পাতে পরিমিতি I ঈদ-পরবর্তী ডায়েট
পবিত্র রমজান মাসে অভ্যস্ত খাদ্যাভ্যাসে আসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ঈদের পর তা ঠিকঠাক শুধরে না নিলে বিপদ! রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
ঈদ মানেই আনন্দ। আর সেটি যদি হয় ঈদুল ফিতর, তাহলে তো কথাই নেই! রমজান মাসে সারা দিন না খেয়ে যে সিয়াম পালন করতে হয়, তার পরবর্তীকালে যেদিন আমরা খাবার গ্রহণ করতে পারি, সেটি ঈদের দিন। ছোট-বড় সবার জন্যই ঈদের প্রস্তুতি থাকে বিভিন্ন রকমের। স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনা করলে রোজার পর অনেক সময় দুই রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রথমত, কারও কারও ওজন কমে যেতে পারে, তবে এটি বিরল। সাধারণত যারা সাহ্রীতে খাদ্য গ্রহণ এড়িয়ে চলেন কিংবা কম খান, অথবা সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারে তেমন খাবার গ্রহণ করতে পারেন না, তাদের ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত ওয়েট লসের ঝুঁকি থাকে। আর দ্বিতীয়ত যে সমস্যা দেখা দেয়, সেটি বেশ কমন; অর্থাৎ ওবেসিটি। রোজার পরে ঈদে সুন্দর ও ফিটনেস শো করতে অবশ্যই রোজায় একটু লেস ক্যালরির খাবার গ্রহণ করা ভালো। কিন্তু তা সম্ভব না হলে সুস্থতা রক্ষায় পরবর্তী ডায়েটে হওয়া চাই পারফেক্ট মডিফিকেশন।
রমজানে লাইফস্টাইল আমাদের একটু ভিন্ন থাকে। তবে ঈদ এবং এর পরবর্তী সময়ে এই লাইফস্টাইল আবার পরিবর্তন হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ঈদের পরপরই লাইফস্টাইল ও ফুড হ্যাবিট পরিবর্তন করে নিতে হবে দ্রুত। রোজায় সাহ্রী ও ইফতারে মিষ্টিজাতীয় আইটেম, অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার বেশি গ্রহণ করলে পুরো মাসে ওজন অবশ্যই বেড়ে যায়। রমজানের পরই যখন ঈদ, তখনো ভারী খাবার আর রকমারি ডেজার্টে ভরা থাকে খাবার টেবিল। এ ছাড়া ঈদে বাড়িতে বাড়িতে দাওয়াত আর কখন যে কী খাচ্ছি, তার কোনো রুটিনই যেন থাকে না। তাই ঈদ-পরবর্তীকালে দ্রুততম সময়ে তৈরি করে নেওয়া চাই হেলদি ডায়েট। সঙ্গে অবশ্যই থাক ব্যালেন্সড লাইফস্টাইল। সে ক্ষেত্রে কিছু টিপস:
সকালটা শুরু করতে পারেন হালকা লেমন জুস হানি মিক্সড ডিটক্স ওয়াটার দিয়ে। এতে শরীর চাঙা হবে দ্রুত। আর ওজন কমাতে যারা মরিয়া, তারাও ঝরিয়ে ফেলতে পারবেন বাড়তি মেদ।
ব্যায়ামের অভ্যাস সব সময়ই ভালো। তবে যারা একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠেন, ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে হাঁটার সময় পান না শুধু আলসেমির কারণে, তারা মর্নিংওয়াকের পরিবর্তে করতে পারেন ইয়োগা বা কার্ডিও এক্সারসাইজ। এতে অল্প সময়ে মিলবে বেশি ফিটনেস।
খাদ্যতালিকা থেকে কার্বোহাইড্রেট আর ভিজিবল ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবারগুলো কমিয়ে ফেলুন। সে ক্ষেত্রে অমিট করতে পারেন রাতের কার্বোহাইড্রেট।
দিনের যেকোনো একটি সময় এক কাপ লো ফ্যাট মিল্ক রাখুন ডায়েটে। এটি দীর্ঘ সময় স্বাস্থ্যকর পুষ্টি জোগানোর পাশাপাশি ক্ষুধা কম অনুভব করতে সহায়ক।
ঈদের পর সুস্থ জীবনযাপনের জন্য ডায়েটারি মডিফিকেশন ভীষণ জরুরি। সে ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকায় রাখা চাই কিছু হেলদি আইটেম। প্রতিদিনের তালিকায় যে নিউট্রিয়েন্টগুলো রাখতে হবে—
কার্বোহাইড্রেট: ওজন বাড়ার ভয়ে খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট যেন আজকাল বেশ অবহেলিত। অথচ শক্তির সর্বোৎকৃষ্ট উৎস হিসেবে ডায়েট লিস্টে প্রথমেই ধরা হয় একে। তাই সম্পূর্ণ বন্ধ না করে রাখতে পারেন কমপ্লেক্স কার্বোহাইডেট; যেমন ওটস, লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি ইত্যাদি।
ওমেগা থ্রি: অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবারগুলো খাদ্যতালিকায় রাখলে রক্তে এলডিএল অর্থাৎ ব্যাড কোলেস্টেরল বাড়ার ঝুঁকি থাকে। তাই ওমেগা থ্রিযুক্ত খাবার রাখতে পারেন ঈদ-পরবর্তী ডায়েটারি মডিফিকেশনে। এটি রক্তের এইচডিএল বাড়িয়ে এলডিএল কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করবে।
ফাইবার: সলিবল ও আন-সলিবল—দুই রকম ফাইবারই সুস্বাস্থ্য রক্ষায় রাখা প্রয়োজন। ঈদে এ ধরনের ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার অর্থাৎ সবুজ শাক বা যেকোনো ধরনের সবজি খাদ্যতালিকায় সাধারণত কম থাকতে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে ঈদ-পরবর্তী মডিফিকেশনে ফাইবার যথেষ্ট পরিমাণে রাখা প্রয়োজন।
আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট: ফ্যাট বা চর্বি শুনলেই আমরা আঁতকে উঠি। অথচ আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটগুলো শরীরের জন্য হেলদি। বাদাম, বীজ বা নানা রকম সিডস ইত্যাদি এমন ফ্যাটের ভালো উৎস। এ ক্ষেত্রে উদ্ভিজ্জ তেল, বিশেষত অলিভ অয়েল বা সানফ্লাওয়ার অয়েল রাখতে পারেন রান্নায়।
সুস্থতা রক্ষায় খাবারের অভ্যাসগুলো সুষম ও পরিমিত হওয়া প্রয়োজন। আবার দৈনন্দিন জীবনে সব সময় মেপে মেপে খাবার গ্রহণ করাও কঠিন। এ ক্ষেত্রে সারা দিনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ঈদ-পরবর্তী ডায়েটের মোডিফিকেশন হতে পারে এ রকম—
ব্রেকফাস্ট: সকালের নাশতা অনেকে স্কিপ করেন। সুস্থ থাকতে হলে মর্নিং ব্রেকফাস্ট অবশ্যই গ্রহণ করা চাই। এ সময়ে পাতে রাখা যেতে পারে বয়েলড এগ, ওটস ইয়োগার্ট মিল, রাজমা, ইডলি ইত্যাদি। মনে রাখা চাই, সকালের নাশতায় আর যা-ই থাকুক, প্রোটিন যেন বাদ না পড়ে কোনোভাবে।
দুপুর ও রাতের খাবার: হেলদি থাকতে লাঞ্চ ও ডিনারেও হেলদি মিল রাখা প্রয়োজন। রাখতে পারেন ১ কাপ ওটস খিচুড়ি অথবা দুটি লাল আটার রুটি, ১ পিস স্টিমড ফিশ অথবা চিকেন ইত্যাদি। সেই সঙ্গে একটু সটেড ভেজ আর শাক থাকলে যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন মিনারেলসের পাশাপাশি ফাইবার পাওয়াও সম্ভব হয়। অবশ্য রাতে শাক খেলে অনেকের অ্যাসিডিটির সমস্যা হয়; সে ক্ষেত্রে সে সময়ে তা না গ্রহণ করাই ভালো।
স্ন্যাকস: অনেকের একটু পরপর হালকা কিছু না কিছু খাবার গ্রহণ করার অভ্যাস রয়েছে। সে ক্ষেত্রে চানাচুর, চিপস, কোল্ড ড্রিংকস ইত্যাদি হাতের কাছে সহজলভ্য বলে একটু পরপরই মুখে দিয়ে ফেলি। আর তাতেই আনহেলদি হয়ে পড়ে আমাদের ডেইলি ডায়েট মেনু। আনহেলদি খাবারগুলোর পরিবর্তে স্ন্যাকস হিসেবে রাখা যেতে পারে নাটস।
একটু মিক্সড নাটস নিজেই ঝটপট বাসায় তৈরি করে নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম এমনকি চিনাবাদামও সংমিশ্রণ করে নেওয়া যেতে পারে। আর তাতে যদি কিছু সিডস যোগ করে নেওয়া যায়, তাহলে প্রোটিনসহ ভিটামিন মিনারেলস পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে, বিকেলের নাশতা মানেই অনেকের কাছে ভাজাপোড়া খাবার। পুরো রোজায় যেহেতু এ ধরনের খাবার গ্রহণের অভ্যাস আমাদের হয়ে যায়, ঈদের পরও তা কাটাতে পারেন না কেউ কেউ। যার ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে তো থাকেই না, বরং নানা শারীরিক সমস্যা প্রকট হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। তাই এ ধরনের ফ্যাটি খাবারের পরিবর্তে রাখতে পারেন এমন সব লিকুইড ডায়েট, যেগুলো সহজে বাসায় তৈরি করে নেওয়া যায়। যেমন স্যুপ, জুস কিংবা বিভিন্ন ধরনের ডিটক্স ওয়াটার। স্পিনাচ স্যুপ, চিকেন ভেজিটেবল স্যুপ, এগ ড্রপ স্যুপ ইত্যাদি হতে পারে দারুণ সমাধান।
সঠিক খাদ্যাভ্যাসের চর্চা না করলে সুস্থ থাকা দুরূহ। তাই ঈদের আগপর্যন্ত যেমনই হোক, পরে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়া হবে বুদ্ধিমানের পরিচয়।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট