক ভাঙার শব্দ। যেকোনো কারণে কোনো সম্পর্কে একটুখানি ভাঙন ধরলে, তাকে ঠিক করার জন্য যে সময় কিংবা উদ্যোগ নিতে হবে, সেই চেষ্টায় চেয়ে, বেরিয়ে আসা প্রায় সবার কাছে শ্রেয় মনে হয়। অনেক সময় বেরিয়ে আসাই হতে পারে শ্রেয়তর সমাধান। ব্যাপারটা অনেকখানি চিকিৎসার মতো। ফ্র্যাকচার হলে এক রকম, হাড় ভেঙে গেলে আরেক রকম, আবার হাঁটুর হাড্ডি ভেঙে গেলে চিকিৎসা অন্য রকম। বিশ্রাম করতে হবে, প্লাস্টার লাগানো হলে বেশি নড়াচড়া করা যাবে না, সময়মতো ওষুধ খেতে হবে, ধৈর্য ধরে শুশ্রূষা করতে হবে, তবেই না অসুখ সেরে যাবে। কিন্তু সময় কোথায়? একটু পরপর বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মেসেজের শব্দ আসছে, মনোযোগ ওদিকে চলে যাচ্ছে। প্রিয় মুখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
হয়তো আধুনিক শহুরে জীবনে নানান রকম ব্যস্ততা আর মোহ-মায়ার ভিড়ে, একজীবনে এক সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যাচ্ছে। একটা সম্পর্ক ঠিক রাখতে এতো ঝামেলাই-বা পোহাতে হবে কেন? ব্যক্তিস্বাধীনতার এই যুগে, সম্পর্ক অনেক সময়ই বোঝা হয়ে দেখা দেয়। দুজন মানুষ মিলে একটা সম্পর্ক হবে, সে ঠিক আছে, কিন্তু তারপরও তো প্রত্যেকের আলাদা পছন্দ-অপছন্দ আছে, দীর্ঘ সময়ের অভ্যেস আছে, একান্ত ব্যক্তিগত কিছু বিষয় আছে, যেগুলো শুধুই নিজের। সেগুলোয় আঁচ লাগলেই বিরক্তি বাড়ছে। নতুন নতুন নানা সম্পর্কের ফের, কিছু জাগতিক, কিছু প্রযুক্তিগত। এত সম্পর্কের ভিড়ে কোনো একটার পেছনে সময় দেওয়ার সময় কই? আজকের আধুনিক মানুষের কাছে, তার নিজের চেয়ে প্রিয় কেউ নেই। তাই নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে বিসর্জন দিয়ে অন্য কোনো কিছুতেই সে আগ্রহী নয়। কেউ কারও প্রত্যাশার চাপ নিতে আজ আর রাজি নয়।
আবার পুরুষশাসিত সমাজের ধ্বজাধারীদের কাছে আজকের আধুনিক নারীর উত্থান খুব সুখকর নয়, হওয়ার কথাও নয়। এত দিনের সাম্রাজ্যে হাত পড়লে কার ভালো লাগে। কিন্তু করারও কিছু নেই, যে দেশের শতকরা প্রায় ৫০ মানুষ নারী, তারা তো আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে না, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ শুধু কাম্যই নয় বরং জরুরি, নইলে দেশ চলবে কী করে! পাশাপাশি ক্রমশ বাড়তে থাকা নারী শিক্ষার হার, সমাজের বিভিন্ন কাজে নারীর ভূমিকা, নারীকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে। তাই আজ সে হাজার বছর ধরে চলে আসা পুরুষশাসিত সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বিধিবিধান মেনে নিতে নারাজ। তাই আজকের আধুনিক সম্পর্কে নারী-পুরুষের দ্বন্দ্বের এত আধিক্য। এই প্রতিবাদী, সম্ভাবনাময় এবং আত্মবিশ্বাসী নারীর সামনে, আমাদের পুরুষশাসিত সমাজের দম্ভ আজ বিপন্ন।
আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে, আজ কেউ আর সাধারণ জীবন নিয়ে খুশি নয়। প্রত্যেকেরই অসাধারণ জীবন চাই। উচ্চাকাঙ্ক্ষার পারদ চড়তে চড়তে সীমা অতিক্রম করতে চাইছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষার ঘোড়ায় সওয়ার মানুষ আজ দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে অধরা ভবিষ্যতের দিকে, সেই যাত্রায় তার সময় কোথায়, কারও দিকে তাকানোর? জীবনে কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড় দিতে হয়। আধুনিক মানুষের কাছে তাই মানবিকতা, সম্পর্কের শান্তি, ভালোবাসার সুখ- কোনোটাই অগ্রাধিকার পায় না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থানের ধারাবাহিকতায়, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষের প্রয়োজন আছে বৈকি! তবে মানবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার মহাকাব্য আমাদেরই রচনা করতে হবে। নইলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের জন্য গলার ফাঁস হয়ে আবির্ভূত হবে।
gousulalamshaon@gmail.com

ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দীপু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top